ছোটগল্প : মাস্কবিপ্লব


মাস্কবিপ্লব

আবীর মুখোপাধ্যায়



‘‘তোর জন্য সাদা কিনেছি। বৌমার লাল।’’
‘‘লাল!’’
‘‘ওমা! ও সাদা পড়বে নাকি— নতুন বউ! বাজারে এখন নানা রঙের পাওয়া যাচ্ছে। তোর বাবা প্রথমে অবশ্য সাদাই এনেছিল। আমি আপত্তি করাতে, আজ ওর জন্য পাল্টে লাল এনেছে— বর্ডারে সুতোর সেলাই— চমৎকার দেখতে। শোন, যেদিন আসবি, ওগুলো নিয়ে যাবি— তোর সাদা, বৌমার লাল।’’
টেলিফোন রেখে আকাশপাতাল ভাবছিল নিখিলেশ! ওর ইচ্ছে করছিল নিজের মাথাটা নিজেই দেওয়ালে ঠুঁকে দিতে। কিংবা বিল্ডিং থেকে ঝাঁপ দিতে! ভাবছিল লকডাউনে থাকতে থাকতে বাবা-মা-সবাই কি শেষে পাগল হয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে! দু’ মাস ধরে ও বাড়ি যাওয়া হয়নি। টেলিফোনেই রোজ চলছে একে-অপরকে সাবধান-পর্ব। গোটা দেশে ক্রমে বেড়েই চলেছে করোনা ভাইরাসের জেরে সংক্রমণ। কোভিড-১৯-এ আক্রান্তের সংখ্যা বুধবারই দেড় লক্ষ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ছ’হাজার ৫৬৬ জন। এখন মোট আক্রান্ত এক লক্ষ ৫৮ হাজার ৩৩৩ জন! গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ১৯৪ জনের। দেশে করোনায় মোট মৃত মোট চার হাজার ৫৩১ জন। এ রাজ্যে ২৮৯। তারপরও...! তারপরও লাল-সবুজ-গেরুয়া!
‘‘কিছু হয়েছে?’’
‘‘না— কি আর হবে! মা-বাবা তোমার জন্য লাল মাস্ক কিনেছে!’’
‘‘লাল!’’
‘‘তোমার নাকি সাদা পছন্দ নয়। সধবা মানুষ। তাই সাদা পাল্টে আজ লাল এল!’’
‘‘সাদা পাল্টে লাল কিনতে বাইরে গিয়েছিলেন উনিও?’’
‘‘সেই তো বলল। এরপর আর কি বলব বলো— অসহায় লাগছে।’’
‘‘তুমি জানো, এই লকডাউনে বিয়ের অলঙ্কার হিসাবেও জায়গা করে নিয়েছে মাস্ক। তবে সে অবশ্য লাল-সাদা কাপড়ের মাস্ক নয়, একেবারে খাঁটি রুপোর তৈরি!’’
‘‘কী বলছ!’’
‘‘এই তো সেদিনই কোনও একটা পোর্টালের ফিডে দেখলাম। লকডাউনের মধ্যেও বিয়ে সেরে ফেলছেন অনেকে। অবাক হওয়া ঢের বাকি এখনও— পড়লাম, বিয়ের পিঁড়িতে বসা বর-কনের মুখ নাকি ঢাকা থাকবে নকশা করা রুপোর মাস্কে।’’
‘‘একটু জল দেবে? গলা শুকিয়ে আসছে।’’
‘‘গরম জল দিই। চায়ের মতো একটু একটু করে খাও, ইমিউনিটি বাড়বে।’’
‘‘উফ্— এত নিয়ম মেনে কি বাঁচা যায়, বলো? করোনায় গলা শুকোয়নি বিমলা, তোমার মাস্ক-মস্করা শুনে আমার শরীর খারাপ করছে। আচ্ছা এইসব মানুষের কি নূন্যতম ‘বোধ’ বলে কিছু নেই?’’
‘‘শোনো, এই ‘নূন্যতম’ শব্দটি আবার এই বাজারে বেশ গোলমেলে— আসলে, এই দীর্ঘ চারদফা লকডাউনে থাকতে থাকতে আমরা সবাই কম-বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠছি। আর কতো? কেউ কেউ এসবের মাঝেই রিলিফ খুঁজছি নানা কিছু করে। আর একদল ব্যবসা ফাঁদছে জরুরী সামগ্রী নিয়ে। চাল, তেল, নুনের মতো এখন স্যানিটাইজার-মাস্কও তো নিত্য-সামগ্রী আমাদের— তাই না? অথচ দেখো, গোটা পৃথিবীতেই সেগুলো নিয়েও মাঠে নেমেছে আন্তর্জাতিক ব্রান্ড প্রাড্রা, গুচি, বুলগারি, ল্যুই ভিটন থেকে পাড়ার বান্টি-বাবলি-মা শিতলা বুটিক! এখানে বাটিক কিংবা তাঁতের মাস্ক হয়তো পাঁচশোর মধ্যে পাবে। গুচি, বুলগারি বিকোচ্ছে— সাড়ে পাঁচ থেকে দশ হাজারে!’’
‘‘লোকে কিনছেও!’’
‘‘কিনছেই তো। নইলে সাদা বদলে লাল আসবে কেন? খবর দেখলে মনে হয়— করোনা অসুখের বীজ নয়, এ দেশের হাওয়ায় লাল-সবুজ-গেরুয়া মাস্ক উড়ছে ঢের বেশি !’’
‘‘তুমি বরং একটু গরম জলই দাও। হামি গরীব আদমি আছি।’’
‘‘সেই!’’
নটখটি হেসে বিমলা কিচেনের দিকে গেল। নিখিলেশ ব্যলকনিতে চেয়ারটায় আরেকটু ছড়িয়ে বসল। মেঘ ছেয়ে আসছে। কালো হয়ে আসছে চারিধার। বৃষ্টি হবে আবার।


