ব্লগ : দেশান্তর/ ৫ । চিত্ত হোক ভয়শূন্য এই স্বাধীনতায়


চিত্ত হোক ভয়শূন্য এই স্বাধীনতায় 

মৌমন মিত্র 


ঙ্গে বর্ষা ঘনিয়ে এসেছে। আমেরিকায় গ্রীষ্ম। এই লেখার কথামুখে বলা যায়, লঙ্গিচিউড ল্যাটিচিউডের কী দুরন্ত প্রাকৃতিক ওঠাপড়া!। এত বছরে, আমার মনে দু’দেশের ঋতুই মিলে মিশে গেছে।ঠিক যেভাবে বাংলা অক্ষর মিশেছে অভ্র কী-প্যাডে, মালপোয়া মিশেছে চিজকেক-এ, পার্ক স্ট্রিট মিশেছে ম্যানহ্যাটানে। বহুল গতিবেগে, এভাবেই বোধহয় জীবন এগিয়ে যায়!
আজ মহামারীর স্রোতে আমার দু'কূলই ভাসমান। প্রাথমিক ঢেউয়ের অবসান ঘটতে না ঘটতেই, আবার জাঁকিয়ে থাবা বসিয়েছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। দৈনন্দিন প্রায় ৩০,০০০ এর বেশি মানুষ রোগাক্রান্ত হচ্ছে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে।
এপ্রিল এবং মে মাসে, গড়ে, প্রতিদিন তিন হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, এবং আমেরিকান জনসংখ্যার ৭ থেকে ৮ শতাংশ মানুষ করোনায় সংক্রমিত হয়। এই মুহূর্তে, দৈনন্দিন মৃত্যুর সংখ্যা ৬০০ জনের কাছাকাছি।
চৌঠা জুলাই ছিল এখানের স্বাধীনতা দিবস। এই দিন বিভিন্ন রাজ্যে আতশবাজি সহকারে উদযাপন করা হয় মার্কিন স্বাধীনতা। এই বছর মহামারীর জন্য ছোট এবং বড় বিভিন্ন শহর মিলিয়ে ৮০ শতাংশ আতশবাজির উৎসব বাতিল করা হয়েছে। লেক টাহ’র ওপরে বিস্তীর্ণ আকাশ অন্ধকার রয়ে যাবে। নিউ ইয়র্ক সিটির বিখ্যাত মেসির ৩৬-তম ফায়ারওয়ার্ক প্রদর্শন করা হয় সারা সপ্তাহ জুড়ে। শনিবার রাতে আতশবাজির আলোর প্রাচুর্যে সুস্নাত ম্যানহ্যাটান স্কাইলাইন। দেখা গেল টেলিভিসিনের পর্দায়। হোয়াইট হাউসের সামনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প স্বাধীনতা পালনের বিপুল আয়োজন করেন, স্বাধীন ভাবে। মুখোশহীন, দৈহিক দূরত্ব পালন না করেই। গোটা আমেরিকায় মোট ৩৭-টি রাজ্য এখন এই মুহূর্তে মহামারীর কবলে। প্রতিটি শহর থমথমে। অথচ সন্ধেবেলায় নির্ধারিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে সমগ্র আমেরিকাবাসীকে স্যালিউট জানালেন সরকার।
বললেন, তিনি দায়িত্ব নিয়ে আমেরিকার ইতিহাস রক্ষা করবেন। কৃষ্ণাঙ্গদের বর্বরতা সহ্য করবেন না। তাঁর মেজাজ প্রসন্ন। তাঁর বক্তৃতায় মহামারীর কোনও উল্লেখ পাইনি আমরা। ওই যে বলেছিলাম মনে আছে? কগনিটিভ ডিসোনেন্স?

 
চৌঠা জুলাই, রাতের ঝলমলে আকাশ দেখলে বোঝার উপায় নেই যে, আমেরিকা কর্মহীনতায় ভুগছে, আমেরিকা মহামারীর কারণে নাগরিকদের বাড়িতে রেখে তাঁদের বেতন দিতে অক্ষম! এ যেন মহাষ্টমীর রাত, কিংবা কালী পুজোর রাত কেটে গেল। আলোর রোশনাই— এ শ্রেষ্ঠতম স্বাধীনতা পালন হল আমেরিকার রাজধানী সহ বিভিন্ন শহরে। এমনকী আমার পাড়াতেও নিউ জার্সি নিউ ইয়র্কের আকাশ মিলিয়ে, দেখা গেল প্রায় আধ ঘন্টার আতশবাজি!


