ব্লগ : হ্যালো হান্ড্রেড/ ৫ । অপারেশন মোজেস

অপারেশন মোজেস

দ্যুতিমান ভট্টাচার্য

২০
১৯-এর জুলাইতে একটি খবর শিরোনামে আসে। ইসরায়েলে ইথিওপিয়ান ইহুদি বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ৪৭ পুলিশ কর্মকর্তা আহত হয়েছে। পুলিশের গুলিতে এক ইথিওপিয়ান কিশোর নিহত হওয়ার ঘটনায় এ বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়। হাইফার কাছে কিরায়াত হাইম এলাকায় ১৯ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ ইহুদিকে গুলি করে হত্যা করে ইসরায়েলি পুলিশ। এ ঘটনায় দেশটির ইথিওপিয়ান ইহুদি গোষ্ঠীর বিক্ষোভে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। এরপর রাজধানী তেল আবিবসহ দেশজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়কের ১৫টি স্থানে অবস্থান নেয় বিক্ষোভকারী। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত হলে তাদের বাধা দেয় পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয় ৬০ জন বিক্ষোভকারীকে।
বিক্ষোভকারীদের দাবি, “গায়ের রং কালো হওয়ায় পুলিশ আমাদের লোকদের হত্যা করছে। যত দিন তারা এটি বন্ধ করবে না, আমরা এ বিক্ষোভ চালিয়ে যাব।”
‘ব্ল্যাক লাইভস্‌ ম্যাটার’? ইসরায়েলে! তাও ২০১৯-এ। যে দেশ সৃষ্টি হয়েছিল বৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের ওপর ঘটা অনাচারের বিরুদ্ধে। সে দেশেও বৈষম্যবাদ?
জানা প্রয়োজন, ইসরায়েলে ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি ইথিওপিয়ান ইহুদির বসবাস। যার মধ্যে ১৯৮৪ থেকে ৯১ সালের মধ্যে ৮০ হাজার অভিবাসী ইহুদিও রয়েছে। এরা এল কোথা থেকে? কিভাবে? 
ইথিওপিয়ায় বসবাসকারী ইহুদিদের ফ্লাসা ইহুদি বলা হয়। এদেরকে বানী ইসরাইলের প্রজন্ম বলে বিবেচনা করা হয়। তবে তাদের উৎপত্তি এবং তাদের পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে গবেষকগণ বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করেছেন। তারা নিজেদেরকে সাবা রানী বিলকিসের প্রজন্ম বলে মনে করে। ইথিওপিয়ার উত্তর-পশ্চিম দিকের হ্রদের কাছে এই গোষ্ঠীর বসবাসের স্থান। তাদের প্রধান কার্যকলাপ হচ্ছে কৃষি ও পশু খামার। ইথিওপিয়ায় গৃহযুদ্ধের ফলে সেখানকার ইহুদিরা প্রান হাতে করে সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসে সুদানে। 
ইথিওপিয়ার ইহুদিরা বেটা ইসরায়েল গোত্রের সদস্য, যাদের সত্যিকারের অতীত ইতিহাস এখনও অজানা। অনেকে মনে করেন, তারা প্রাচীন ইসরায়েলের তথাকথিত হারিয়ে যাওয়া ১০টি গোত্রের একটি। অথবা কুইন অব শেবা এবং কিং সলোমনের একজন পুত্রের বংশধর, যিনি ইথিওপিয়ায় ফিরে গিয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন, তারা ৫৮৬ খৃষ্টপূর্বাব্দে তখনকার জেরুসালেম এলাকা থেকে ইথিওপিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন। একসময় তারা সারা বিশ্বের ইহুদিদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন এবং তারা মনে করতেন, তারাই বিশ্বের একমাত্র জীবিত ইহুদি।
