ফিচার : বাঙ্গালান হো, শাতির হোগি



বাঙ্গালান হো, শাতির হোগি

কোহিনূর শেঠ

‘বাঙালি মেয়েরা ডাইনি।’ 
‘কালো জাদু করে পুরুষকে বশ করে রাখে।’
‘বিত্তশালী পুরুষদের হাতের পুতুল বানিয়ে রাখতে তারা পারদর্শী।’ 
না, আমি বলছি না। এগুলো বলছে সাম্প্রতিককালে গণমাধ্যমে ঝড় তোলা একটি ‘ট্রেন্ড’। অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর আঙুল উঠেছে তার প্রেমিকা রিয়া চক্রবর্তীর দিকে। রিয়া চক্রবর্তী, একজন বাঙালি। ঘটনার সূত্রপাত এখানেই। তারপর পর থেকেই বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলিতে শুরু হয়েছে বাঙালিদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারণ। পোস্টদাতাদের প্রধান লক্ষ্য মূলত বাঙালি মেয়েরা। কেউ বলছেন— ‘‘বেঙ্গল ইস আ ফা***ড আপ স্টেট। দ্য সোসাইটি দেয়ার ইস কমপ্লিটলি মেট্রিয়ারকাল। হাসবেন্ডস আর জাস্ট পাপেটস/ চাবিওয়ালা খিলাউনা। অল ডিসিশনস আর টেকেন আপ বাই উইমেন। এনিওয়ান হু ডিসএগ্রি?’’ আবার জনৈকা নেটিজেনের মন্তব্য— “স্টে সেফ মেন/বয়েস। বেঙ্গলি গার্লস আর ডমিনেটিং, দে নো হাউ টু মেক গাইস ফল ফর দেম ।” কেউ কেউ আবার বলছেন— “বেঙ্গলিস আর নাম্বার ওয়ান ইন উইচক্র্যাফট’’।
গণমাধ্যমকে খাপ পঞ্চায়েত করে তোলার এই প্রবণতা একেবারেই নতুন নয়। আর সেই বিচারসভা যদি নারীর বিরুদ্ধে বসে তবে তা সোনায় সোহাগা। একটি বিচারাধীন ঘটনার একজন অভিযুক্তের কারণে তার সমগ্র জাতিকে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করাটা যে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন রুচিশীল মানসিকতার পরিচয় বহন করে না তা বালক-বালিকা মাত্রেও ওয়াকিবহাল। কিন্তু বাঙালি মহিলাদের ডাইনি ও অর্থলোলুপ যারা বলছেন তাঁদের জ্ঞাতার্থে আজ কয়েক জন বাঙালি মহিয়সী নারীদের কথা বলতে চাই যারা নিজ পরিসরে অত্যন্ত সফল এবং সেই সাফল্য অর্জন করার জন্যে তাদের কোনও কালো জাদুর আশ্রয় নিতে হয়নি। 
ভারতবর্ষের প্রথম পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিদ্যায় পারদর্শী মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলি, আন্তর্জাতিক মহিলা ক্রিকেটে বিশ্বের প্রথমসারীর ফাস্ট বোলার ঝুলন গোস্বামী, সব্জি বিক্রি করে জমানো টাকায় দুঃস্থ মানুষের জন্যে হাসপাতাল তৈরি করে দেওয়া সুভাষিণী মিস্ত্রি, ভারতবর্ষের প্রথম মিস ইউনিভার্স সুস্মিতা সেন— এরা প্রত্যেকেই বাঙালি। স্বাধীনতা সংগ্রামী মাতঙ্গিনী হাজরা, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার; লেখিকা আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, লীলা মজুমদার; অভিনেতা সুচিত্রা সেন, অপর্ণা সেন, শর্মিলা ঠাকুর এরা প্রত্যেকে বাঙালি। নাম লিখতে শুরু করলে শেষ করা যাবে না। তাই শুধু বাংলা অথবা দেশ নয়— বিশ্বের নানা দেশে জনপ্রিয় যারা তাদের কথাই উল্লেখ করলাম।
বাঙালি মহিলারা যে নিজ গুণে সফল একথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু কেন এই ঘৃণা? বিশেষ করে বাঙালিদের প্রতি? বাঙালি নারীদের প্রতি? এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাটি বাঙালি বিদ্বেষের একটি খণ্ড চিত্র তুলে ধরেছে। কিন্তু আসল সমস্যাটি আরও অনেক গভীর এবং ঘৃণার এই ধারা বহুকাল ধরে অন্তসলিলা। বাঙালি জাতির মেয়েরা পড়াশোনা শেখে, চাকরী করে, সংসার করে বা করে না, নিজের মতামত প্রকাশ করে। নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করে, অনেক সময় বিয়ে না করেও সংসার করে। বাংলায় অনার কিলিং হয় না বললেই চলে। সমস্যা কি তবে এই? 


২০১৮ এর শেষ দিকে একটি চাকরির জন্যে ট্রেনিং নিতে হয়েছিল। ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটি রাজ্য থেকে অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। একজন আমাকে বলেছিলেন– ‘বাঙ্গালান হো, শাতির হোগি’।
হ্যাঁ, বাঙালি মেয়েরা বুদ্ধিমতী, শিক্ষিত। একটি জাতির নারী শিক্ষার হার যত বেশি হবে, সেই জাতির অগ্রগতির পথ ততই সুগম। বাঙালি মেয়েরা আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হলেও বাঙালি পুরুষদের কটাক্ষ করতে বাদ দিচ্ছেন না নেটিজেনদের একাংশ। বাঙালি পুরুষেরা মেরুদণ্ডহীন, নারী দ্বারা বশীভূত এবং পরিচালিত। তারা যথেষ্ট সুদর্শন ও গুণবান নন ইত্যাদি নানা ধরনের বিরুপ মন্তব্যের শিকার হতে হচ্ছে তাদের। চট করে মনে করিয়ে দিই– বাঙালির ঘরে তিনটি নোবেল, একটি অস্কার আছে। ভারতবর্ষের ক্রিকেট বোর্ডের বর্তমান সর্বেসর্বা একজন বাঙালি। আর বাঙালি পুরুষ সুদর্শন নয়? যাঁরা বলছেন— তাঁরা রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ বা উত্তমকুমারকে চেনেন না। বাঙালির মধ্যে রুচিবোধ ও শিক্ষা আছে বলেই এখনও পাল্টা আক্রমণ শ্লীলতার গণ্ডি অতিক্রম করেনি। 

Post a Comment

2 Comments