পান্থ/ ৫ । জলের উপত্যকা

জলের উপত্যকা 

অমৃতা ভট্টাচার্য

ডি
মাপুর ছাড়িয়ে চলেছি। আমাদের গন্তব্য কোহিমা। ধুলো ওড়ানো সড়ক আর বিচ্ছিন্ন কিছু জনপদ পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় এসে পড়লাম। ওই নীচে দেখা যাচ্ছে সবুজ ধানের ক্ষেত। ধাপে ধাপে চাষাবাদ আর শান্ত নির্জন ঘরবসতি। নাগাল্যাণ্ডের মানুষ ইতিহাস আর রাজনীতির গন্ধ মেখেছে বারবার। বিচ্ছিন্নতার গল্প শুনতে শুনতে ওরা মাটি আর মানুষকেই আরও নিবিড় করে আকড়ে ধরেছে তাই। কোহিমার বাজারে ঘুরে বেড়ালে শাক, ফল, লতা, গুল্ম আর প্রাণীজ খাদ্য খাবারের পসরা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। ওই নীচু রাস্তা ধরে উঠে আসছে যে মেয়েটি ওর গোলাপি গালে ঋজু, কঠিন এক সংগ্রামী জীবনের গন্ধ লেগে আছে। যত ওকে দেখি ততই ভাবি আমার গন্তব্য তো এই বাজার বা এই পর্যটকের জন্য সাজানো বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিফলক নয়! পাহাড়ি বন্ধুর পথ পেরিয়ে আমায় যেতে হবে জল জঙ্গলের উপত্যকায়। সেই উপত্যকার নাম জুকু। জুকু ভ্যালি। সবুজ রেশমি ঘাস আর বেঁটে বেঁটে বাঁশের জঙ্গল সেখানে। মানুষের বাস নেই। পরিযায়ী মেঘের দল সেখানে ফিরে ফিরে আসে। সবুজ গালচে পেতে জুকু বসে থাকে সারা বেলা। মেঘ মাখে আর বৃষ্টি মাখে। সোহাগী মানুষের প্রত্যাশী নয় সে। জুকুর পথ তাই খাড়াই, বন্ধুর। 
ভোর ভোর কোহিমার এক প্রান্ত তেখুবা থেকে রওনা দিলাম। আমাদের যেতে হবে বিসফেমায়। সেই যেখানে অপেক্ষা করছে আমাদের পথপ্রদর্শক বন্ধু নিকোলাস। তখন সবে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। বৃষ্টি ধোয়া গাছগাছালি আর সোনালী ধান সকালের আলো মাখছে অকাতরে। আমরা নিকোলাসের সঙ্গে আলাপ করছি, চা খাচ্ছি, হাত সেঁকে নিচ্ছি নরম রোদ্দুরে। এই গ্রাম থেকে আবার বন্ধুর চড়াই রাস্তা। সে পথে গাড়ি চলে কিছু দূর পর্যন্ত। এই ধরুন ঘণ্টা দেড়েক। তারপর আর গাড়ি চলে না। তখন কেবলই পায়ে চলা পথ। সে পথে চলেছে  আরও কয়েকজন। তারা কেউ কাঠ আনতে চলেছে, কেউ বা বাঁশের কোড়, কেউ বা চলেছে মধুর আশায়। ভাল্লুকের সঙ্গে তাদের দেখা হয়ে যায় কচ্বিৎ। কেউ ফিরে আসে কেউ বা আসে না। মানুষের এই শ্রম আর সাহসের সাক্ষী থাকে নিকোলাস। ওর গল্প ওর গ্রামের গল্প শুনতে শুনতে আমরা পথ চলি। পাহাড়ে উঠে সূর্যোদয় দেখার লোভ দেখায় নিকোলাস। বলে, একবার ধানকাটার মরশুমে চলে এসো আমাদের গ্রামে। থেকে যাও কদিন। লোভ লেগে যায়। হাসি ফিরিয়ে দিই তাই ওর কথার প্রত্যুত্তরে। নিকোলাস কিন্তু বুঝে ফেলেছে। বলছে, খানিক জিরিয়ে নাও। চড়াই রাস্তা শেষ। এবারে এই পাহাড়টা ডিঙোতে হবে যে! এখানে কোনও সিড়ি নেই। কেবলই ধাপে ধাপে পা দিয়ে পিচ্ছিল শ্যাওলা পড়া পাথর পেরিয়ে চলা। সবুজ মশ আর ফার্নের জঙ্গলে এক ধরণের বুনো গন্ধ জেগে আছে অহরহ। পা পিছলে যেতে পারে জেনে নিকোলাস হাত বাড়িয়ে দেয়। ওর হাত ধরে, গাছ ধরে চলতে থাকি। পাহাড়ের মাথায় যখন পৌঁছই তখন দেখি ওই নীচে মেঘের চাদরে ঢেকে আছে ফেলে আসা গ্রাম, নদী, উপত্যকা। সেই মায়াবী ইজেল পিছনে ফেলে এবার নামতে হবে জুকুর পথে। কিছুদূর নামলেই দেখা যায় সবুজ গালিচার প্রান্ত। তার গা ঘেঁষে তিরতিরে এক নদী চলেছে নিঃশব্দে। তার যেন জল বহনের কোনো দায় নেই। মানুষের সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার ক্লান্তি নেই তার। নিকোলাসের পূর্বপুরুষেরা এই উপত্যকায় কতবার ফিরে ফিরে এসেছেন। চাষাবাদের চেষ্টা করেছেন। ভেবেছেন এমন উপত্যকায় সোনালী ধানের ক্ষেতের পাশে বসে অলস দুপুরে ধেনো মদের নেশায় বিভোর হবেন। বাদ সেধেছে জুকু। প্রবীণেরা তাই বলেন এ হলো ‘অঙ্গামি’ অর্থাৎ শীতল জল। এই উপত্যকার শীতল জলস্রোত মানুষের ভূমিজ লাভক্ষতির হিসেব বুঝতে চায় না। ক্ষেতি বাড়ির লোভ তার নেই। মানুষেরা তাই ফিরে গেছে বার বার। একা একা পড়ে থেকেছে এই অনাবৃত বৃষ্টি ভেজা উপত্যকা। সবুজ চাদরে ঢাকা তরঙ্গায়িত ভূভাগ তাই সভ্যতার মলিনতা এড়িয়ে নিপাট নির্ভেজাল আজও। 


