লকডাউনের দিনলিপি : দমবন্ধ হয়ে আসছে, মুক্তি চাই

দমবন্ধ হয়ে আসছে, মুক্তি চাই

মালবিকা সেনগুপ্ত


১৩ মার্চ স্কুলের সভা। তখনও মনে হয় ওই সভাকক্ষের কেউই জানতেন না আমাদের সকলের ভবিষ্যত কোন্ অন্ধকারের পথে হাঁটতে শুরু করেছে। তারপরের দিন রবিবার। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশমতো দেশজুড়ে জনতা কার্ফু। সবাই ঘরে থাকবেন। তাহলে ভাইরাসের চেন ভেঙে যাবে। এবং আমরা ভাইরাসকে কব্জা করতে পারব। আমরা সবাই তাই করলাম। ভেবেছিলাম—, দেখো, আমেরিকা, ইতালি, স্পেন তোমরা যা পারলে না, আমরা ভারতীয়রা কেমন সহজেই করোনাকে জব্দ করলাম! নিজেদের জন্য বেশ গর্ব বোধ করছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি খুঁজে বের করেছিলাম।
কিন্তু না। সেই সোমবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ পেলাম, মিডিয়া মারফত। তাও আবার অনির্দিষ্টকালের জন্য, পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত। বুঝিনি, সত্যি বলছি বুঝিনি। এ পরবর্তী নির্দেশ যে অনির্দিষ্ট কালের গহ্বরে হারিয়ে যাবে– তা একদম বুঝিনি।
মার্চ মাসটা বেশ আনন্দে কাটিয়ে দিলাম। রোজ রোজ হাঁফাতে হাঁফাতে বেরোতে হচ্ছে না। রকমারি খাবার তৈরি করছি। ঘরের কোণা থেকে খুঁজে খুঁজে ধুলো বের করছি। নানারকম indoor games খেলছি। আধুনিক শব্দ, quality time অতিবাহিত করছি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। বেশ খুশি খুশি ভাব। মাঝে মাঝে বাজারেও যাচ্ছি। দিন গড়াতে লাগল।
এইসময় সোস্যাল মিডিয়াতে একটা ভিডিও পেলাম, ইতালি থেকে আমাদের কোনো বঙ্গসন্তান পোস্ট ‍করেছে। সে গৃহবন্দি। সে আতঙ্কিত, যতটা তার নিজের জন্য, বেশি তার দেশবাসীর জন্য। সে বলছে, জানতে পারছিলাম, চিনে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের কথা। কিন্তু তখন ভাবছিলাম, চিন তো অনেক দূর! তারপর শুনলাম উত্তর ইতালিতে সংক্রমণ হয়েছে। তখনও ভাবছিলাম, আমি তো থাকি দক্ষিণ ইতালিতে। এবং সেই বঙ্গসন্তান যখন ভিডিওটি পোস্ট করে তখন করোনা দক্ষিণ ইতালিতেও ঢুকে পড়েছে। এবং সে গৃহবন্দি। ঘরে বসে সে শুনছে অ্যাম্বুলেন্সের হূটার। সে আতঙ্কিত তার স্বদেশবাসীর জন্য। সে সাবধান করছে তার প্রিয় দেশবাসীকে। ঘরে থাকার জন্য, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার জন্য, নিয়মিত মাস্ক ব্যবহারের জন্য। সে ভয় পাচ্ছিল তার দেশে করোনা থাবা বসালে পারবে তো দেশবাসী নিজেদের রক্ষা করতে? সে জানে তার দেশে কোটি কোটি জনগণকে নূন্যতম পরিসেবা দেওয়ার পরিকাঠামো নেই। তাই বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল, ‘Prevention is better than cure’. কিন্তু আমরা কী করলাম! আমিও ভেবেছি করোনা অনেক দূরে। আমার কাছে আসতে পারবে না।
বেশ কিছু নতুন শব্দ শিখে ফেললাম। তার মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে আপত্তিকর শব্দ ‘পরিযায়ী’। এতো কাল পরিযায়ী পাখির কথা শুনে এসেছি। যারা সুদূর সাইবেরিয়া থেকে অনুকূল আবহাওয়ার খোঁজে শীতকালে আমাদের দেশে আসে। আমরা দল বেঁধে চিড়িয়াখানায় তাদের দেখতে যাই। বিশ্ব উষ্ণায়ন, তারপর বেশ কিছু মানুষের শিকারের নেশায় পরিযায়ী পাখিরা এখন বেশ সন্ত্রস্ত। তাই আমরা প্রকৃতিপ্রেমীরা আন্দোলন করেছি, পরিযায়ী পাখিদের নিরাপত্তার জন্য। আর এই পরিযায়ী শ্রমিকরা হয়ে গেল কেমন ব্রাত্য! তাদের জন্য বলার কেউ নেই। নিজ দেশে তারা এখন প্রবাসী! নিজের রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে গেছিল তারা কাজের খোঁজে। সে রাজ্যের নির্মাণ, উন্নয়ন সবটাই তাদের কাঁধে ভর দিয়ে হয়েছে। আর যেই লকডাউন, অমনি তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হল! আমরা কী একটু অন্যরকম ভাবে ভাবতে পারতাম না? তারাই নাকি করোনার সংক্রমণকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে অনু ঘটকের কাজ করেছে?
এর সঙ্গেই মনে পড়েছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের কথা। আমাদের জাতির মেরুদন্ড। মেরুদন্ড শক্ত না হলে তো ভবিষ্যতে আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারব না। লকডাউনে তো পড়াশোনা সব শিকেয় উঠেছে। তার মধ্যে পরবর্তী শ্রেণিতে উন্নয়ন যখন নির্ধারিত হয়েই গেছে। কিন্তু শিখতে তো হবে আগামী প্রজন্মকে, what is what? অতএব আধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে চালু হল অনলাইন ক্লাস। হ্যাঁ, লকডাউন আমাকে অনলাইনে কিভাবে পড়াতে হয় শিখিয়েছে। kinemaster-এ ভিডিও বানানো শিখিয়েছে। জানি না তা আমার প্রিয় শিক্ষার্থীদের পাঠে সহায়ক হয়েছে কি না!
ধীরে ধীরে স্কুল শিক্ষিকা থেকে সম্পূর্ণ গৃহবধূতে রুপান্তরিত হয়েছি। মাঝে মাঝে খুব হতাশ লাগছে। ভুলে গেছি স্টেশনে যাওয়ার রাস্তাটা কেমন! ভাবি রিকশা থেকে নেমে দৌড়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে লাফিয়ে ট্রেনে উঠতে পারব তো! এর মাঝে অনেক প্রিয়জনকে হারালাম! আমার এক সহকর্মী বলছিল করোনা নাকি পৃথিবীর জনভার ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেবে। সে বলছিল আমার কেউ নিশ্চয়ই সেই ৩০ শতাংশর মধ্যে থাকবে না—তাই না? আমরা সবাই তাই চাইছি।
বিশ্বজুড়ে গবেষণা চলছে। প্রতিদিন অপেক্ষা করছি, ‘ইউরেকা, ইউরেকা’ শব্দটা শোনার জন্য। হলিউডের সিনেমার সেই হিরোর জন্য অপেক্ষা করছি, যে পৃথিবীকে ত্রাসমুক্ত করবে। আমরা ছোটো হতে হতে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, রান্না করছি, সিনেমা দেখছি— সবই করছি, তবু কেমন যেন ছাড়া ছাড়া। মুক্তি চাই– দ্রুত মুক্তি চাই– এই দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে মুক্তি চাই!

Post a Comment

0 Comments