ছোটগল্প/ ২ : ফেরা

ফেরা

কাজরী মুখোপাধ্যায়


ছুটছিল জবা। শাড়ী উঁচু করে ব্যাগটাকে বগলে চেপে একে ওকে একটু আধটু ধাক্কা মেরে জবা ছুটছিল।
দুই চারজন তাকে ‘ঢলানি’ চোখের মাতা খেয়েছে— এসব বলে গাল ও পাড়ছিল। তা এসব কথা কানে নেওয়ার সময় জবার কোনওদিনই থাকে না। সকালে ট্রেন থেকে নেমে ও ছোটে, আবার এই বিকাল সন্ধ্যায় ট্রেন ধরতেওও ছোটে। ওসব মুখ খিস্তি, খারাপ কথা জবার কাছে খোলামকুচির মতো। গায়ে লাগে না। হাঁপাতে হাঁপাতে যখন বালিগঞ্জ স্টেশন এর ওভার ব্রিজে উঠল, ঠিক তখনই শুনতে পেল স্টেশন ঘর থেকে ঘোষণা করছে— বিশেষ কারণের জন্য ৫.২৫ এর ডায়মন্ড হারবার লোকাল বাতিল হয়েছে। ট্রেন চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় তারা খুব দুঃখিত।
‘অমন দুঃখের মুখে ছাই’,— বলে খুলে যাওয়া খোঁপাটাকে অত্যন্ত বিরক্ত মুখে সামলায়। তারপর জলের বোতলটা বের করে ঢকঢক করে খানিকটা জল গলায় ঢালে। ব্যাগে সবসময় এই জলের বোতল রাখার ব্যাপারটা ফ্ল্যাটের বৌদিদের কাছে শিখে নিয়েছে জবা। প্রথম প্রথম তার একটু বাধোবাধো ঠেকত, স্বপনও বাঁকা হাসি দিয়ে বলত— অফিস করতে চললে নাকি?
শাশুড়ি বলত— ঢং দেখে বাঁচি না, রাস্তা ঘাটে সঙ্গী-সাথীরাও একটু হাসত, কিন্তু ওরাও খুব দ্রুত এর দরকারটা বুঝে নিয়ে জলের বোতলকে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছে। আগে এই লাইনের ট্রেনে বিখ্যাত ছিল ফটাস জল। ওঃ! যেই না ফট করে জলের বোতল টা খুলে দিত আর অমনি সোডাজল বোতলের গলা অবধি ফেঁপে উঠত। ঠান্ডা মিষ্টি মিষ্টি একটু ঝাঁঝালো সেই পানীয় গলায় ঢেলে যে কি আরাম তা না খেলে বোঝানো যাবে না। পচার জল, গোপীর জল এসব ছিল ডায়মন্ড হারবার লাইনের সব বিখ্যাত জল কোম্পানি। বারুইপুর, মগরা হাট, ধামুয়া প্রভৃতি স্টেশনের চত্বর অনেক খানি ভিজে থাকত এইসব জল বিক্রেতাদের জন্য। এখন আর সেসব দিন নেই। এখন পেপসি কোলা দের যুগ। জবা ওভার ব্রিজে দাঁড়িয়ে ঘাম মুছতে মুছতে পুরোনো কথা ভাবছিল। তখন সে তার বাবা রামহরির সংগে বারুই পুর এসে বেশ কয়েকবার ফটাস জল খেয়েছে। ওদিকে মামাবাড়ি সংগ্রাম পুর যেতে আসতেও মায়ের কাছে বায়না করত ফটাস জল খাওয়ার, মা কোনও কোনও সময় খাওয়াত, কোনও সময় হাত ধরে নিয়ে চলে যেত। এখন তার তিনটে ছেলে মেয়ের কেউই ফটাস জলের ভক্ত নয়। তারা খেতে চায় পেপসি ফ্রুটি এইসব।
জবা মাঝেমধ্যে এসব নিয়ে যায়। প্রথম যেদিন মাইনেটা পায় সোহাগ ম্যাডামের কাছ থেকে সেদিন কিছু টাকা দিয়ে মনের দুই একটা ছোটখাটো সাধ মেটানোর চেষ্টা করে। সব মাসে হয় না। সোহাগ ম্যাডাম মাসের প্রথম দিনেই মাইনেটা দেয়, মনটা ভালো, অনেক সময় কিছু বাড়তিও দেয়। জবাও অবশ্য সোহাগ ম্যাডামের জন্য করে। কিন্তু সবাই তো সমান নয়। ওই য়ে রায় মাসীমা, একসপ্তাহ না গেলে কিছুতেই মাইনে দেবে না। বোঝে না জবারও ছেলে মেয়ে অসুস্থ স্বামী নিয়ে সংসার আছে। শত কষ্ট হলেও জবা তিনটে ছেলে মেয়েকেই স্কুলে পাঠায়। ওর শাশুড়ি অনেক সময় মেয়েটাকে স্কুলে যেতে না দিয়ে বাড়ির কাজ করায়। কিন্তু জবা শুনলে বাড়ি ফিরে তোলপাড় করে। শাশুড়ির মাথায় ঢোকে না রোজ স্কুলে গিয়ে  কি হবে, স্কুলে না গিয়েও তো এখন সবাই পাশ করে যাচ্ছে।
জবার মাথাটা চিন্তায় বিজবিজ করে। পরের ট্রেনটা যে কখন আসবে আর কত ভিড় নিয়ে আসবে তার ঠিক নেই। ছোটছেলেটার কয়েকদিন থেকে জ্বর। আসার সময়ও ছেলেটার জ্বর দেখে এসেছে। এখন আবার এদিক সেদিক খুব ডেঙ্গু হচ্ছে। ছেলেটা সেদিন খুব আপেল খেতে চাইছিল। তা এসময়  আপেলের দামটা খুব চড়া। একটা যে কিনে নিয়ে যাবে তার জো নেই। সে যতই পরিশ্রম করে মাইনে আনুক, তার পুরোটাই চলে যায় সংসারের গর্ভে। বাড়তি কিছু কেনা যায় না। আজ রায় মাসীমা দের ডাইনিং টেবিলের উপর ফলের ঝুড়িতে মোটা মোটা চারটে আপেল দেখে তার যে একটু লোভ হচ্ছিল না তা নয়, কিন্তু চুরি করা আপেল খাওয়ালে যদি ছেলেটার জ্বর আরো বেড়ে যায়! ধর্ম বলেও তো একটা ব্যাপার আছে!