আমাদের পথ এতক্ষণে সরু হয়ে এসেছে আরও। হাত দিয়ে গাছ সরিয়ে সরিয়ে চলেছি। পাতাবাহার আর রঙিণ ফুলেদের এমন অগোছালো বিন্যাস দেখতে দেখতে কেবলই মনে হচ্ছিল, এমন একটা উপত্যকায় কেবল আমরা তিনজন। আর কেউ নেই। আমাদের জন্য একখানা আস্ত উপত্যকা এমন করে অপেক্ষা করে থাকবে কেই বা ভেবেছিল! ওই দূরে দেখা যাচ্ছে বেসক্যাম্প। ঠিক যেন মোম রঙে আঁকা একখানি বাড়ি। তার লাল টিনের ছাদ, সবুজ মাটি আর আস্ত নীল একটা আকাশ। পাকে পাকে গ্রন্থি যেন আর ফুরোয় না। কেবলই চলেছি আর চলেছি। এপথে মানুষের আনাগোনা আছে, মাটির গায়ে তার ছাপ। অন্য ধারে কিছু কালো পোড়া গাছেদের কঙ্কাল। কবে যেন দাবানলে সব পুড়ে গিয়েছিল। তারই ছাপটুকু রয়ে গেছে এমন শীতল জলের উপত্যকায়। পথের বাঁকে এবার ওই দেখা যাচ্ছে লাল টুকটুকে ছাদ। এতক্ষণে বৃষ্টি নেমেছে ঝমঝমিয়ে। বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাচ্ছে গাছ, শীর্ণকায়া নদী, বনাঞ্চল আর আমাদের নাগরিক ক্লান্তিটুকু। বেসক্যাম্পের বারান্দায় এতক্ষণে এলোমেলো বৃষ্টির ছাঁট ঢুকে পরেছে হুড়মুড়িয়ে। কাঁধের ঝোলা নামিয়ে আমরাও ঢুকে পড়লাম। গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির রেণু ভিজিয়ে দিচ্ছে আপাদমস্তক তবু এই কাঠের তক্তাপাতা বারান্দাখানি ছেড়ে আর উঠতে ইচ্ছে করছে না। চেনা পৃথিবী থেকে অনেক দূরে এসে পড়লে যেমনটা লাগে এ যেন তেমনই। এখানে মোবাইলের টাওয়ার নেই, পাখা নেই, ইচ্ছে মতো ফরমায়েশি পাঁউরুটি বিস্কুট নেই। আহা! এমন একটুকরো ভূখণ্ড পেরোব বলেই তো পৃথিবীর একপ্রান্তে এসে পৌঁছলাম। এখানে কেবল বসে থাকো সারাদিন। সবুজ গালচের মাঠ, স্বচ্ছতোয়া নদী আর এলিয়ে পড়া সাঁকো তোমায় ডেকে নেবে নির্ভার সময়ের অবসরে। 
তবু, সভ্য মানুষের ইঁটকাঠের জঙ্গলে ফেরার দায় থাকে কিছু। কাঠের উনোনে জ্বাল ঠেলে দিতে দিতে চা বানায় ছেলেদুটি। ওদের পোষ্য রোনাল্ডো গুটিশুটি শুয়ে থাকে একধারে। এই চা’টুকু খেয়ে এবার উঠতে হবে। ফেলে আসা পথেই ফিরতে হবে আবার। পিছনে পড়ে থাকবে শীতল জলের উপত্যকা। যার গালচেখানি সভ্যতার দাগ মুছে দিতে জানে আজও। 

Post a Comment

0 Comments