আনন্দপাঠশালা


বন্ধুদাদার চিঠি

মিঠি আজকাল কিছুতেই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে চায় না। মা যত টেনে টেনে তোলার চেষ্টা করেন, ও তত ঘাড় গুঁজে বালিশ আঁকড়ে পড়ে থাকে বিছানায়। বেশি বিরক্ত হলে দাঁত কিড়মিড় করে বলে, ‘আগে আমার স্কুলের গেটটা খুলে দিয়ে এসো। আমি তাহলে আর বিছানায় শুয়ে থাকবো না।’

মা এ কথার পর আর কিছু বলতে পারেন না। 

সত্যি বন্ধুরা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এভাবে স্কুলবিহীন জীবন তোমাদের যে আর সইছে না, আমরা বড়রা তা খুব ভালভাবে জানি। তবু আমরা নিরুপায় এই দুঃসময়ের কাছে। 

প্রকৃতি তার নিজের নিয়মেই চলেছে। বর্ষা পেরিয়ে শরতের আগমনবার্তা সে একটু একটু জানান দিচ্ছে। এ বছর সেভাবে দুর্গাপুজো হবে না তা তোমরা জেনে গেছ, তবু বলি ধৈর্য হারিয়ে ফেলো না বন্ধুরা। তোমাদের বন্ধুদাদা ও আরও অসংখ্য বন্ধু সঙ্গে আছে তোমাদেরই। 

গল্প লেখো। কবিতা লেখো। ছবি আঁকো। আমাদের সব পাঠাও তোমরা। আমরা প্রকাশ করবো। আমরা সবসময় চাই, তোমরা খুশি থাকো। 

অঙ্কন রায়


ইস্কুল নেই/ ৭

আমাদের বন্দিদশা কবে কাটবে

আদিত্রী ভান্ডারী

বর্তমান সময়ে আমার চারপাশে সবথেকে বড় সমস্যা হল করোনা ভাইরাস। দিন দিন এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে সে, যে আমরা ছোট থেকে বড় সবাই ঘরে বন্দি৷ আমি একজন স্কুলের ছাত্রী। আমিও অনেকদিন ধরে সেই মার্চ মাস থেকে ঘরে বন্দি হয়ে আছি  আমাদের শরীর ও অন্যের শরীর যাতে ভাল থাকে তার জন্য। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের স্কুলের দাদা দিদিরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে পড়াশোনা করাচ্ছেন কিন্তু স্কুলের মত সেই মজা আর নেই। দাদা দিদিদের কাছে বকা খাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলা সবকিছুর জন্যই আমার খুব মন খারাপ হয়৷ আমার যখন মন খারাপ হয়ে যায়, তখন মা আমাকে বলে, ‘যদি আমরা এভাবেই অকারণে ঘরের বাইরে না বেরোই, নিজের নিজের ঘরে থাকি, তাহলে এই করোনা ভাইরাসের হাত থেকে আমরা বেঁচে যাব আর আবার কোনও একদিন সবাই মিলে একসঙ্গে মজা করতে পারবো। 

প্রথম শ্রেণি, পাঠভবন, বিশ্বভারতী


ছোটগল্প

ছায়ামূর্তি 

প্রকাশ কর্মকার 

(গত সংখ্যার পর)

সুরেশ ও জগন্নাথ মূর্তিটির পেছন পেছন যেতে  থাকল। সুদীর্ঘ একটা হল ঘরের মধ্যে তারা উপস্থিত হল। একটা দেয়ালের উপর এক সুদর্শন রাজার প্রতিকৃতি দেখতে পেল সুরেশ ও জগন্নাথ। 

ছায়ামূর্তি বলল...

‘এই প্রতিকৃতি আমার। এর পেছনে একটি বড় গর্ত আছে, যেখানে এক লোহার সিন্দুকের  মধ্যে উইলটি লুকানো আছে। এই উইল এর কথা নিশিকান্ত বার বার জিজ্ঞেস করলেও আমি তাকে বলিনি, বলিনি এই গুপ্ত কুঠুরির সন্ধান। নিশিকান্ত আমাকে এই কারণে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে থাকল। আমার স্ত্রীকেও খুব কষ্ট দিতে লাগল। অত্যাচারের কারণে আমার স্ত্রীর মাথা আবার খারাপ হয়ে গেল। একদিন আমার স্ত্রী বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু বরণ করল। আমি এই দৃশ্য দেখে আর ঠিক থাকতে পারলাম না। নিশিকান্ত ও নায়েব মশাইকে জমিদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললাম। কিন্তু তারা উল্টে আমাকে বেশি বাড়াবাড়ি করতে বারণ করল আর ভয় দেখাতে লাগল। একদিন সকাল বেলায় আমার খাবার গরম দুধের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে নিশিকান্ত ও নায়েব মশাই আমাকে মেরে ফেললো আর আমার দেহটি শিব মন্দিরের সামনে পুঁতে ফেলল। গ্রামবাসীদের তারা বলে বেড়াতে লাগলো আমি কোথায় চলে গেছি। আমায় খুঁজতে গ্রামবাসীরা পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করেছিল, কিন্তু পুলিশ কিছুই সন্ধান করে উঠতে পারেনি। আমার জমিদারির প্রজারা, নিশিকান্ত ও নায়েব মশাইয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। প্রজাদের উপর অত্যাচার দিন দিন বাড়তে লাগল। মরেও আমি শান্তি পেলাম না। আমার অতৃপ্ত আত্মা আজও জমিদার বাড়ির মায়া ত্যাগ করতে পারেনি।’

