ব্লগ : স্বগতোক্তি/ ৯ । বিদ্বেষের ব্যবসায় শিকার বাঙালি

বিদ্বেষের ব্যবসায় শিকার বাঙালি

তড়িৎ রায় চৌধুরী

চ্ছা, মহেন্দ্র সিং ধোনি কে কি কেউ খোট্টা ভাবে? ছোটবেলায় ট্রেনে বেনারস বা হরিদ্বার যাবার সময় হঠাৎ-ই একদল মানুষ উঠতেন জায়গা দখলের নিয়ম যারা খুব মানতেন না। নেশা, পোশাক, চুলের ছাঁট সব মিলে অদ্ভুত নাম— খোট্টা কালচার। বিশ্ববিদ্যালয়ে বান্ধবী হল স্মিতা খাটুয়া। খাটুয়া! হ্যাঁ, খোট্টা বোলবি তো? না, তখন কিছুটা জ্ঞান গম্যি হয়েছে; তাই ভাবতাম গোটা বৌদ্ধ যুগের শিক্ষা-সংস্কৃতির পীঠস্থান যে ভুমিতে; মগধ বা নালন্দার সমৃদ্ধি কি করে এত হীনশব্দের শিকার হয়ে গেল বাঙালি সমাজে? 

খোট্টা তো আসলে একটা ভাষা— বাংলা ও মাগধীর মিশ্রণে জাত। বোকারো থেকে হাজারীবাগে যার বিস্তার। মালদহের দিকেও ছিল কিছুটা। হয়তো এভাবেই একটা দুটো চিহ্ন দেখে দেগে দিতে চাই পুরো জাতিসত্তাকে। সত্যিই কি একটা দুটো ভাত দেখে পুরো হাঁড়ির হাল হিসাব করা সঙ্গত? এই ভ্রান্তিবিলাসের নবীনতম উদাহরণ বাঙালি মেয়েদের কালাজাদু ওস্তাদ ক্রিমিনাল অভিধা। অথচ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ছাত্রীরা যেমন জানায় কিছুদিন আগেও বাঙালি সংস্কৃতিকে কিছুটা সম্ভ্রমের চোখেই দেখত অনেকে। হয়তো ঈর্ষা ছিল বাঙালি মেয়েদের তথাকথিত প্রগতিতে। কিন্তু হীন ষড়যন্ত্র ছিল না। ক্রমেই উত্তরভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্যবাদের সঙ্গে সংঘাত বেড়েছে বঙ্গজ নারীশক্তির— এটা কি তারই ফল?

একটি মৃত্যুতেকে কতটা দায়ী তা আমার বিচার্য নয়। বিচার ব্যবস্থা তা করবে। কিন্তু একজন বান্ধবীকে সামনে রেখে একটা জাতি বিদ্বেষ গড়ে তোলার প্রক্রিয়াটি মারাত্মক। যে রাজ্যে নির্বাচন আসন্ন তার ভাবাবেগকে উস্কানি দেওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু তার ফল? মনে পড়ে ইন্দিরা গান্ধী হত্যা ও পরবর্তী শিখ নিধন যজ্ঞের কথা। অথচ এই শিখদের কত বীরত্ব গাঁথাই না আমরা শুনেছি। সৈন্যবাহিনীতে রয়েছে পৃথক শিখ-রেজিমেন্ট। তবু একটা ঘটনায় জাতিগত ভাবে দোষী সাব্যস্ত হয়ে গেল তারা? বিদ্বেষের ব্যবসা কি করতে পারে আমরা তো দেখেছি গুজরাত দাঙ্গায়। গণনিষ্ক্রমণের ছবি জেগে আছে কাশ্মিরী পন্ডিত আর স্বাধীনতার সময় সীমান্ত পেরোনো মানুষের মনে। পৃথিবীর ইতিহাসে জাতিবিদ্বেষ ও জেনোসাইড তো শুধু নাৎসীদের কাজ নয় আসিরিয়ান, নাম্বিয়ান, কুর্দি, জিপসি, রোহিঙ্গা, ইসাক কত জাতি কত বার শিকার হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, বসনিয়া, তিব্বত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, শিহর-জাগানিয়া কত নাম! 


