পাঠক্রম
সুমন গুণ
ঈষৎ পরাস্ত তুমি, এই মর্মে প্রচারিত, আর
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে টের পাচ্ছি কোথাও আবার
সহাস্য বাতাসা ছুঁড়ে সম্ভবত সময় কাটাও।
মধ্যযুগ শেষ হলে ছবি তুলে বন্ধুকে পাঠাও।
আমি, তবু, সুযোগসন্ধানী
ছাত্রের মুগ্ধতা নিয়ে তোমাকে নক্ষত্র বলে মানি।
মিছিলে ফেরাই ভাল
আবীর মুখোপাধ্যায়
তিন দফা ছাঁটাইয়ের পর লোক কম,
দূরে, বহুদূরে এক-আধজন।
সেন্ট্রাল এসির দৌলতে ফাঁকা ফাঁকা নিউজ ডেস্ক যেন মর্গ।
এরইমধ্যে এজেন্সির পাঠানো গতানুগতিক করোনা-রাফাল-চিন, নয়া শিক্ষানীতি, বচ্চনসাহেবের ট্যুইট!
আপাতত এই লাশকাটা ঘরে…,
এর বাইরে তেমন কোনও খবর নেই!
হঠাৎ মেঘ দেখলাম—
শহিদ মিনারের মাথায়
ভাবলাম, তাকে একটা টেলিফোন করি...
বলি, মিছিলে এসো মেয়ে।
ভাবতে ভাবতে প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট থেকে হাঁটছি।
হাতের সিগারেট পুড়ছে—,
ছাই-ভস্ম পঞ্জাবির হাতায়!
একসময় মনে হল,
মিছিলের সঙ্গে হাঁটছে আমার পা দুটো।
আড়চোখে দেখি,
ভিড়ের মধ্যে এ ওর হাতে গুঁজে দিচ্ছে জরুরি ইস্তেহার।
কানে কানে রটছে লাল-শপথ।
মুঠো ভর্তি একে অপরকে উপহার দিচ্ছে সোনালি ধান।
ট্রাফিক সিগন্যালে আধপোড়া সিগারেটটা ঠেসে দিই।
তারপর ছায়াময় রেড রোড পেরিয়ে যেতে যেতে
পকেট থেকে আনমনে
ফেলে দিই
অফিসের রিপোটার্স নোটবুক, কলম, বেতনের চেক।
ময়দানের এলোমেলো হাওয়ায় পাক খেয়ে উড়ছে
সকালের শৌখিন খবরের কাগজ, শুকনো ঘাসফুল, খড়-কুটো
মিছিলের লাল নিশানের দিকে তাকিয়ে এগোতে থাকি,
আর হাতের মধ্যে টের পাই নতুন ধানের গন্ধ!
তখনও একবগ্গা এগিয়ে চলেছে মিছিল।
মাঠ-বন্দর— থেকে মিছিল এসে থামছে শহিদ মিনারের নীচে।
ভিড়ের হাতের মুঠো থেকে ধানের সুবাস ছড়িয়ে পড়ছে আবার সারা শহর।
চারিদিকে জলা-জঙ্গল। বন-বাদাড়। পাখিদের কলরব।
ক্রমে একটি গ্রাম জেগে উঠছে মাটির গহনে।
ক্রংক্রিটের কলকাতা সরে গিয়ে জেগে উঠছে আদিগন্ত গাঁ-ঘর!
ভাবলাম তাকে একটা টেলিফোন করি...
বলি, শহিদ মিনারের মাথায় আকাশ এখন লাল
বলা হয় না!
বেজে বেজে একসময় থেমে যায় টেলিফোন।
সারা দুপুর হাঁটতে থাকি প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিটে,— সারা দুপুর।
আর ভাবি, এরচেয়ে মিছিলে ফেরাই ভাল!
দেশ
সুপ্রভাত মুখোপাধ্যায়
কত মানুষের কাছে আমার যে কত কত ঋণ
মাটিই বুঝিয়ে দেন খাঁটি যার মৃন্ময়ী দিন
সামনেই অস্থির রাত্রি— আমার ভারতবর্ষ জানে
নিভে যাওয়া থেকে টিকে আছি— বহু বছরের গানে
প্রাণের নদীটি ক্লান্ত— কত যে ক্ষতের রক্ত চোখে
কতদিন তোলা বাজি, বোমাবাজি অমুকে তমুকে
সারাদিন খেটে মরছে কেউ কেউ কোথায় কে জানে!
কেউ কী বলছি না কিচ্ছু? টানাটানি করে যারা থাকি
কোথায় আমার মাটি রোমাঞ্চিত না-হাওয়ার শীতে
রক্তে-কাঁপা— শেষ করে দেওয়া থেকে আর আর কত দূর বাকি!
