ব্লগ : স্বগতোক্তি/ ৮ । স্ব-কে সনাক্ত করা জরুরী

স্ব-কে সনাক্ত করা জরুরী

তড়িৎ রায় চৌধুরী

যতবার ভাবি ততবারই অবাক হই। রামমোহন, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র মানে বাঙালি জাতির প্রতিনিধি বা ভারতবর্ষের মুখ বলে আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় বিখ্যাত, এদের সকলেরই জন্ম ও মৃত্যু এক পরাধীন দেশে। স্বাধীন দেশের স্বাদ এঁরা একবেলার জন্যও পাননি। তাহলে রাষ্ট্রিক স্বাধীনতা কতটা জরুরী নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে? প্রশ্নটা ক্রমে গড়িয়ে যায় স্বাধীনতা কি? কোথায় তার জন্ম? সেইদিকে। স্বাধীনতা লাভ নিঃসন্দেহে পরাধীন সময়ের  অবসান। অর্থাৎ যে দেশ কখনও অন্যের অধীনে থাকেনি তার কোনও স্বাধীনতা দিবস নেই। যেমন বৃটেন। সে কত দেশকে স্বাধীনতা দিবস দিয়েছে অথচ তার নিজের কোনও স্বাধীনতা দিবস নেই। আচ্ছা এই অন্যটা কারা? অন্য ধর্মের মানুষ? 

ভারত ভাগের সময় পূর্ব পাকিস্থান তো পশ্চিম পাকিস্থানের সঙ্গেই পা মিলিয়েছিল স্বাধীনতা উদযাপনে। সে ছিল ধর্মের সাদৃশ্য। কিন্তু ক্রমে বিদ্রোহী হয়ে উঠল বাঙালি জাতিসত্তা। শেষে বিধর্মী ভারতের সাহায্যেই জন্ম নিল স্বাধীন বাংলাদেশ। এই  জাতিসত্তার কথা ভেবেই হয়তো বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালির পাচঁশো বছরের পরাধীনতার কথা বলেছিলেন। তুর্কি আক্রমণ থেকে যার শুরু। কিন্তু ঠিক তার আগে? সেন রাজত্বকাল! পাল যুগের গৌরব ধূলিসাৎ করে বর্ণ বিদ্বেষের বিষে ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে গিয়েছিল সেন সাম্রাজ্য আর সে জন্যই না সফল হল তুর্কিরা। বরং প্রাথমিক ঝড়-ঝাপ্টার পর সুলতানী আমলে বাংলা স্বাধীনই ছিল অনেকটা। সাহিত্য-সংস্কৃতি, সমন্বয়ে উন্নতি হল। তবে কি দক্ষ প্রশাসকই সার সত্য?

কিন্তু মোঘলরা ছিল আরও দাপুটে আর দক্ষ। তবু সে আমলে বাংলা নিতান্তই এক সুবা। বরং ইংরাজরা কলকাতায় রাজধানী বানিয়ে প্রভূত সুবিধা দিল। তার মানে ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুর নৈকট্যই মূল। তাই মধ্যরাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় থেকে নির্দিষ্ট একদল ভারতবর্ষীয়ই তার মালিক। যে জন্য উত্তরপূর্ব ভারত এই সেদিনও ভেবেছে ইংরেজরা গেছে, তবে আমরা স্বাধীন হইনি। বাস্তবিক এই যে জাতীয় সংহতি রক্ষার স্বার্থে আমরা দিনরাত আউরাতে থাকি “বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য”। সে ঐক্যটা কিসে? খাদ্য, পোশাক, ভাষা, ধর্ম, যাপনের রীতি বা ভাবনার গীতি সবই তো বিবিধ। ইংরেজরা আসা আগে কেমন ছিল ভারত নামে ভূখন্ডটা? অশোকের বা আকবরের সাম্রাজ্য ছিল। কিন্তু ভারতবর্ষ? 

