ব্লগ : দেশান্তর/ ৯ । মানুষ মরুক, বাণিজ্য থামলে চলবে না

 

মানুষ মরুক, বাণিজ্য থামলে চলবে না

মৌমন মিত্র

খন সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা সংবাদপত্রের ফিল্ম রিভিউ-এর সঙ্গে নিজের পছন্দের সিনেমা মেলাতে পারি না। রিভিউ যাকে দারুণ রেটেড সিনেমা বলছে, তাকে নাটুকে মনে হয়। রিভিউ যাকে সাধারণ বলছে সেই সিনেমা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মন ছুঁয়ে যায়। এখন অবশ্য সিনেমাও অনলাইন। এই অন্তরিন জীবনে, আমাদের আংশিক অনলাইন যাপন হয়তো মানসিক ভাবে টিকিয়ে রেখেছে। ভালও নয় মন্দও নয়। 

সেদিন নিজেই ব্রাউজ করতে করতে নেটফ্লিক্সে, অনুভব সিনহা পরিচালিত ‘থাপ্পার’ দেখলাম। এক থাপ্পরে একজন নারীর জীবন কীভাবে যে বদলে যায়! এক সাধারণ জীবন কীভাবে অসাধারণ জীবনে পরিণত হয়, তাই নিয়েই এই কাহিনি। পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে দেখা যায় এমন একটি সিনেমা থাপ্পর।

আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। এই সিনেমার গল্প আক্ষরিক এক থাপ্পর ঘিরে। এই পৃথিবীর প্রত্যেক নারী, তার জীবনের কোনও না কোনও স্তরে একজন পুরুষের হাতে কী থাপ্পর খায়নি? কী হয়েছে সেই সব সম্পর্কের? সেই সম্পর্করা আজ জীবিত না মৃত? কালই-বা কী হবে সেসব সম্পর্কের? 

‘‘It is what it is!” অর্থাৎ পরিস্থিতি যা, তাই থাকবে। কারর কিছু করার নেই। যা আছে, যেমন আছে, মেনে ও মানিয়ে নিতে হবে।

আমেরিকানরা যখন কোনও হতাশ পরিস্থিতি মেনে নিয়ে তার মোকাবিলা করেন, তখন তাঁরা বলেন, “it is what it is’’ যার পারিপার্শ্বিক অবস্থানের পরতে পরতে জমে থাকে এক একটা ‘থাপ্পর’।

এই সপ্তাহে অ্যাক্সিওস- কে দেওয়া ইন্টারভিউ- এ প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার করোনার মৃত্যুর সংখ্যা শুনে মিস্টার জনাথান সওয়ানকে জানালেন, ‘‘It is what is” অর্থাৎ হতাশ পরিস্থিতির এই পর্যায়ে এসে মার্কিন মুলুকে সমস্ত নাগরিককে মেনে ও মানিয়ে নিতে হবে। কারণ, এই দেশের সর্বনাশা রাজনীতি। পুঁজিবাদ রাজনীতির জাঁতাকলে প্রায় প্রতিনিয়ত নিষ্পেষিত হচ্ছে সৎ প্রচেষ্টা। করোনা মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা। 

সারা বিশ্বে আমেরিকায় এখন মৃত্যুর সংখ্যা শীর্ষে। এক লক্ষের এর বেশি শিশুরা করোনায় সংক্রমিত। ইন্ডিয়ানাপলিসে প্রথম দিন স্কুলে গিয়েই সংক্রমিত হয় এক চোদ্দ বছরের যুবতী। প্রথমে সেই স্কুলের এক স্টাফ করোনায় সংক্রমিত হয়। তাঁর থেকে এই যুবতীর সংক্রমণ।

পরিস্থিতি কতটা গুরুতর, সেটা মফস্সল কিংবা শহরের দিকের কোনও সরকারি অথবা বেসরকারি স্কুলে ঢুঁ মারলেই বোঝা যায়। ওদিকে কর্মক্ষেত্রে ফেরার জন্য অভিবাবকদের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করছে একাধিক দফতর, কার্যালয়। চারপাশে অসিহষ্ণুতার আবহ ফনফনিয়ে উঠছে। যেন মানুষ মরছে মরুক, বাণিজ্য থামলে চলবে না। 

৪ অগস্ট আত্মহত্যা করেন ২৩ বছরের ডেজি কোলম্যান। ১৪ বছর বয়েসে ডেজি শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হয়। ২০১৬ সালের একটি ডকিউমেন্টারি চলচ্চিত্র ‘অড্রি অ্যান্ড ডেজি’, তার জীবনের এই লড়াই তুলে ধরে দর্শকের চোখে। SafeBaE নামক একটি নন-প্রফিট সংস্থার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিল এই  ডেজি। এই সংস্থার উদ্দেশ্য স্কুলে শারীরিক নির্যাতন প্রতিরোধ করা। এত লড়াকু ডেজি নিজেই নিজেকে গুলি করে শেষ করে দেয়। শেষপর্যন্ত! আচ্ছা, ওকে চোদ্দ বছরে যে বা যারা শারীরিক নির্যাতন করেছিল, তারাও কী ডেজির অসহায় অবস্থায় বলেছিল, ‘‘It is what it is’’ …?