সুরেশ ও জগন্নাথ প্রতিকৃতির কাছে গিয়ে, প্রতিকৃতিটিকে সরিয়ে দেখলো এক গর্ত। গর্তের ভিতরে একটা সিন্ধুক দেখতে পেল। সিন্ধুক খুব কষ্টে নামাল দুজনে, কিন্তু অনেক দিন না দেখার কারণে মরচে পরে গেছে।  চাবিতেও মরচে ধরে গেছে। খুব কষ্টে সুরেশ একটা পাথর দিয়ে চাবিটি ভাঙল। চাবি ভেঙে একটা উইল, বেশ কিছু সোনার গয়না, কিছু সোনার বিস্কুট, রুপোর থালা বাটি, আরও কিছু জমিদারির দলিলপত্র বের হল। সুরেশ উইল পড়ে দেখল পাঁচশ বিঘা জমি পাঁচ মেয়ে ও স্ত্রীর নামে লেখা। 

ছায়ামূর্তিটি অনেকক্ষণ পরে বলল ‘দেখ এগুলো এতদিন আমি আগলে রেখেছিলাম, এখন তোমাদের উপর দায়িত্ব দিলাম এগুলো মেয়েদের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য। আর একটা কাজ করতে হবে তোমাদের সেটি হল, আমাকে হত্যা করেও নিশিকান্ত ও নায়েব মশাই প্রমাণের অভাবে এখনও শাস্তি পায়নি, তোমাদের কাজ হল ওদের পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়া, তাহলেই আমার আত্মা শান্তি পাবে।’

সুরেশ ও জগন্নাথ মাথা নাড়িয়ে সহমত পোষণ করলে ছায়ামূর্তিটি বলে ‘আমি জানতাম তোমরাই পারবে এটি করতে।’ 

সুরেশ ও জগন্নাথ যখন সুরঙ্গের ভিতর থেকে  বেরিয়ে এলো তখন সূর্য মাথার উপরে, মানে দুপুর গড়িয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে জগন্নাথ খাওয়া সেরে সুরেশের বাড়ি গেলো। আজ রাত্রে তারা পরিকল্পনা করতে থাকে কিভাবে কাজগুলো সম্পন্ন করবে। পরের দিন সকালে সুন্দরগড় পুলিশ স্টেশনে গিয়ে পুলিশকে সুরেশ ও জগন্নাথ সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে বললে পুলিশ প্রথমে বিশ্বাস না করলেও জমিদার কুমুদ কিঙ্কর মজুমদারের উধাও রহস্য উদ্ধার করার জন্য বড়বাবু পরেশবাবুর মন উৎসুক হয়ে উঠল। অনেক পুলিশ এলো গেল কেউ এর কিনারা করতে পারেনি। 

বড়বাবু পরেশ সিং খুব আগ্রহ নিয়ে সুরেশের কাছে সব শুনে বললো ‘আগামী কাল সকালে আমরা যাব সুন্দরগড়, তোমরা আমাদের সঙ্গে থেকো।’

পরের দিন সকালে দু’ ভ্যান পুলিশ নিয়ে পরেশ সিং, সুরেশ ও জগন্নাথকে নিয়ে পৌঁছলো সুন্দরগড় গ্রামে। এত সকালে পুলিশ দেখে গ্রামের লোক অবাক হয়ে গেল। জমিদার বাড়ির পেছনে শিব মন্দিরের সামনে একটি ছোট ঘর ছিল সেখানে গিয়ে সুরেশ বলল, ‘বড় বাবু এখানে খনন কাজ শুরু করুন এখানেই পাওয়া যাবে জমিদারবাবুর কঙ্কাল।’ বড়বাবুর নির্দেশে খনন কাজ শুরু হল। একটু খুঁড়তেই বেরিয়ে এলো একটা নরকঙ্কাল। পুলিশ এটিকে উদ্ধার করল। বড়বাবু গ্রামের লোকজনদের জিজ্ঞেস করল, ‘নিশিকান্ত ও নায়েব মশাই কোথায় থাকেন?’ গ্রামের লোকেরা বলল, ‘হুজুর একটু দূরে গ্রামের শেষ প্রান্তে কালী মন্দিরের পাশে।’ বড়বাবু  সুরেশ ও জগন্নাথকে নিয়ে নিশিকান্তর বাড়ি পৌঁছে জমিদারবাবুর সমন্ধে জিজ্ঞেস করলে নিশিকান্ত প্রথমে একটু ভয় পেয়ে যায়, পরে বলে ‘জমিদারবাবুর স্ত্রী মারা যাবার পর উনি যে কোথায় চলে গেলেন কিছু জানতেই পারলাম না। কত খোঁজ খবর নিয়েছি বহুদিন যাবৎ কিন্তু কিছুই উদ্ধার করতে পারিনি।’ এবার বড় বাবু একটু ভয় দেখিয়ে বলেন, ‘উনি চলে যাননি, ওঁকে হত্যা করা হয়েছে, আর সে কাজ করেছেন আপনি আর আপনার পিতা।’ নিশিকান্ত একটু সাহস করে বলে, ‘এর কোনও প্রমাণ আছে, যে ওঁকে আমরাই হত্যা করেছি?’ বড়বাবু বলেন, ‘আপনার বাবাকে ডাকুন বলছি।’