পুরাণ মিথ ঘেঁটে ভারতবর্ষ নামের ঐতিহ্য খুঁজে বের করা সম্ভব। কিন্তু তার এলাকা সনাক্তকরণ? দেশের বাড়ি বলতে যে আবেগ মানুষের উঠে আসে মাটি মেশা জীবনের মত, দেশ কে কি আমরা সত্যি সেভাবে চিনি? আমরা কি জানি তামিল বা তেলেগু ভাষায় কি লেখা হচ্ছে ইদানিং? কেমন খাদ্যাভ্যাস মিজোরাম বা মনিপুরের? মুম্বাই বা শ্রীনগরে কোন বন্ধু আছে আমার? আধিপত্যমূলক আগ্রাসন ছাড়া সত্যি কি আমাদের মধ্যে আছে কোন সখ্যতার সম্পর্ক? নেই বলেই কি একটা গান একটা পতাকা কোন কোন মুখের ছবি দিয়ে জাগাতে হয় দেশপ্রেমকে? দেশের কি কোনও নিরাকার উপাসনা সম্ভব? আর এ যুগে তো পাল্টেই গেছে স্বদেশ, স্বজন, স্বকাল এর সংজ্ঞা। 

আমার কোনও দেশের বাড়ির আবেগ নেই, আমি সারাজীবন হোস্টেলে বড় হয়েছি। আমার বন্ধুরও নেই। বাবার চাকরির সূত্রে সে ঘুরে ঘুরে বড় হয়েছে নানা শহরে। আমার বোন আজ পনেরো বছর কানাডার নাগরিক। আমার প্রতিবেশী জার্মানী-জাত মানুষটি প্রায় ত্রিশ বছর এদেশে। এদের উত্তরাধিকার, তাদের স্বাধীনতা দিবস, নির্ধারণ করবে কোন রাষ্ট্র? নাকি স্বাধীনতা দিবস আসলে রাষ্ট্রের জন্মদিন? ব্যক্তির জীবনে তার তত মূল্য নেই! সে একটা গোষ্ঠীগত উৎসব। আর সে গোষ্ঠীর অন্তরঙ্গতার যোগে জোর নেই বলেই শত্রু খাড়া করে সংঘবদ্ধ হতে হয়। শত্রুকে হটানোর দিন, হারানোর দিন আমার গোষ্ঠীর জন্মদিন, আমাদের স্বাধীনতা দিবস!

সে শত্রু বাইরে হোক বা ঘরে। তাই ব্যক্তিসত্তাকে নসাৎ করেই স্বাধীনতা উদযাপন। তোমাকে যোগ দিতেই হবে, যেহেতু তুমি এ দেশের নাগরিক। স্বাধীনতা যদি হয় স্ব-অধীনতা, তবে তো স্ব-কে সনাক্ত করা জরুরী। “যদি তুমি ফসল ফলাতে না জানো/ যদি তুমি বৃষ্টি আনার মন্ত্র ভুলে যাও/ তোমার স্বদেশ তাহলে মরুভূমি।/” মত্ততার দিনে এই সব আত্ম-বিস্ফারণের কথা কেমন অন্তর্ঘাত বলে মনে হয়। হয়তো এইজন্যই আথেন্সের এক দার্শনিক অনেক ভেবে কবিদের নির্বাসন দিয়েছিলেন। কবিতা ব্যক্তির অনুভব প্রকাশের স্বাধীনতা। সেখানে সব দিনই স্বাধীনতা দিবস।

Post a Comment

2 Comments

  1. বেশ তলিয়ে ভেবে লেখা হয়েছে , তড়িৎ দা । এরকম কথাগুলো ( Individualism ) আপনি আমাদের স্কুলজীবনেও বহুবার বলতেন !!! সাধু ! 😊

    ReplyDelete
  2. খুব জরুরী প্রয়োজন 'স্ব'কে চেনা, সুন্দর লেখা।
    রবি ঠাকুর তো 'শেষ সূর্য' ও 'পেল না উত্তর' বলে খালাস, বিশ্বমানবতার 'স্ব' বিশ্বাস করিয়েও।
    এতদিন শিক্ষকতার ভান করার পর, আজ একটা কথা মনে হয়,
    একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌম স্বাধীনতা, প্রত‍্যেক নাগরিকের স্বাধীনতা হয়ে ওঠার কঠিন কাজ সম্ভব হতে পারে যদি শৈশব থেকে প্রশ্ন করার স্বাধীনতা, ভুল করে করে নিজেকে চিনে নেবার স্বাধীনতা প্রতিটি স্ব পায়। সেটা কিছুতেই যাতে না হয়, রাষ্ট্রীয় শিক্ষা-ব‍্যবস্থার সেটাই যেন উদ্দেশ্য মনে হয়।
    ছোটদের আত্মনির্ভরতা গুরুজনের চিরকালের সমস্যা। বয়োগুরু, সংখ্যাগুরু, ক্ষ‍্যামতাগুরু সকলের‌ই।

    ReplyDelete