১৯৭৭ সালে মেনাচেম বেগিন ইসরায়েলের নির্বাচনে জেতেন। অনেকে এই জিতকে অস্বাভাবিক ভেবেছিল। প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি প্রথমেই মোসাদ কর্তা ইটজ্যাক হোফিকে ডেকে পাঠান। তিনি তাঁকে বলেন যে বহুকাল ইথিওপিয়ার ফালাশা ইহুদিদের কষ্ট তাঁকে পীড়া দিয়েছে। “আমি চাই, আপনি তাদের এদেশে আনার ব্যবস্থা করুন।’’ 
১৯৭৭ সালে ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচতে অন্য অনেক অ-ইহুদির সঙ্গে তাদের একজন সদস্য, ফ্রেরেডে আকলুম সীমান্ত অতিক্রম করে সুদানে আসেন এবং শরণার্থী সংস্থাগুলোর কাছে সহায়তা চেয়ে চিঠি লেখেন। এর একটি চিঠি মোসাদের হাতে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন বিশ্বাস করতেন, ইসরায়েল হল সব ইহুদির আশ্রয়কেন্দ্র। ফ্রেরেডে আকলুমের মাধ্যমে ইথিওপিয়ার ইহুদিদের কাছে বার্তা পাঠানো হয় যে, জেরুজালেমে যাওয়ার একটি ভাল উপায় রয়েছে। ফলে তাদের ২৭০০ বছরের পুরনো স্বপ্ন পূরণের সুযোগ তৈরি হল। এরপর প্রায় ১৪ হাজার বেটা ইসরায়েলি পায়ে হেটে ৮০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সুদানে আসেন। এই পথে আসতে গিয়ে অন্তত ১৫০০ মানুষ মারা যায়।
বছরের শেষাশেষি, ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর বোয়িং ৭০৭ সেনা সমেত উড়ে গেছিল ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায়। তবে মাত্র দুটো ফ্লাইটেই এই অপারেশন শেষ হয়ে যায়। মাত্র ১২৫ জন ইথিওপিয়ান ইহুদি ইসরায়েলে পৌঁছায়। কারণ তদানীন্তন বিদেশ মন্ত্রী মোশে দায়ান এই ব্যাপারে আন্তর্জাতিক স্তরে আলটপকা মন্তব্য করে ফেলেন। 
১৯৮১-তে আবার এই উদ্ধারকার্য শুরু হয়। এবার অনেক গোপনীয়তা নেওয়া হয়। এই ইথিওপিয়ান ইহুদিদের ইসরায়েলে নিয়ে আসতে হলে লোহিত সাগর পাড়ি দিতে হবে। এজন্য ইসরায়েলি নেভির সহায়তা চান মোসাদ এজেন্টরা। তারা সহায়তা করতে রাজি হন। এরপর মোসাদের কয়েকজন এজেন্ট লোহিত সাগরের তীরে গিয়ে একটি সুবিধামত জায়গা খুঁজে বের করেন। সুদানের মরুভূমিতে লোহিত সাগরের তীরের একটি ছোট্ট গ্রাম অ্যারোস। ছবির মতো। সেখানে একটি রিসর্ট গড়ে ওঠে রাতারাতি। সুদান সরকারের কাছ থেকে ব্যবসায়ীর একটি দল এই জায়গাটি লিজ নিয়ে রিসর্টটি গড়ে তোলে। ডাইভিং আর মরুভূমিতে আনন্দ করার নানা উপকরণ সমেত। তিন বছরের জন্য প্রায় সোয়া তিন লাখ ডলারের বিনিময়ে ভাড়া নেওয়া হয়। রিসর্টের বিজ্ঞাপনে সাগরের তীরে চমৎকার সাজানো সৈকতের পাশাপাশি যুগলের স্কুবা করার বা মাছ ধরার ছবি। লেখা রয়েছে, এখান থেকে স্বর্গের দেখা মেলে। ইউরোপের বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্টের মাধ্যমে এখানে বুকিং করা যায়। একই সঙ্গে একহাজার অতিথি এখানে বাস করতে পারেন ১৫টি বিলাসবহুল কটেজে। 
কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই আসলে সাজানো। এটি আসলে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একটি ফ্রন্ট বেস। সে সময় এই রিসর্টে কাজ করা একজন এজেন্ট গ্যাড শিমরন বলছেন, ‘‘এটি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় গোপন ব্যাপার, কেউ এ নিয়ে কথা বলতো না। এমনকি আমার পরিবারও এ বিষয়ে কিছু জানতো না।’’ সেখানে স্থানীয় ১৫ জন চালক, পাচক, ওয়েটার ইত্যাদি পদে চাকরি দেয়া হয়, যাদের বেতন নির্ধারিত করা হয়েছিল দ্বিগুণ। কিন্তু এই কর্মীরাও জানতো না রিসর্টের আসল পরিচয় বা তাদের ম্যানেজার একজন মোসাদ এজেন্ট। দিনের কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য কয়েকজন মহিলা এজেন্ট নিয়োগ করা হয়েছিল, যাতে কারও সন্দেহ তৈরি না হয়।
সুদানের শরণার্থী শিবির গুলোয় যে হাজার হাজার ইথিওপিয়ান ইহুদি আটকে পড়ে ছিল, তাদের উদ্ধার করে ইসরায়েলে নিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। রাতের বেলায় এজেন্টরা গিয়ে ইথিওপিয়ান ইহুদিদের ছোট ছোট দলকে এই রিসর্টে নিয়ে আসতো। ট্রাকে করে তাদের এই রিসর্টের উত্তর প্রান্তে নিয়ে আসার পর ইসরায়েলি নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী আর সিল সদস্যরা ছোট নৌকায় করে দেড় ঘণ্টা দূরের জাহাজে নিয়ে যেতো। সেখান থেকে লোহিত সাগরের মাঝ দিয়ে তাদের ইসরায়েলে পৌঁছে দেয়া হত।
১৯৮২ সালের মার্চে এই অভিযান ধরে ফেলে সুদানের সেনা সদস্যরা। তাদের সঙ্গে গোলাগুলিও হয়। কিন্তু কেউ হতাহত হয়নি। তারপর থেকে সাগর পাড়ি দেয়ার পরিকল্পনাটি স্থগিত করা হয়। তার বদলে মরুভূমির মাঝে একটি সুবিধাজনক বিমান অবতরণ ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে বলা হয় এজেন্টরদের।
এজেন্ট ড্যানি আর শিমরণ গেদারেফ্‌ অঞ্চলে তন্নতন্ন করে সেরকম জায়গার খোঁজ করে চলল। কিন্তু লম্বা লম্বা ভূট্টা ক্ষেত ছাড়া কিছুই পাওয়া গেল না। তাঁরা সেখান থেকে ৪০০ কিমি দূরে সিনকাট-এরকোউইট এলাকায় চলে গেল ঘুরতে ঘুরতে। এবং রাস্তার ধারেই একটা এলাকা দেখে তাঁরা তাজ্জব বনে গেল। রাস্তার ধারেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বানানো একটি ব্রিটিশ এয়ারফিল্ড। পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গল আর আগাছার ফাঁকে লুকিয়ে আছে এরকম অনেক রানওয়ে। এতদিনের পুরনো রানওয়ে তখনও অবিকৃত। ক্ষতহীন। কংক্রিটের ওপর চার দশক আগে চলা ব্রিটিশ রোডরোলার যেমনভাবে করে গেছিল। ঠিক তেমন রয়েছে। হাজার মিটার লম্বা। সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক চলছিল। বেটা ইসরায়েলিদের সংগ্রহ করা হল। 
১৯৮২র মে মাসের এক উষ্ণ রাত্রি। পুরনো রানওয়েতে হারিকেন জ্বালিয়ে দেওয়া হল। দুটো গাড়িতে ওয়াকিটকি দিয়ে রাস্তার দুদিকে ৫ কিমি দূরে পাঠিয়ে দেওয়া হল। নজর রাখতে। যদিও এই রাস্তায় সচরাচর গাড়ি চলে না, রাতে তো একেবারেই না। 
গভীর রাতে অপেক্ষা। আকাশের অনেক ওপর দিয়ে একটা বিমান উড়ে যাচ্ছে। কায়রো থেকে নাইরোবি। ডাইরেক্ট ফ্লাইট। হঠাৎ ওয়াকিটকিগুলো সচকিত হল। বিরাট হারকিউলিস বিমানের পাইলটের কথায়। বিমানটি রাডার এড়িয়ে লোহিত সাগরের ওপর দিয়ে খুব নিচু হয়ে উড়ে আসছে। পাইলটের চোখে নাইট ভিসন গগলস্‌। ড্যানিরা রাস্তার দুদিকের গাড়িগুলো থেকে একবার খবর নিল। তারপর একটা গাড়ি রানওয়ের সোজাসুজি দাঁড় করিয়ে হেডলাইট জ্বেলে দিল। পাইলট বলল সে রানওয়ে দেখতে পেয়েছে। 
