ব্লগ : হ্যালো হান্ড্রেড/ ৬ । আই এস আই এজেন্ট

আই এস আই এজেন্ট

দ্যুতিমান ভট্টাচার্য


ত্তর দশকের শেষের দিকে ভারত-পাক সম্পর্ক হঠাৎ তলানিতে। সীমান্তে বারুদের গন্ধ। সাঁজোয়া গাড়ির যাওয়া আসা। বোমারু বিমানগুলির বল বিয়ারিং-এ তেল। যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব।

হরিহর পান্ডে জানেন, এ যুদ্ধ হবার নয়। ইসলামাবাদ বিমানবন্দরের বাইরে এসে লাগেজ নিয়ে দাঁড়ালেন ১৯৬৯ ব্যাচের ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস অফিসার। ব্রাজিল, জাপান, বেলজিয়াম, জার্মানির পরে পাকিস্তান। রুটিন ট্রান্সফার। তবে একটু সিনিয়র না হলে ‘প্রতিবেশী’ দেশে পোস্টিং হয় না। কূটনীতির মারপ্যাঁচ ধারালো হয় বয়সের সঙ্গে সঙ্গে। সেটাই এখানে জরুরি। 

অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশে কাজ করা একটু আলাদা। মাঝে মাঝেই খবরে প্রকাশ— গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে ভারতে কর্মরত পাকিস্তান রাষ্ট্রদূতের দুই কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠানো হল। তাঁরা ভিসা বিভাগে কাজ করতেন। 

এরপর থেকেই পাকিস্তানে অবস্থিত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের অফিসে কর্মরত কর্মীদের হেনস্থা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের কর্মীদের ওপর পাকিস্তান কড়া নজরদারী চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ। 

দু’দেশই পরস্পরকে একাধিকবার হূঁশিয়ারি দেয়। আবার কিছুদিন শান্ত হয়। স্থিতাবস্থা। তারপর আবার।

এই তো কয়েকদিন আগেই খবরের শিরোনাম। ইসলামাবাদে কর্মরত ভারতীয় দূতাবাসের দুই কর্মী সকাল আটটা থেকেই নিখোঁজ। গন্তব্যে যাওয়ার পথেই তাঁরা নিখোঁজ হয়ে যায় বলে অভিযোগ। পাকিস্তান সরকারের কাছে অভিযোগও নথিভুক্ত করেছিল ভারত। তবে পাক প্রশাসনের কাছ থেকে তেমন কোনও সদুত্তোর পাওয়া যায়নি বলেই সূত্রের খবর। পরে সূত্র মারফত জানা যায় নিখোঁজ ভারতীয় দূতাবাসের দুই কর্মী পাকিস্তান ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স অর্থাৎ আইএসআই-এর হেফাজতে রয়েছে। তবে পাক সরকার এখনও সেকথা স্বীকার করেনি।

সাধারণত কয়েকদিন পরেই এদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সবাই আবার ভুলে যায়।

আমাদের দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধটা আসলে স্নায়ুর। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক সরাসরি ছিন্ন করা যায় না। মাঝে মাঝে দিল্লিতে নিযুক্ত পাকিস্তানের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তলব করে দূতাবাসের ৫০ শতাংশ কর্মীকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়, তেমনই ইসলামাবাদে ভারতীয় দূতাবাস থেকে ৫০ শতাংশ আধিকারিক-কর্মীকে দেশে ফেরানো হয়। এমনটা চলতেই থাকে।

ইসলামাবাদের রামনা ৫ ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভের কোয়ার্টারের সামনে নামিয়ে দিল দূতাবাসের বিদেশী মার্সেডিজ গাড়ি। কাছেই কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে জিন্নাহ নদ। কিছুদূর গিয়ে তা মিশেছে রাওয়াল হ্রদে। ফারনিশড্‌ আবাসন বরাদ্দ হাই কমিশনে। রাঁধুনি, খানসামা, ড্রাইভার। ঘরে ঘরে এয়ারকুলার। ইসলামাবাদে গ্রীষ্মের লু সহ্য করা দায়। কাজে যোগ দিয়ে মশগুল হয়ে গেলেন পান্ডে। এখানে কাজের চাপ বেশি। অন্যান্য দেশের দূতাবাসে ভিসা ছাড়া খুব একটা কাজ নেই। এখানে কূটনীতি করতে হয় বেশি। মাঝেমাঝেই তলব করে বিদেশ মন্ত্রক। নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয় দিল্লীর নর্থ ব্লকের সঙ্গেও।