জবা পায়ে পায়ে নেমে এল ওভারব্রিজ থেকে প্লাটফর্মে। তার চেনা সঙ্গীরা এখানে ওখানে অনেকেই রয়েছে। কেউ ট্রেনের সাত গুষ্টি উদ্ধার করছে, কেউ খোশমেজাজে পরনিন্দা-পরচর্চা সেরে নিচ্ছে। জবাও  অন্য  দিন এগুলো তে যোগ দেয়, আজ তার ভালো লাগছে না একেবারে। মনে হচ্ছে তার পায়ে যদি চাকা লাগানো থাকত সে এখনই ছুটে চলে যেত মগরাহাট। ভরসা করত না ট্রেনের।সময় যেন আর কাটে না। দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া জবা সময় দেখতে ভালোই জানে, কিন্তু সময়ের অপেক্ষা নিয়ে কবিত্ব করার ক্ষমতা তার নেই।
জবার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। আজ প্রায় তিন বছর ধরে স্বপন শয্যাশায়ী। স্বপন যখন নরেন্দ্রপুরে বিস্কুট কারখানায় কাজ করত, জবা তখন পাতা কেটে  চুল আঁচড়ে ননদদের বাড়ি ঘুরতে যেত পুজো পার্বণে। সংগ্রামপুরে ছেলেপুলের হাত ধরে বাপের বাড়ি ঘুরে আসতো। তখন জবার ওজনই ছিল আলাদা। তারপর তিনবছর আগে কালীপুজোর আগের দিন রাত্রে বাড়ি ফেরার তাড়াতে চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে স্বপনের সংসারটাই বদলে যায়। স্বপন প্রাণে বাঁচলো ঠিকই, কিন্তু সে বেঁচে থাকা মরণেরই নামান্তর। চিকিৎসা করাতে গিয়ে একটু একটু করে শেষ হয়ে গেল সব সঞ্চয়। অল্প সোনা ছিল সেও গেল বন্ধকে, ফেরত আর এল না। বাপের বাড়ির লোকজন, ননদরা প্রথম কিছুদিন সাহায্য করল তারপর সংসারের নিয়মে আস্তে আস্তে হাত গুটিয়ে নিল। ‘আচ্ছেদিন’ আর কার ঘরেই বা আছে!
আটাশ বছরের জবা তিনটে ছেলেমেয়ে, বুড়ো শাশুড়ি আর অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে প্রথম কিছুদিন কাঁদলো তারপর সাবিত্রী মাসির পরামর্শে তারই হাত ধরে কলকাতায় এল রান্নার কাজ করতে।  এখন সে শুধু রান্নার কাজই করে না, বাসন মাজা, ঘর মোছা, ছেলে ধরা সব রকমই করে। যেখানে ভালো মাইনে দেয় সেখানে সে সবই করে। মাস গেলে ১০ হাজার টাকা সে নিয়ে আসে। আর সেই টাকায় এতগুলো লোকের খাওয়া পরা, স্বপনের ওষুধ, সবই করতে হয়। বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে অল্প বয়সী মেয়ে হিসেবে সে যে বিপদে পড়েনি তা নয়, কিন্তু পথের সঙ্গী চায়না বৌদি, রীনাদিদি ও আরো অনেকে ওকে শিখিয়েছে কিভাবে সেই পরিস্থিতিগুলো মোকাবিলা করতে হয়। আসা যাওয়ার পথে ট্রেনের এই লেডিস কম্পার্টমেন্টগুলো তো আসলে বাইরে বেরোনো মেয়েদের রেস্ট রুম। সেখানে যে একে অপরের কাছ থেকে ওরা জীবনের কত কিছুর পাঠ নেয়, তার কোনও সংকলন কোনও লেখক তৈরি করেনি।


