দুয়ারে রব একা


দুয়ারে রব একা

আবীর মুখোপাধ্যায়

বিকেলের পর কাল রাতেও কখন যে, ঘুমের মধ্যে, বৃষ্টি হয়ে গেছে— টের পাইনি! 

ঘুম-ভাঙা মেঘমান ভোরে দেখি, শান্তিনিকেতনের সারা পথ ও পল্লিজুড়ে বৃষ্টির সুবাস। প্রতিটি গাছের নীচে কী অপূর্ব আলপনায় ছড়িয়ে রয়েছে রঙিন ফুল-পাতার মিতালি। মেঘ ছুঁয়ে মিঠে রোদ যেন মায়া-রং ছড়িয়ে দিচ্ছে। বসন্তে এমন বৃষ্টি প্রতিবার আমাকে এক অলৌকিক স্পর্শে জাগায়। আর্তরবে বলিয়ে নেয়, ‘‘শুধু এবারের মতো/ বসন্তের ফুল যত/ যাব মোরা দুজনে কুড়াতে।/ তোমার কাননতলে ফাল্গুন আসিবে বারম্বার,/ তাহারি একটি শুধু মাগি আমি দুয়ারে তোমার।’’ শাল, পলাশ, শিমুলের বন অবশ্য জানে, ‘‘ফিরে দেখা হবে না তো আর।/ ফেলে দিয়ো ভোরে-গাঁথা/ ম্লান মল্লিকার মালাখানি।’’ তবু..., এমন স্বপ্নে চাওয়া বাসনা-কুসুম নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকা। 

তর্কতপ্ত রাজনীতির খেলা যখন দেশজুড়ে, শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রনাথের ‘বসন্ত’ পড়ছে। এও কী এড়িয়ে যাওয়া? তেমন মনে করি না আমি। বরং চিরকালীন খেলার আয়োজনে মেতে থাকা। চোখে-ঠোঁটে লাল-সবুজ-গেরুয়া নয়, রঙ যেন মোর মর্মে লাগে— এই আমাদের দাবি। ১৩২৯-এর ১০ ফাল্গুন ‘শ্রীমান কবি নজরুল ইসলাম/ স্নেহভাজনেষু’-কে কবির উৎসর্গ করা ‘বসন্ত’ থেকে একেবারে শুরুর জায়গাটা পড়ি— 

কবি। রাজা মাঝে-মাঝে সরে দাঁড়ালে প্রজারা রাজত্ব করবার অবকাশ পায়।

রাজা। তার অর্থ কী হল।

কবি। রাজার অর্থ যখন শূন্যে এসে ঠেকে প্রজা তখন নিজের অর্থ খুঁজে বের করে, তাতেই তার রক্ষা।

রাজা। কবি, তোমার কথাগুলো বাঁকা ঠেকছে। মন্ত্রণাসভা ছেড়ে এসেছি, আবার তোমার সঙ্গও ছাড়তে হবে নাকি।

কবি। না, তার দরকার হবে না। আপনি যখন পলাতক তখন তো আমাদেরই দলে এসে পড়েছেন।

রাজা। তোমার দলে?

কবি। হাঁ মহারাজ, আমি জন্মপলাতক।

রাজা। তুমি আমাকে দলে টানতে চাও? অতদূর এগোতে পারব না। আমাকে মন্ত্রীরা মিলে সভাছাড়া করেছে, তাই বলে কি কবির দলে ভিড়ে শেষে—

কবি। শুধু আমাকে দেখে ভয় পাবেন না, এ দলে আপনি রাজসঙ্গীও পাবেন।

রাজা। রাজসঙ্গী? কে বলো তো।

কবি। ঋতুরাজ।

রাজা। ঋতুরাজ? বসন্ত?

রৌদ্র ছায়া, বর্ষা পেরিয়ে আরও এক বসন্ত। বৃষ্টির তানতোড়ে ঝরে যাওয়া ফুলের দিকে চেয়ে ভাবছিলাম, বসন্ত আসলে মিলন নয়, অপেক্ষার ঋতু! বৃষ্টি ভিজে লাল-মোড়ামের মাটি ছুঁয়ে ছুঁয়ে ভাবছি, বাংলা বিভাগের জন্য সেবার লেখা শক্তির কবিতার কথা, ‘‘হঠাৎ অকাল বৃষ্টি শান্তিনিকেতনে/ রাতভর বৃষ্টি হল শান্তিনিকেতনে...।’’ স্মৃতি থেকে শুনতে পাচ্ছি, বিদ্যাভবনের সেমিনার হল-এ শক্তি পড়ছেন— ‘‘সেগুনমঞ্জরী হতে ধাক্কা দাও, জাগাও আমাকে/ আমি আছি বিষঘুমে, জাগাও আমাকে/ আমি আছি সর্পদষ্ট, জাগাও আমাকে/ বৈরাগে সন্নাসে আছি, জাগাও আমাকে/ আমি জাগবো না, আমি বিষঘুমে, জাগাও আমাকে...।’’ 

বসন্তেই ‘এখন শান্তিনিকেতন’ পত্রিকার ওয়েবসাইটটি নতুন রূপে ফিরে এল। ফিরল পথ-চাওয়ার আনন্দ নিয়ে। অপেক্ষার ঐশ্বর্য নিয়ে। নতুন নতুন বিভাগ আর নবীন কলম। ছবি আর ছবি। লেখা আর ছবির রঙিন মেলামেশা-নেশা। পাঠকের দরবারে নিত্যপুজোর রেকাব নিয়ে। 

Post a Comment

0 Comments