ভোরে ওঠা অভ্যাস পান্ডের। হাঁটতে বেরোন সুগার কন্ট্রোলে রাখার জন্য। বেলায় অফিস। বিকেলে বাজার হাট বা সরকারি কাজে বেরোনো। কিছুদিন যাবৎ একটা খটকা লাগে। কে যেন তাঁকে ছায়ার মতো ফলো করছে। সারাদিন। দেখতে পান না। অনুভব করেন। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। মনে মনে ‘যাক গে, মরুক গে’ বললেও মনে একটা অস্বস্তি রয়েই যায়। মাসখানেক বাদে গ্রীষ্মের ছুটিতে পরিবারকে ইসলামাবাদে আনান তিনি। মাসখানেক থাকবে স্ত্রী রাধিকা ও দুই পুত্র ঈশান ও আয়ুষ্মান। একজন ক্লাস নাইন, আরেকজন সিক্স। বড়টা সাধাসিধে, ছোটটা চালাক। 

ছোটটাই আবিষ্কার করল অস্বস্তির কারণ। একদিন বাপ-ব্যাটাদ্বয়ে সন্ধেবেলা রোদ পড়ে যাওয়ার পরে বেড়াতে গেছে রাওয়াল হ্রদের ধারে পার্কে। সাড়ে আট বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে কৃত্রিম হ্রদটি রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদ শহরকে জল সরবরাহ করে। কোরাং ও আরো কয়েকটি ছোট ছোট নদী অদূরের মারগাল্লা পাহাড় থেকে জল নিয়ে এসে এতে মেশে। এর চারপাশে সবুজ বনানী। মনোরম। পাকিস্তানের ধূসর ভূপ্রকৃতির মধ্যে এক মরুদ্যান যেন। রুই, কাতলা, মৃগেল ঘাই মারে প্রতিনিয়ত। বোটিং চলে অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগে পর্যন্ত। পরিযায়ী বালিহাঁস এড়িয়ে চলে হইহই করা পিকনিক পার্টিদের।

সন্ধেবেলা বাসায় ফেরা পাখিদের কলতানে মুখরিত থাকে হ্রদের চারপাশ। বেশ মগ্ন হয়ে সেসব দেখছিল পান্ডে আর ঈশান। মগ্নতা ভাঙল আয়ুষ্মানের কথায়।

“পাপা, আজ আপকা জেমস বন্ড দিখাই নেহি দে রহা।’’

“কৌন জেমস বন্ড, বেটা?” শুধায় পান্ডে। 

‘‘যে সারাক্ষণ আপনার পিছু করে। দোকানে গেলেও দেখি বন্ড আঙ্কল, বাজারে গেলেও। একদিন তো আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতে হেসেছিল।’’

পান্ডে কিংকর্তব্যবিমূঢ়! 

পরদিন সকালে জেমস বন্ডকে দেখিয়ে দিল আয়ুষ্মান। জানালার আড়ালে দাঁড়িয়ে পর্দা আলতো করে সরিয়ে বাবাকে ডাকল সে। আঙুল দিয়ে ইশারায় দেখালো তাঁকে।

সদর রাস্তার ওধারে একটা পুরনো রঙচটা ভেস্পা স্কুটার স্ট্যান্ড করা। তার পাশে, গুলমোহর গাছের ছায়ায় রুমাল দিয়ে ঘাম মুছছে ভারী চেহারার এক মাঝবয়সি ভদ্রলোক। আর, মাঝে মাঝে এদিক পানে তাকাচ্ছে। মাথার ফেজ টুপি খুলে টাকের ঘামও মুছছেন। এ হেন জেমস বন্ডকে দেখে হাসি পেল পান্ডের। গাড়ি বের করার হুকুম দিয়ে আয়ুষ্মানকে বললেন, চল বেটা, একটু ঘুরে আসি।

