ব্লগ : স্বগতোক্তি/১১ । পিছিয়ে পড়েছে সনাতন শিক্ষক ভাবনা


পিছিয়ে পড়েছে সনাতন শিক্ষক ভাবনা

তড়িৎ রায় চৌধুরী

‘শিক্ষক দিবস’ কি পৃথিবীতে একটাই? এক সময় আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথি ছিল গুরু-পূর্ণিমা। আধ্যাত্মিক ও প্রাতিষ্ঠানিক গুরুদের মঙ্গল কামনার দিন। উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে রাষ্ট্রপতি সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ তাঁর জন্মদিন পালনে উৎসাহী ছাত্রদের জানালেন নিছক একজনের জন্য নয় দিনটি পালিত হোক এক সম্প্রদায়ের স্মরণে। তাই ৫ সেপ্টেম্বর হল ভারতের ‘শিক্ষক দিবস’। আরও পরে ১৯৯৪ সালে এডুকেশন ইন্টারন্যাশানাল এর প্রস্তাবে ইউনেস্কো ৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ এর স্বীকৃতি দেয়। একশোর উপর দেশ এটাই মানে। এত কথা আমরা মনে রাখিনি। এমন কি দার্শনিক রাধাকৃষ্ণণ দিনটির যে সাধারণীকরণ চেয়েছিলেন স্কুলে স্কুলে তাঁর ছবি আর স্মৃতিচারণের ঘটা সেই সম্ভাবনাকেও খুব উজ্জ্বল রাখে না। 

এই আমাদের সংকট। ব্যক্তিপূজাই আমাদের আদিধর্ম। যথার্থ গোষ্ঠীচেতনা নেই। সম্প্রদায় শুধু স্বার্থ রক্ষার জন্য। তাই আমাদের শিক্ষক সমাজ নেই, সবটাই বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির লড়াই। ‘তারে জমিন পর’ বা ‘সুপার থার্টি’ জাতীয় আধুনিক আয়না সেই ছবিই দেখায়। যা দেখায় না তা হল ব্যক্তি-বর্শা উঁচু হয়ে থাকার অনিবার্য ফল সংঘাত। পাঠপরিচালনার ক্ষেত্রে কোনও সাংগঠনিক সমবৃত্ততা নেই উপরওয়ালার নির্দেশ ছাড়া। নিউ-নর্মাল সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের কৌশল নেই আস্তিনে। 

রাষ্ট্র ঘোষিত লকআউটে অসহায় শ্রমিক। টিকে থাকার, সম্মান রক্ষার মরিয়া উপায় অপ্রস্তুত অদক্ষ অনলাইন ক্লাস। তা সত্ত্বেও সরকারিভাবে বা প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে নব্য প্রযুক্তি তত্ত্ব শিক্ষার কোনও ব্যবস্থা, পাঠক্রম তৈরি হয়ে ওঠেনি এখনও। অথচ বাণিজ্যিক নানা সংস্থায় তার চর্চা চলছে নিয়মিত। আর এ ভাবেই ব্লিজার্ডের তাড়া খেয়ে শিক্ষা ব্যবস্থা নিজের অজ্ঞাতে নেমে পড়ছে মৃত্যু সমুদ্রে। কেন না এই নতুন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক কোনও শিক্ষক সমাজ বা প্রতিষ্ঠান নয় বিভিন্ন মুনাফা লোভী সংস্থা। ওষুধের মতোই জাল শিক্ষার কারবার স্বাভাবিক অনিবার্য ভবিষ্যৎ। আর তার জালিয়াতি ধরার ক্ষমতা শিশু উপভোক্তাদের নেই। শিক্ষা নামক পণ্যটিকে বাজার জাত করার মুন্সীয়ানা বেসরকারী বিদ্যালয়গুলি বহুদিন থেকেই  দেখাচ্ছে। আর সেই মানচিত্রে শিক্ষকদের সম্মান ও স্বাধীনতার বহর ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। স্কুল-চেনের এই কাঠামোটি পরিস্থিতির সুযোগে ঝুঁকছে এডু-চ্যানেলের রমরমার দিকে। 

গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই ডিজটাল ইন্ডিয়ার বাস্তুবায়ন চুক্তিতে তো বলেছেন it focuses on connecting the 1.2 billion people in india… his will get  people rural areas online, low cost of bandwidth, offline strategy, affordable phons will connect more people. তার মানে প্রান্তিক গ্রামেও ফ্রী মোবাইলে ভর দিয়ে অনুপ্রবেশ নিছক দিবাস্বপ্ন নয় আর। টেলিভিশন তো ধর্মকেও বেচে চলেছে ২৪ ঘন্টা। শিক্ষা এমন কি! অনলাইন শপিং এর মতোই ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে রেকর্ডকৃত ক্লাস। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, এডুটেনমেন্ট, গেমিফিকেশন এর নিত্য নতুন উদ্ভাবন তার শক্তি বাড়াচ্ছে ক্রমাগত। বিবর্তনের ধারায় এখানেই পিছিয়ে পড়েছে সনাতন শিক্ষক ভাবনা। শাস্ত্র, সমাজ, সাহিত্য, শিল্প, নানা ভাবে আমাদের যৌথনির্জ্ঞান ভাবনায় এই সত্য প্রথিত করেছে যে শিক্ষকতা এক পবিত্র কর্ম। পবিত্রতা রক্ষা যতটা গুরুত্ব পেয়েছে প্রগতি প্রবণতা ততটা পায়নি।

তাই পারলৌকিক পুণ্যের চেয়ে ইহলৌকিক ইষ্টে আগ্রহ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পচ্ছন্দের পেশার তালিকায় পিছিয়ে পড়েছে শিক্ষকতা। মেধা-পুষ্টির অভাবে সে ওই সৃজনশীল পণ্য-সংস্কৃতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। হয়তো এ অবশ্যম্ভাবী দুঃখজনক সত্য। আসিমভের ‘দ্য ফান দে হ্যাড’ গল্পের মতো ক্লাসরুম তখন বেডরুমের পাশে। যন্ত্র আছে, স্লট আছে, স্পর্শ নেই, গন্ধ নেই। শিক্ষা গৌরব আছে কিন্তু দীক্ষা গুরু নেই। প্রাণের সান্নিধ্য যা শেখায়, যৌথ-যাপন অজান্তে যেভাবে সমৃদ্ধ করে তা বন্ধ। ইংরেজরা একদিন কেরানী তৈরির আকাক্ষায় ধ্বংস করেছিল দেশজ শিক্ষার ধারাকে। তার ফলে হারিয়ে গেছে প্রাচীনতম সভ্যতার বহু পরম্পরাগত জ্ঞান। আবারও পরিষেবামুখী বৃত্তি শিক্ষা নষ্ট করে দেবে জ্ঞান উৎপাদন ক্ষমতা। সভ্যতার অবিরাম ভোগেচ্ছায় তেল বা কয়লার মতোই ফুরিয়ে যাবে উদ্ভাবনী শক্তি। আজ যে সৃজনশীলতা যন্ত্র-শিক্ষাকে এত শক্তিশালী করেছে সেও হারিয়ে ফেলবে তার গতি। অভিযোজন ক্ষমতাহীন মানুষ শূন্য করে চলে যাবে জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।

Post a Comment

2 Comments

  1. শিক্ষক দিবসের প্রাপ্তি এই সুচিন্তিত সুলিখিত রচনা, বিষণ্ণ সশ্রদ্ধ নমস্কার জানাই তড়িৎদাকে

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো তড়িৎ দা। খুব প্রাসঙ্গিক লেখা।

    ReplyDelete