আসলে এ ক্ষমতার লড়াই। বাজার দখলের গল্প। কে না জানে বাঙালি শুধু মাছ না মাতৃকা শক্তিরও ভক্ত চিরকাল। কালী ও দুর্গার দাপট আর নরম সরম শিব বা রাম-ই তার ঐতিহ্য। সম্ভবত রাধিকা বাংলাদেশ থেকেই বৃন্দাবন পাড়ি দিয়েছিলেন পূজিতা হবার জন্য। এই তো সেদিন ছিল মনসা পুজো। তারপরেই এলো ভাদুর পালা। ষষ্ঠী, শীতলা, যোগদ্যা, চন্ডী, রংকিনী, বাশুলী, বড়াম নারী শক্তির প্রাচুর্য এদেশে প্রবল। হয়তো এ ছবি নানা রূপে গোটা উত্তর-পূর্ব জুড়েই। সেদিন জনজাতি দিবসের ওয়েবনারে গিয়ে মনে পড়ল ব্রাজিল, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, সাইবেরিয়া সর্বত্রই সভ্যতা গড়ে উঠেছে ভূমিপুত্রদের কংকালের উপর। এথনিক ক্লিনজিং এর সেরা দৃষ্টান্ত রেড ইন্ডিয়ানরা। আর আধুনিকতার নাম আমেরিকা। আসলে বৈচিত্র্য বিনাশই হয়ে দাঁড়িয়েছে সভ্যতার শখ। এক ছাঁচে ঢালাই কর সব। এক করে দাও সব খাদ্য-পোশাক-বাসস্থান। স্বাতন্ত্রপ্রিয় মানেই বিচ্ছিন্নতাবাদী। বৈচিত্র্য না প্রশাসকের পচ্ছন্দ, না পুঁজির। নানা রকম কাস্টমার সেট হলে কোন প্রোডাকশানই মাস স্কেলে করা যায় না। কি আশ্চর্য! মনসার প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রতিবন্ধকও চাঁদ বণিক। যতই তাকে আপনি অন্ধকার আর সাপের দেবী বলুন আসলে সে একক নারী। পিতা যার যত্ন নেননি, স্বামী দেননি সঙ্গ, এমনকি পু্ত্রের উপরও তার তেমন নির্ভরতা নেই। সে পুরুষ অভিভাবকহীন আত্মপ্রতিষ্ঠায় উন্মুখ এক নারী। আচ্ছা সর্পহত্যায় আমাদের কেমন এক নির্লজ্জ জান্তব উল্লাস আছে দেখেছেন? গুষ্ঠীসুখ। নিখুঁত তত্ত্ব ইতিহাস বলতে পারব না। তবে শাস্ত্রীয় ধারা ভেঙে যখন নিন্মবর্গের মানুষ সহজিয়া ধর্মদের জন্ম দিচ্ছিল কালাজাদুর প্রচলন সেই সময়েরই ফসল এমন একটা লোকায়ত ভাবনা আমাদের ব্যবহারিক সত্য। আমাদের উপাস্য বীর তার তীরের মুখে শাসন করতে চেয়েছিলেন নারী শুদ্র আর সমুদ্র(প্রকৃতি)-কে। তাই আপাত চোখে যা নিছক সহানুভূতি জাত ক্রোধ, তার শিকড় কত গভীরে ভাবতে ভয় হয়।

এ লেখায় মিশে আছে ঋতজা, সোমিয়া, পায়েল, দীধিতি, ক্যামে্লিয়া, কোহিনূর, সুব্রতদা, রাধামাধবদার মতো অনেকের ভাবনা। তাদের নমস্কার।



Post a Comment

2 Comments

  1. একে একে দুই করে মিলিয়ে দেওয়ার খেলাটা আপনি বেশ ভালোই করেন ।

    ReplyDelete
  2. সুচিন্তিত সম্বৃদ্ধ লিখন। শৈশব থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিতে, ক্লাসে ক্লাসে, সেকশনে সেকশনে, ছেলেতে মেয়েতে, প্রতিযোগিতার ছদ্মবেশে নানান বিদ্বেষের বীজ হয়তো অসচেতনতায় বপন করে ফেলি

    ReplyDelete