‘‘শুনছ? তুমি কি খুব ক্লান্ত?’’
‘‘কেন বলো তো?’’
‘‘দু’মাস পর বাড়ি গেলে। আর ফিরেই কেমন চুপ করে আছ। সকলে ভাল আছেন তো? রাস্তায় লোক কেমন? মায়ের সঙ্গে মাস্ক নিয়ে আর বকাবকি করোনি তো?’’
‘‘না, না সব ঠিকঠাক। তুমি কি যেন বলছিলে।’’
‘‘সন্দীপ ফোন করেছিল। ওরা দারুণ কাজ করছে।’’
‘‘কত দিতে হবে?’’
‘‘মানে?’’
‘‘মানে আমফান নইলে করোনা— কোনও একটার ফান্ড হবে। কত?’’
‘‘মাঝে মাঝে ভাবি, তুমি নিষ্ঠুর? নাকি উদাসীন?’’
‘‘ভেবো না। বরং কোনও একটায় বিশ্বাস করো। ঢের দেখলাম দুনিয়া। সত্যিই সাহায্য করতে হলে পথে নেমে করো।’’
‘‘সেটা তো সম্ভব না সবার পক্ষে। তাই বলে ঘরেও চুপটি করে বসে থাকব?’’
‘‘দেখো বিমলা, সাহায্যের নামে যা চলছে, সবটা আমার ভাল লাগছে না। কেউ কেউ বাড়াবাড়িই করছেন। করোনা-হানা থেকে বাঁচতে মাস্ক পরার কথা বার বার বলেছে আইসিএমআর। ‘হু’ তাদের পরিবর্তিত নির্দেশিকায় মাস্ক পরার নির্দেশ দিয়েছে। তারপর থেকেই পাড়ার টেলারকে দিয়ে কাপড়ের মাস্ক তৈরি করে শয়ে শয়ে বিলি করা হচ্ছে। এগুলো কি আদৌ ঠিকঠাক? তোমার মনে হয়? ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এই মাস্ক কতটা কার্যকর সে ব্যাপারে যথেষ্টই সংশয়ে আছেন ভাইরোলজিস্টরা। কোথাও কোথাও ত্রাণের নামে চলছে রাজনীতি। দূরত্ব-বিধি না মেনেই বেপরোয়া বিলি-বন্টন!’’
‘‘তবু পাশে থাকব।’’
‘‘থাক— নিষেধ করছি না। কিন্তু চার প্যাকেট মুড়ি-চিঁড়ে নিয়ে মহল্লায় ত্রাণের নামে পাঁচশো লোকের মধ্যে করোনা ছড়ানোকে আমি ভাল চোখে দেখছি না। ত্রাণ দিতে হলে স্বাস্থ্য-বিধি মেনে হোক। সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে হোক। এভাবে আলাদা আলাদা করে একটি করে ব্যানার ঝুলিয়ে, ফেসবুকে ছবি ট্যাগিয়ে ত্রাণ হয় না। ব্যক্তি-সংস্থার প্রচার হয়।’’
‘‘শোনো নিখিলেশ— তোমার মতো আমি ফেসবুকে লাইকের কাঙাল নই— যে একটি পোস্ট দিয়ে সতেরোবার প্রোফাইল চেক করব! আর কারা লাইক করে? সেই তো কিছু মামনি টাইপের বুড়ি নয়তো ন্যাকা ন্যাকা কথা বলা কিছু আঁতেল। তুমি তাদের লাইক করো, তারা তোমার পোস্টে লাইক দেয়।’’
‘‘কি যা খুশি বকছ! আমি লাইকের কাঙাল? শোনো— শয়ে শয়ে লাইক দেখে তোমার হিংসে হয়!’’
‘‘তোমার পোস্টে লাইক দেখে আমার হিংসে হয়? তুমি আমাকে এত ছোট ভাব? ছি! আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না তোমার সঙ্গে। লকডাউনে নেহাত উপায় নেই— নইলে এক্ষুনি কোথাও চলে যেতাম। এত অপমান! তোমার লাইক দেখে হিংসে হয়! তোমাকে টাকা দিতে হবে না। সন্দীপদের আমি ধার করে টাকা দেব!’’