নিশিকান্ত তার বাবাকে পুলিসের কাছে ডাকলে পুলিশ, নিশিকান্ত ও তার বাবাকে গাড়িতে করে ঘটনাস্থলে নিয়ে গিয়ে খনন কার্যে উদ্ধার হাওয়া কঙ্কালটিকে দেখালে দু’জনই ভয় পেয়ে যায়। পুলিশ যখন বলে ‘এটি কার?’ নিশিকান্ত প্রথমে বলতে চায়নি। পরে পুলিশ ভয় দেখালে সব স্বীকার করে নেয়। বলে জমি জায়গার লোভে সে জমিদার মশাইকে বিষ দিয়ে খুন করে, খুন করে সে এই জায়গায় পুঁতে দেয়। আর গ্রামের লোকজনকে বলে যে জমিদার মশাই স্ত্রীর শোকে কোথাও চলে গেছেন। 

পুলিশ নিশিকান্ত ও নায়েব মশাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে চলে যায়। গ্রামের লোকেদের সাহায্যে জমিদার মশাইয়ের পাঁচ মেয়ের খোঁজ নিয়ে সুরেশ ও জগন্নাথ জমিদারির উইল তাদের হাতে তুলে দেয়। তার সঙ্গে সোনাদানা যা ছিল তা বিক্রি করে জমিদার মশাইয়ের একটি মূর্তি বানিয়ে গ্রামের প্রান্তে সেটি স্থাপন করে। জমিদার মশাইয়ের ইচ্ছে মত একটি হাসপাতাল বানিয়ে গ্রামের মানুষের উদ্দেশে তা উৎসর্গ করা হয়। সরকারের কাছে আবেদন জানানো হয় যাতে জমিদার বাড়ি ও তার লাগোয়া সুরঙ্গ পথ এবং ভূতলে অবস্থিত বিরাট রাজমহল সরকার অধিগ্রহণ করেন। কিছুদিনের মধ্যেই সরকার জমিদার বাড়ির সমস্ত অংশ অধিগ্রহণ করে তা জনগণের দেখার জন্য ট্যুরিস্ট স্পটে পরিণত করেন। চারিদিকে এই স্পটের নাম ছাড়িয়ে পরে। জমিদার বাড়ির সামনে এখন দেশ বিদেশ থেকে কত লোকের সমাগম। লোকের মুখে মুখে এই জমিদার বাড়ির নামের সঙ্গে সঙ্গে সুরেশ ও জগন্নাথের নামও প্রসিদ্ধ হয়ে যায়। সরকার থেকে পুরস্কার দেওয়া হয় সুরেশ ও জগন্নাথকে। 

সুরেশ ও জগন্নাথ ছায়ামূর্তির কথা মত সেই ভূষণদাগার মাঠে জঙ্গলের সেই জায়গায় এলে ছায়ামূর্তিটি তাদের বলে ‘আজ আমার আত্মা শান্তি পেল।’ জমিদারমশাইয়ের ছায়ামূর্তি এই কাজে সাহায্য করার জন্য সুরেশ ও জগন্নাথকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেয়। সুরেশ ও জগন্নাথের মন জমিদার মশাইয়ের জন্য ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। 

(শেষ)


কবিতা

ইচ্ছে

সত্যপ্রিয় রায় ।  ছবি : ইরাবতী রায়


আঁকিবুকি ক’রে খাতা

দিয়েছি আজ ভ’রে

মা দেখলে বকবে আবার

ডেকে তারার স্বরে।


ইঁট পাথরের খাঁচার ভিতর

বন্দী হয়ে আছি

পুকুরপাড়ের সবুজ মাঠে

ছুটে গেলেই বাঁচি।


জানলা খুলে বাইরে দেখি

চারদিকটা ফাঁকা

পুব আকাশের মেঘের কোলে

রংধনু রং আঁকা।


হতেম যদি মাগো, আমি

তোমার থেকে বড়

পারতে কি গো বলতে আমায়

সারাটি দিন পড়?



Post a Comment

0 Comments