জবার মোবাইলে ফোন করছে ওর মেয়ে— ‘কখন আসবে মা? ভাইটার জ্বর যে বাড়ছে’।
জবা বলে, হাসান মেডিকেল স্টোর্স থেকে ওষুধ এনে খাওয়াতে আর গরম দুধ থাকলে দিতে।
কতো ট্রেন আসছে যাচ্ছে শুধু ডায়মন্ড হারবার লোকালটারই খবর হচ্ছে না। তার সঙ্গীদের অনেকেই বারুইপুর লোকাল ধরেছে, সেখান থেকে আবার ট্রেকারে করে যাবে নানা অঞ্চলে। অনেক ঘুরপথ হবে, কিন্তু বাড়িতে ফিরতে হবে তো। জবার মাথার যন্ত্রণাটা খুব বেড়েছে, শরীর জুড়ে গা বমি আসতে থাকে, বুঝতে পারে এখন ট্রেন এলেও সে ওই প্রচণ্ড ভিড় ট্রেনে চাপতে পারবেনা। কিন্তু তাকে যে বাড়ি ফিরতেই হবে। কচি ছেলেটার জ্বর, অসুস্থ পঙ্গু স্বপন, শাশুড়ি বুড়ো, বড় ছেলে মেয়ে দুটো তাকে না পেলে কিচ্ছু সামলাতে পারবে না, অস্থির হয়ে যাবে। ফিরতে তাকে হবেই যেভাবে হোক।
কি ভেবে স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসে, ওষুধের দোকানে এসে দুটো ট্যাবলেট খায়, মুখে চোখে জল দেয়, তারপর সামনের চায়ের দোকান থেকে এক কাপ চা আর দুটো লেড়ো বিস্কুট খায়। ঠিক সেই সময় সামনে এসে দাঁড়ায় ট্যাক্সিটা। মুখ বাড়িয়ে ড্রাইভারটা বলে— ‘কিগো যাবে না? এখানে থাকবে না কি? টেরেন তো আজ বন্ধ! কখন চালু হবে কেউ জানে না!’
জবা ড্রাইভার লালটুকে চিনতে পারে। স্বপনের বন্ধু ছিল। স্বপন পড়ে যাবার পর জবা কে সে অনেক ইশারা দিয়েছে একসময়। জবা না বোঝার ভান করে এড়িয়ে গেছে। লালটু চোখে ইশারা নিয়ে তাকায়। জবা প্রথম না বললেও লালটু ছাড়া আর ফেরার গতি নেই সে বুঝতে পারে।  আন্দাজ করে গাড়িতে কি হতে পারে তবু ঝুঁকি নিয়ে লালটুর গাড়িতে চেপে বসে। ঠান্ডা বাতাস লেগে মাথাটা হাল্কা লাগে। কলকাতা আস্তে আস্তে পিছিয়ে পড়ে। রাস্তা ফাঁকা হয়ে আসে। লালটু একটু সরে আসে জবার দিকে। এক হাত তার স্টিয়ারিং-এ, আর এক হাত জবার কোমর জড়ায়।
জবাকে যে আজ বাড়ি ফিরতেই হবে!

শিল্পী : প্রমিতা বারুই


Post a Comment

0 Comments