গত কয়েকদিন আগের ট্রপিকাল স্টর্মে নিউ জার্সির একাধিক অঞ্চল বিগত পাঁচ দিন যাবৎ বিদ্যুৎহীন। আসলে প্রকৃতি যখন দুর্যোগ আনে তখন উন্নত অনুন্নত কোনও দেশেরই ফারাক থাকে না। ফারাক তো আমরা মানুষে তৈরি করি। পাহাড়, ঝর্ণা, নদী, আকাশ, বাতাসে কী আর ফারাক থাকে? থাকলে তিস্তার জল কী আর হাডসানে বয়! ফারাক আমাদের মনের ভিতর। অথচ যেখানে মনের খেলা, মনের সৃষ্টি, মনের কল্পনা, সেখানেই অবিশ্বাসের পৃথিবী।

এই যে বাইশে শ্রাবণ এসে চলেও গেল, তার কী প্রথম বিশ্ব, তৃতীয় বিশ্ব আছে? দেশ-কালের, চক্রবৎ পরিবর্তন্তের নিয়মে পরিবর্তন হলেও তাঁরই ‘অসীমে’ আমরা দৈনন্দিন ধাবমান। 

বর্তমানের এই অনিশ্চিত কাল হয়তো, গড়ে নেবে অন্য নতুন পৃথিবী। বাড়ির ছোট সদস্যদের চোখে মুখে সেই স্বপ্নই প্রতিনিয়ত ঝলসে উঠতে দেখি। আজও।এখনও। 

ডিস্ক্রিমিনেশানবিহীন অথবা বৈষম্যহীন এক পৃথিবীর রূপ দেখতে পাবে ওরা। ওদের বিশ্বাসে ওদের ভালোবাসায়।

নিউ ইউয়র্কের শহর থেকে অনেকটা আজ দূর চলে এসেছিলাম। পরিবারের সঙ্গে। এখানে খোলা মাঠ, মাইলের পর মাইল ক্ষেত খামার। মাঝে মাঝে প্ল্যান্টেশন আর ছোট বড় রিসোর্ট। এখন আবার ফিরে চলেছি বাড়ির দিকে। হু হু করে ছুটছে আমার গাড়ি। হাইওয়ের ওপর দিয়ে। এসির বোতাম থেকে হাত সরিয়ে জানলার কাঁচ খুলে দিয়েছি। এখন চুল সামলাই, না রোদচশমা! কলকাতায় দুর্গা পুজো ঘনিয়ে আসছে। মহামারিতেও পুজো হবে হয়তো। ব্যাগ হাতড়ে ক্যামেরাটা বের করে পটাপট ছবি তুলতে থাকি আমি। মনের কাশবনের। কানে এসে ধাক্কা দেয় ঢাকের বাদ্যি। এই সুদূর প্রবাসে মনের প্রয়াসে। সতেরো বছর আমি পাড়া পুজো দেখি না। It is what is! 

থাক আরও এক বছর এভাবেই বয়ে যাক। এখন কেবল মনে হয়, থাক সবাই। ভাল থাক। ধর্ম, উৎসব, জাতি পেরিয়ে আজ মানুষই তো শেষ কথা। কেবল এখন কেন? এ সত্য কী চিরকালীন নয়? চিরকালীনের  হ’তে পারে না?

এই মহামারিতে অনেক বন্ধুত্ব হারিয়েছি। অনেক বন্ধুত্ব ফিরেও পেলাম। হারিয়ে বুঝেছি সেসব বন্ধুত্ব স্বার্থে ছিল। যাদের ফিরে পেলাম তারা থেকে গেল। এই ‘কর্ণ ধ’রে’, একা ঠাই দাঁড়িয়ে থাকি। কত ধাপ কত বৎসর কত জীবনের কত সময় এভাবেই বয়ে যায়। সময়ের ব্যাধি স’য়ে। আকুলে, অকূলে। 

যাকে ভালবেসে কবি কানে কানে বলে গেলেন , ‘তবু মনে রেখো’, কেবল বাইশে শ্রাবণ নয় প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ, ‘থাকি না থাকি’।  

Post a Comment

0 Comments