ইউটাহ শহরে এই সপ্তাহান্তে, আতশবাজির আগুনের দ্বারা দাবানল সৃষ্টি হয়। এর ফলে,  সল্ট লেক সিটির থেকে ৩০ মাইল দূরে একাধিক মানুষকে তাঁদের বাসস্থান ইভ্যাকুএয়াট করতে হয়েছে। এই আমাদের স্বাধীনতা। এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশের নাম কিন্তু সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
নর্থ আমেরিকান বেঙ্গলি কনফারেন্স ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সংস্থার অংশীদার। তাঁদের স্বেচ্ছাসেবীরা আম্ফান ঝড় এবং কোভিড মহামারীর ত্রাণ সংস্থার সঙ্গে সরাসরি ভাবে যুক্ত। এঁদের  হোপ ২০২০ এরই মাঝে $৭৫০০০, ভারতীয় মুদ্রায় ৫৬ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেছেন অনলাইন অনুষ্ঠানের আগে। এই জাতীয় উদ্যোগ, ঐতিহাসিক। হোপ ২০২০, এক ঝাঁক তারকাদের কন্সার্টের মাধ্যমে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ৩, ৪, এবং ৫ জুলাই— তিন দিন ধরে চলবে এই অনুষ্ঠান। নর্থ আমেরিকান বেঙ্গলি কনফারেন্স এবং কালচারাল অ্যাসোসিয়েশান অফ বেঙ্গল, এই নর্থ আমেরিকা, সাউথ আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা,এবং অস্ট্রেলিয়ার ৮০ টি গ্লোবাল সংস্থায় স্বক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। এই অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী সঙ্গীতে আছেন পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় এবং স্বাগতা চক্রবর্তী।
মানুষ সোশ্যাল ডিস্টেন্স বজায় রাখলেও মনে মনে যে সে এক চরম সমাজবদ্ধ জীব তা বেশি করে প্রমানিত হয় মহামারীতে। সাধারণ নাগরিকের কর্মকান্ডে। এভাই বোধহয় এক দেশের মেঘ আরেক দেশের সীমানা অতিক্রম ক'রে, ঝড়, বৃষ্টি দিয়ে আসে। ভাগ্যিস প্রকৃতির কোনও জাতীয় প্রতিবন্ধকতা নেই। তাই তার অবাধ স্বাধীনতা!
১৭৭৬ সালের চৌঠা জুলাই স্বাধীনতা লাভ করে আমেরিকা। এরপর ধাপে ধাপে সৃষ্টি হয়েছে বৈষম্যতা। না, আমি কেবল বর্ণবৈষম্যতার কথা বলছি না। প্রঙ্গত সামাজিক অসমতার কথাই এখানে উল্লেখযোগ্য। বড়জোর বিবর্ধন করেছে আক্রমণ, আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্র, সীমারেখা রক্ষা করতে সুবিশাল দেয়ালের পরিকল্পনা, নাগাড়ে প্রতিবাদ, অর্থনৈতিক অসমতা, বদলে হিংসা— এসব নিয়েই এই দেশ পুঁজিবাদে মাতোয়ারা।
ভারতবর্ষে বসে, আমেরিকান মহিলাদের খুব স্বাধীন ভাবতাম। বিগত ষোলো বছরে বুঝতে পেরেছি যে, ছোট পোশাক আসলে স্বাধীনতার মাপকাঠি নয়। স্বাধীনতা বুঝি আত্মার। স্বাধীনতা ভয়শূন্যতায়। পরাধীনতা দূর হয় বাকস্বাধীনতায়।
নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম ইত্যাদি ওয়েবসাইটে বিগত এক মাসে বিপুল পরিমান সিনেমা, ওয়েব সিরিজ সম্প্রচার করা হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের ঘিরে। এমন নয় যে এই সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ গুলি নতুন। সবই পুরোনো। বেশ পুরোনো।লকডাউনে স্বাভাবিক ভাবেই শুটিং এর কাজকর্ম স্থগিত ছিল। তাহলে,এই পুরোনো সিনেমা, ওয়েব সিরিজ এখন সম্প্রচার করা হচ্ছে কেন?
একদম ঠিক ধরেছেন। কারণ হল, দর্শক হয়ে আমরা এই জাতীয় সিনেমা এখন দেখব, ওয়েব সিরিজ বিঞ্জ ওয়াচ করব। ক’রে, ফেসবুকে আপডেট দেব, ‘ওয়াচিং হেল্প!’ সঙ্গে সঙ্গে লাইকের বন্যা বয়ে যাবে! বন্ধুরা ভাববে, ‘উফ! কী প্রগতিশীল! আমিও দেখব। সত্যিই তো কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে দেখা উচিৎ! হ্যাঁ হ্যাঁ আমিও দেখি!’
আখেরে কিন্তু বাড়ছে নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন ভিউস। এবং সমাজ কল্যানে, চিরকালীন ক্রীতদাসেরা তৈরি করবে ব্ল্যাক লাইভস এর ইতিহাস! যা আমার আপনার সন্তানেরা সোশ্যাল স্টাডিজে পড়ে পরীক্ষায় নম্বর অর্জন করবে। শিক্ষিত হবে। বছেরর পর বছর।