আমার যেদিন ভেসে গেছে
এলা বসু
এই ভাদ্রের রোদ ও পেল না শাড়িগুলো, পরতে পরতে ছাতা পড়ছে, বেনারসি কাঞ্জিভরমের অপমৃত্যুর জন্য কি মেয়েটি কাঁদতে বসবে?
গড়িয়াহাট মোড়ের মনিহারি দোকানগুলোর হাতছানিতে সাড়া দিতে গিয়ে, মানিব্যাগ দেখে হিসেব করেছিল মার অসুখের খরচ। তখন হিসেব মতন তার ভরপুর যৌবনের দিন।
কেটেছে একেলা বিরহের দিন হাসপাতালের করিডোরে, ডাক্তারের চেম্বারে। মার আয়ু নিয়ে সেকি ঘোর দরাদরি! এক হাতে প্রেসক্রিপশন, আরেক হাতে শৈশবের পোস্টমর্টেমের রেখাচিত্র।
উড়ন্ত ঘুড়ির ঠুনকো ঠোক্করের মতন আয়না, লাল শাড়ি, মৃদু সম্ভাবনা ঠোঁট রাঙ্গিয়ে যেত কালেভদ্রে। রাত জাগা বিপর্যস্ত ফোলা ফাঁপা চোখের কালি আর সামুদ্রিক বিষণ্ণতায় কৌতুকের হাসি খেলে যেত কলিগদের বঙ্কিম ওষ্ঠে। স্বাগত কৃপণ একচোখো জীবন! কেটেছে কতই পথ একেলা একেলা…
এখনও রোদ ওঠে, দৃশ্য বদল হয়। শাড়ি আছে, ঘর নেই, ছাদ নেই, মেলব কোথায়? মা নেই, চাকরি নেই, টাকা জমানোর দুশ্চিন্তা নেই, মনিহারি দোকানের পাশ দিয়ে গেলে মায়া লাগে, আর কত যুগ ওরা চকচকে হার চুড়ির পাশে বসে বসে ডাক দিতে থাকবে? ওদের বিরহ নেই? বোঝে না ওরা কোলাহলে একলা চলার চিহ্ন?
সরযূ
মৌমন মিত্র
শীতের বেলায় আগুন পোহাইনি
এমনকী বৈঠকখানার অগ্নিকুন্ড ছুঁইনি!
পুড়বো ব’লে
আগুন এক প্রত্যয়। তাতে পোড়ে অযোধ্যার সরযূ- ও!
কোথাও বিছানার বা-পাশে মেঘ জমেছে
কোথাও তার ডান পাশে মস্ত উলঙ্গগিরিপথ
সে পথ বেয়ে—
প্রশ্ন করলে, ‘কষ্ট হয়েছে?’
হয়েছে। শেষকালীন থামতে চেয়ে
খেয়াল-বেখায়ালের শ্রাবণপূর্ণিমায়
কে যে এখন কষ্ট দেয়! প্রেম না প্রকৃতি?
কোথাও দাবানলে পুড়ছে প্রেম
কোথাও প্রেম পুড়ছে দেহদাহে
ভোরে ঝড় উঠেছে থাকবে রাত অবধি
মাঝে যে কাল বয়
কে বুঝবে আরেকবার! সে বোধ না শক্তি ?
কোথাও বোধ অরণ্যকে ডাক দিয়েছে
কোথাও অরণ্য শক্তির কাছে নত
কোথায় যাব! পুড়তে হলে কোথায় যাব
মহামারির শেষে খিদের কাছে
না মহামারিতেই শেষ খিদেকে পাব?
মড়কাগ্নির শিখায় কান্না চাপা থাকে
সে-কান্নার নাগাল পাও যদি
তোমায় আমি মাটির থালায় ভাত বেড়ে দেব
এলানো কদলীবৃক্ষতলে
আমার কষ্টের যুক্তি ভাবতে যেও না। সেই পুড়বে ...
বুক-যন্ত্রণা তার যুক্তিপূর্ণতায় যুক্তিবিহীন থাকে
অনেক সয়েছি নিজের স্খলন
প্রেমের বদলে বিতৃষ্ণাজ্বলন
তাই নব্য সূর্যোদয়ের আগুনে
শাসকবাহীধর্মান্ধতা ছুঁয়ে
আজ ধ্বংসের সরযূ ফিতনা!
তুমি-আমি ভেঙে গেছি অনেক আগেই
জন্ম বলে গেছে
ভগ্নভূমিতে প্রেম ও ঈশ্বর নির্মাণ হয় না
2 Comments
কবিতাগুলো খুব ভালো লাগলো
ReplyDeleteভালো লাগলো।
ReplyDelete