মার্সিডিজের সঙ্গে কি পুরনো ভেস্পা পাল্লা দিতে পারে। তাও আবার ডিপ্লোমেটিক এনক্লেভের ঝাঁ-চকচকে রাস্তায়? ড্রাইভার স্পিড তুলতেই কম্ম সাবাড়। খুটুর খুটুর করে আসা স্কুটারটি রিয়ার ভিউ মিরর থেকে গায়েব। একটু এদিক সেদিক ঘুরে বাড়ি ফিরলেন পান্ডেরা। জানালার আড়ালে ঘাপটি মেরে রাস্তায় নজর। বেশ কিছুক্ষণ পরে জেমস বন্ড এসে উপস্থিত। ঘর্মাক্ত কলেবরে। পাঠানি স্যুট ভিজে সপসপে। হাঁসফাঁস অবস্থা। ইতিউতি চাহনি। 

এরপর থেকে বেশ মজাদার খেলা হয়ে উঠল এটা। কখনও গাড়ির গতি বাড়িয়ে, কখনও খুব স্লো করে বেচারাকে বোকা বানানো। মোটাসোটা লোকটা বুঝি একটু রোগা হয়ে গেল এই খেলায়। পার্কে বা বাজারে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছু করা জেমস বন্ডের দিকে এগিয়ে যাওয়া। বেচারা কোথায় লুকোবে দিশা পায় না। এভাবে মাস ছয়েক কেটে গেছে। পরিবার দেশে ফিরে গেছে পান্ডের। কাজের মধ্যে ডুবে গেছে সে। একদিন সন্ধেতে অফিসের কাজ নিয়ে কোয়ার্টারে। ফাইলে ডুবে ছিল পান্ডে। হঠাৎ কলিং বেলের আওয়াজে চমকে উঠল সে। হাত ঘড়ির দিকে চোখ চলে গেল। রাত সাড়ে আটটা। এ সময়ে সচরাচর কেউ আসে না। রাঁধুনিও রান্না শেষ করে গেছে বাজারে। রাত ন’টা নাগাদ ফিরবে।

উঠে গিয়ে দরজা খুলে চক্ষু চড়কগাছ পান্ডের। জেমস বন্ড স্বয়ং। করজোড়ে।

“জনাব, ম্যায় আপকা ফলোয়ার বেহরোজ আফ্রিদি।’’

“বোলিয়ে।’’

অবাক হওয়ার তখনও বাকি ছিল পোড়খাওয়া পান্ডের। বেহরোজ গত ছমাস ধরে পান্ডেকে ফলো করছে। রোজ সকাল থেকে সন্ধে ডিউটি। কখনও পান্ডে রাতে কোনও পার্টি বা সিনেমায় গেলে তার কাজের সময়কাল যায় বেড়ে। কিছু করার নেই। ডিপার্টমেন্টে লোকবল কম হওয়ায় তার বিকল্প কেউ নেই। অথচ সামনে ঈদ। আর, বেহরোজের স্ত্রী তৃতীয়বার সন্তানসম্ভবা। তাঁকে একবার বাড়ি যেতেই হবে। মাত্র ৮৫ কিমি দূরে। অ্যাটক্‌ শহরে।

“যান। কে বারণ করেছে?” তখনো পান্ডে বুঝতে পারেননি উত্তরটা কি হবে।

‘‘আজ্ঞে, হুজুর যদি কথা দেন যে ঈদের ছুটির তিনদিন কোয়ার্টার থেকে বেরোবেন না, তবেই ছুটিটা মনজুর হবে!’’

এমনটাই শর্ত দিয়েছে ওপরওয়ালা। সেই আর্জি নিয়ে খোদ নিজেই এসে উপস্থিত। জীবনে এতটা অবাক বোধহয় পান্ডে কোনওদিন হননি। এরকম অনুরোধ তিনি আগে কখনও রেখেছিলেন কিনা মনে নেই। ভবিষ্যতে ফের কভু রাখতে হবে কিনা জানেন না। 

ঈদ থেকে ফিরে এক কেজি রেওয়াজি খাসির মাংস দিয়ে গেল বেহরোজ। সেলাম জানিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো সেই গুলমোহর গাছটির তলায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে স্যুটের পকেট থেকে রুমাল বের করল সে। 


(লেখক একজন আইপিএস অফিসার ও গদ্যকার)



Post a Comment

2 Comments

  1. খুব মজাদার, সত্যি ঘটনা যদি হয়, তাহলে আফ্রিদির জন্য সমবেদনা। বেচারা! চাকরির কী জ্বালা যে চাকরি করে সেই বোঝে।

    ReplyDelete
  2. লেখক, সাহিত্য রসের স্বাদ চাই , কড়া চিড়চিড়ে মিষ্টি স্বাদ...। শুধু গল্প হলে মন ভরে না।

    ReplyDelete