দু’ জন দু’ ঘরে। ঝগড়া করে ক্লান্ত। খেতে বসেও মুখোমুখি দু’জন একা।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল গড়িয়ে রাত। বেশ রাত। দূর আকাশে ভাঙা ভাঙা মেঘে ঢাকছে ক্ষয়াটে চাঁদ। নিস্তব্ধ পল্লি।
সিগারেটের বাটটা দূরে ছুঁড়ে দিয়ে ব্যালকনি থেকে ফিরে বেডরুমে ঢুকল নিখিলেশ। মাস্কের ইতিহাস গুগল করছিল— প্লেগ... ক্রিসটোস লিনটেরিস... মৃতদেহ নিয়ে গবেষনা... ড্রপলেট... মাইক্রো ব্যাকটেরিয়া... আমেরিকার থ্রি-এম কোম্পানি... পাড়ার এলে-তেলি টেলার কোম্পানি। দেখতে দেখতেই নিখিলেশ ভাবছিল— দরিদ্র এই দেশ আর বিশ্ব-বাজারে মাস্ক নিয়ে মস্করার কথা। একদিকে কাতারে কাতারে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। জলে-জঙ্গলে হতদরিদ্র মানুষ গাছের পাতা, ছেঁড়া ন্যাকড়া মুখে বেঁধে করোনা থেকে বাঁচার আকুল চেষ্টা করছে। অন্যদিকে কিছু লোক ঘরে বসে ব্যবসা ফেঁদে ঠকাচ্ছে। কাপড়ের টুকরো বিলি করে মহত সাজার চেষ্টা করছে। নেট খুঁজে অর্ডার করছে বুটিক থেকে গুর্জরি প্রিন্টের মাস্ক। তার কোনওটায় সুতোর কাজ। কোনওটায় জড়ির কাজ! অবাক পৃথিবী!
ট্রোল করতে করতে আর ইচ্ছে করছিল না নিখিলেশের। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল। সেলফোন রেখে আলো নিভিয়ে দিল। তারপর চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল। ঘরে এখন শুধু লাল আলো।
একটু পরেই টুকটুকে লাল ম্যাকসি পরে বিমলা এসে ঢুকল বেডরুমে। বালিশটা নিখিলেশের থেকে দূরে সরিয়ে উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল চুপটি করে। নিখিলেশ কিছুক্ষণ উসখুস করার পর বলল, ‘‘শোনো, তুমি বরং ওদের কিছু কিছু টাকা পাঠিয়ে দাও। আমি তোমার অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দিচ্ছি।’’
কিছুক্ষণ পরেও উল্টো দিক থেকে কোনও উত্তর না পেয়ে নিখিলেশ বিমলাকে জোর করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। তারপর...! লাল আলোয় বিমলাকে দেখে, সশব্দে হেসে উঠল!
বিমলা নিখিলেশের চোখে চোখ রেখে, মুখ থেকে মায়ের পাঠানো লাল মাস্কটার একদিক খুলল। ফিসফিসিয়ে বলল, ‘‘মাস্ক-বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক!’’

Post a Comment

3 Comments

  1. এ এক অন্য রকম ঘরেবাইরের গল্প।
    মাক্স বিপ্লব ক্ষণজীবী হোক।
    শুভেচ্ছা নিবেন।

    ReplyDelete
  2. এ এক অন্য রকম ঘরেবাইরের গল্প।
    মাক্স বিপ্লব ক্ষণজীবী হোক।
    শুভেচ্ছা নিবেন।

    ReplyDelete
  3. এ এক অন্য রকম ঘরেবাইরের গল্প।
    মাক্স বিপ্লব ক্ষণজীবী হোক।
    শুভেচ্ছা নিবেন।

    ReplyDelete