বিমানটিতে কোনও আলো ছিল না। হেডলাইট না জ্বালিয়ে একটা মিশকালো বিশাল ছায়া হঠাৎ কোত্থেকে উড়ে এসে রানওয়েতে অবতরণ করল। ছোট রানওয়েতে নামার জন্য পাইলট রিভার্স ইঞ্জিন চালানোয় এক গগনভেদী শব্দ হল। আর, চারিদিক ধুলোয় ঢেকে গেল। এজেন্টদের হাততালি আর উচ্ছ্বাস এই আওয়াজে ধামাচাপা পড়ে গেল। 
পরিবহন বিমানটি থামলে পেছনের ডালা আস্তে আস্তে নেমে এল। সেখানে দেখা গেল ইসরায়েলি কমান্ডোদের। 
সমস্যা হলো অন্যজায়গায়। ইথিওপিয়ার ইহুদিদের অনেকেই জীবনে প্রথমবার বিমান দেখছে। তার ওপর রাতের অন্ধকারে এরকম একটা রহস্যজনক পরিস্থিতিতে। তাঁরা ভয়ে এদিক সেদিক দৌড় লাগালো। তাদের একত্রিত করাই দায় হল। অনেক কষ্টে তাদের তোলা হল কার্গো বিমানটিতে। মেঝেতে সবাই বসল জড়সড় হয়ে। বুকে কাঁপুনি। বিড়বিড় কন্ঠে প্রার্থনা। অনেক সময় লাগল সবাইকে তুলতে। ওঠার সময় এক কমান্ডো মোসাদ এজেন্টকে জিজ্ঞাসা করল, “ভায়া, এত আওয়াজ হচ্ছে, কেউ জেনে যাবে না তো?”
অভয় দিল এজেন্ট। “এটা আফ্রিকা হে। সুদান দেশটি জার্মানি, ব্রিটেন আর ফ্রান্সের এলাকার যোগফলের চেয়েও বেশি। আর, এখান থেকে সবচেয়ে কাছের গ্রামটি ১০ কিমি। সেখানে না আছে বিদ্যুৎ, না আছে টেলিফোন।’’
আবার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বিমান চলা শুরু করল। রানওয়ের দৌড় শেষে উড়ে গিয়ে অন্ধকার আকাশে মিলিয়ে গেল। ১৩০ জন ইথিওপিয়ান ইহুদি উদ্ধার করে।  
এরপরেও ওই রিসর্টটি পরিচালনা অব্যাহত রাখে মোসাদ এজেন্টরা। সেখানে বেড়াতে গেছে মিশরের সেনাবাহিনী, ব্রিটিশ এসএএস সৈন্যরা, সুদানি আর ব্রিটিশ কূটনীতিকরা— কিন্তু তাদের কেউ জানতো না এর পরিচালকদের আসল পরিচয়।
এরপর কিছুদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ আর বড় অংকের অর্থ লেনদেনের বিনিময়ে সুদানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জাফর নিমেইরি সরাসরি খার্তুম থেকেই ইহুদিদের ইউরোপে যাবার অনুমতি দেন। তারা ব্রাসেলস হয়ে ইসরায়েলে পৌঁছাতো। কিন্তু আরব বিশ্বের কেউ এ কথা জানতো না। তবে সুদান থেকে শরণার্থীদের বিমানে করে বের করে আনার এই খবরটি ১৯৮৫ সালের ৫ই জানুয়ারি বিশ্বের সংবাদপত্রগুলোয় প্রকাশিত হয়। এরপর সুদানিজ সরকার এই অভিযান বন্ধ করে দেয়।
১৯৮৫ সালের ৫ই এপ্রিল সুদানে সামরিক অভ্যুত্থানের পর রিসর্ট থেকে মোসাদ এজেন্টদের চলে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়। কারণ নতুন সামরিক সরকার এই রিসর্ট আর মোসাদ এজেন্টদের নিয়ে সন্দেহ করতে শুরু করেছিল। এক রাতেই ছজন এজেন্ট সেখান থেকে চলে আসে। তখনও রিসর্টে অনেক পর্যটক ছিলেন। কিন্তু তারা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন, স্থানীয় কর্মীরা রয়েছে, কিন্তু ডাইভিং ইন্সট্রাকটর, ম্যানেজার আর সবাই লাপাত্তা হয়ে গেছে!



Post a Comment

0 Comments