আমার বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডের ওপারে নিউ ইয়র্কের রকল্যান্ড কাউন্টি। গত ১৭ জুন এই রকল্যান্ড কাউন্টিতে একজন করোনায় আক্রান্ত হয়, এবং তা অবগত হয়েও প্রায় একশো জনের একটি পার্টির আয়োজন করে। ক্রমশ এই একশো জনের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। নিজের জীবনের অবাধ স্বাধীনতাকে এইভাবে প্রয়োগ করার নামই কী শিক্ষা? শরীর থেকে শরীরে কীভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে যায় নিমেষে! আর মনের জীবাণুর  সংক্রমণ ছড়ায় আত্মায়।
লক্ষ লক্ষ আমেরিকান, বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ এবং হিস্পানিক আমেরিকান নাগরিক আজও আর্থিক ভাবে নিরাপত্তাহীন। পাঁচ লক্ষ নাগরিকের বেশি মানুষ গৃহহীন। পথবাসী। এই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, এখন নাই নাই এর হাহাকার! দারিদ্ররেখা, অনিশ্চয়তা আছড়ে পড়ছে দিকে দিকে। এছাড়া, জীবাণুর কবলে প'ড়ে, এই দেশের লড়াই, বিশ্বময় মানুষের কাছে আজ আর অজানা নয়। 
আমার কমপ্লেক্সের ঠিক শেষের আগের বাড়িটিতে থাকেন অ্যামেলিয়া। বিবাহবিচ্ছেদের পর ছ'রকম পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন সে নিজেকে। একের পর এক। বছর একচল্লিশের অ্যামেলিয়া, পেশায় পাইলট।অ্যামেলিয়ায়া খুব সাধারণ ভাবেই  নিজের একটি সংসার গড়তে চেয়েছিলেন। স্বামী, সন্তান, এবং কিছু গাছ আর একটি পেট নিয়ে। হয়নি। একের পর এক পুরুষ ওঁর অন্তরকে ক্ষত করে গিয়েছে। কেউ ভালবেসে কেউ ভালবাসার অভিনয় ক’রে।
অবশেষে বিজ্ঞানের হাত ধরে, সারোগেসির মাধ্যমে, গত সপ্তাহে এই মহামারীর মাঝে অ্যামেলিয়া মা হলেন। গতকাল বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে দেখা হল ওঁর সঙ্গে, মাঝপথে। একই রকম আছে মনে হল। সেই ছিপছিপে গড়ন। ব্লান্ট হেয়ারকাট। হাতে ছাইরঙা অ্যাপল ঘড়ি। বেবিকে নিয়ে তিনিও হাঁটতে বেরিয়েছেন।
ছ’ফিট দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমার চোখে চোখ রেখে, অ্যামেলিয়া বলেন, ‘‘আমি শেষমেশ মা হলাম ডিয়ার। তোমার মতো। কিন্তু নিজে নিজেই। কোনো সম্পর্কে না জড়িয়েই। আর আমায় কেউ ভালবেসে, এই সংসারে ঠকাতে পারবে না। তুমি তো জানো, এতদিন যে-ই এসেছে শরীর ছুঁয়ে, ক্রমশ আলগোছে সরে গিয়েছে! আসলে আমি-ই বকা!’’
অ্যামেলিয়া-কে ঠিক কী বলব বুঝতে পারিনি ওই মুহূর্তে। ওঁর স্বাধীন পদক্ষেপ, ওঁর স্বাধীন ইচ্ছে কত কাল যে পরাধীনতার শেকলে দুমড়ে-মুচড়ে রাখা ছিল ওঁর অন্তর আত্মায়!
আজ মেঘ করেছে দিগন্ত বিস্তৃত আকাশে। অ্যামেলিয়ার পরনে সেই আসমানী নীলচে রঙা টি-শার্ট। ওঁর বাড়ির সামনে, বাগানের দু'ধারে অসংখ্য লাল, গোলাপি, হলুদ রঙের ফুল ফুটে আছে। সারি সারি। কী যে যত্ন মেয়েটার! এই মহামারীতেও এত ফুল ফুটিয়েছে বাগানে। এই ফুলের মাঝে, একটা ছোট্ট আমেরিকান পতাকা পুঁতে রেখেছে ও। সারা বছরই থাকে। আজ এক স্বচ্ছ, সাবলীল বাতাসে উড়ছে সেই পতাকা। অঢেল আত্মবিশ্বাসে। যতদিন প্রাণ থাকবে, যতদিন ইচ্ছের ডানা থাকবে, যতদিন ওঁর উঠোনে জোৎস্নার ঢল নামবে, ততদিন স্বাধীনতার লড়াই বেঁচে থাকবে। মানবসমাজে। এই লড়াই-ই আদতে স্বাধীনতা! স্বাধীনতা ব'লে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার কী কোনও মাপকাঠি হয়?
এবার আমার ফেরার সময় হল। স্ট্রোলারের বেবিকে দূর থেকে একটা ফ্লায়িং কিস দিয়ে, অ্যামেলিয়াকে জড়িয়ে ধ'রে, আজ আনন্দধারায় বয়ে, বলতে ইচ্ছে করছে ‘হ্যাপি ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে!’ মহামারী কী ঢেউ না স্রোতে আসে? বুঝে উঠতে পারিনি এখনও। তবে, কোনও মারণ জীবাণু যেন কখনও না ছোঁয় আমার অ্যামেলিয়াদের।


Post a Comment

1 Comments