বইপাড়া : আমরা মনে রাখিনি কবিকে


আমরা মনে রাখিনি কবিকে

ঔষ্ণীক ঘোষ সোম

মহালয়ার দিন জন্ম বলে নিজেকে মহালয়াজাতক বলতেন। আমুদে, খাদ্যরসিক এবং নিরহংকার মানুষটা যে নেই এখনও মেনে নিতে পারি না! 

তিনি আমার প্রণব জেঠু, কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়।  

বারবার মনে হয় এই তো সব ঠিক হয়ে গেলে আবার কোনও অনুষ্ঠানে দেখা হবে। কিংবা তাঁর ৩৭৫ যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাটে কিছু দিনের মধ্যেই হানা দেব, আড্ডা হবে। তাছাড়া তাঁর বাড়িতে মাংস খাওয়ার নেমতন্নটাও তো বাকি রয়ে গেছে। এই সব ভাবতে ভাবতেই বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে ওঠে যখন হোয়াটস্যাপ খুলে দেখি তাঁর সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল এপ্রিলের শেষে, তারপর দীর্ঘ নীরবতা, অন্ধকার। এখন জানি ওই দিক থেকে কোনও দিন আর কোনও মেসেজ আসবে না। যোধপুর পার্কের সেই বাড়িটাতেও আর কোনও দিন যাওয়া হয়ে উঠবে না। সব কথা, সব যোগাযোগ, প্রতিশ্রুতি গঙ্গা জলে ধুয়ে গেছে তাঁর অস্থির সঙ্গে। শুধু রয়ে গেছে স্মৃতিগুলো।

প্রণব জেঠুর সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ হয়েছিল কোনও এক কবিতা-সন্ধ্যায়, নন্দন চত্বরে। বছর দেড়েক আগে। তখন সদ্য লেখালেখির জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করেছি। যে ক’জন অগ্রজ তাঁদের সৌহার্দ্যের হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রণব জেঠু অন্যতম। এত বর্ষীয়ান একজন লেখক আমার মতো একজন তরুণকে এতটা প্রশ্রয় দেবেন ভাবতেও পারিনি। পরে দেখেছি তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের কাছে টেনে নেওয়া ছিল তাঁর সহজাত স্বভাব। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর কাছের মানুষ হয়ে যাওয়া। সত্যি বলতে কি এমন ধরণের মাটির মানুষ যদি সবাই হতেন তাহলে আমাদের চারপাশটাই অন্যরকম হত। কিন্তু মানুষ হিসেবে অসাধারণ হয়েও জীবনে তিনি কী পেয়েছিলেন? কিছু মানুষের ভালবাসা আর কিছু পুরষ্কার। 

প্রণব জেঠুর লেখক হিসেবে যতটা খ্যাতি পাওয়া উচিত ছিল তা তিনি পাননি। কেন জানি না পঞ্চাশ দশকের অন্যান্য কবিদের সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে অনেকেই ভুলে যান। সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, কবিতা সিংহ, শামশের আনোয়ার, পূর্ণেন্দু পত্রী, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতো লেখকরা কেন এখনও বাংলা সাহিত্যে এত ব্রাত্য? এঁদের সঠিক মূল্যায়নের সময় কি এখনও আসেনি? 

প্রণব জেঠু সারা জীবনে কত যে গদ্য লিখেছেন তার হিসেব নেই। সাহিত্য, ম্যাজিক, রসনা ইত্যাদি কত বিষয়ে তিনি নানান পত্র পত্রিকায় লিখেছেন। কিন্তু তা আজ পর্যন্ত পাঠকের কাছে সংকলিত হয়ে বই আকারে এসে উঠল না। ছোটদের জন্য আনন্দমেলায় ‘মজারু’ ছদ্মনামে মজার খেলা ও ‘সত্যসন্ধ’ ছদ্মনামে ধাঁধা লিখেছেন। তাছাড়া ‘স্মৃতিধর’ এবং ‘সাংখ্যায়ন’ নাম নিয়েও ছোটদের জন্য বেশ কিছু লেখা লিখেছেন, অনেক বই সম্পাদনার কাজও করেছেন। এসব কথা এখন কটা লোক জানে? 

কোনও বিশেষ বিশেষ সাহিত্যিক নয় সবাইকে নিয়েই বাংলা সাহিত্যে, এটা যত দ্রুত আমরা বুঝব ততই আমাদের মঙ্গল। তর্পনের শেষ লগ্নে আঁজলার জল নদীকে ফিরিয়ে দিতে দিতে দেখতে পাচ্ছি আমার আঙুলের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ছে তাঁর কবিতা— 

‘‘রাত্রিকে হেনেছে সূর্য শান্তি চেয়ে প্রাণের রক্তিমে

সে এক অনন্ত শিল্পী প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে তার।

তার কোনো মৃত্যু নেই। রৌদ্র-মেঘ-বৃষ্টি-ঝড়-হিমে

সে এক অমর্ত্য গান আনন্দের, দুঃখ-বেদনার।।’’

Post a Comment

0 Comments