ব্লগ : দেশান্তর/ ১২ । চৈত্র সেল


চৈত্র সেল

মৌমন মিত্র 

লিটিল রাসেল স্ট্রিটের অফিস থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা গড়িয়াহাটের মঞ্জুষা বুটিক পৌঁছে গেছি। সেখানে আকাশি নীল সাইড স্লিটেড হাইনেক কুর্তা, থরে থরে গাঢ় নীলের উপর লাল ও সাদা সুতোর উইভ করা শাড়ি। তার পাশে অভিনব কাট ও স্টাইলের ব্লাউজের বিভিন্ন কালেকশন। একদিকে নজর কাড়ছে নেক লাইনের উইভিং, অন্যদিকে কটন ফ্যাব্রিকের উপর অলওভার এমব্রয়ডার্ড ধবধবে সাদা আংরাখার ফ্যাশান।  

সময়টা চৈত্রের পড়ন্ত বিকেল। রোদের তাপে পুড়ে যাচ্ছে কলকাতা শহর। চারপাশে চৈত্র সেল। ভিড়ে ঠাসা ফুটপাথের ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে, মানুষ কাটাতে কাটাতে সস্তা কানের দুলের নতুন স্টক দেখে, ক'টা টেরাকোটার ওয়িন্ড চাইম নিয়ে দরাদরি করতে করতে, অকারণ আনন্দে মেতে ওঠা। এরপর বন্ধুর সঙ্গে উল্টো দিকের ফুটপাথে ক'টা হাতব্যাগ নিয়ে অহেতুক দামাদামি করে আধঘন্টার মধ্যে বিবেকানন্দ পার্ক। দই-ফুচকায় মুখ ডুবিয়ে, দিনের শেষে লেক কালীবাড়ির সন্ধ্যা আরতি দেখে, শেষমেষ বাড়ি ফেরা। এর মধ্যে কখন যেন ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে গেছে ঘণ্টা চারেক! অ্যাপক্যাব নয়, তখন দিনের শেষে হাত নাড়িয়ে একটা ট্যাক্সি দাঁড় করাতে কালঘাম ছুটে যেত! তারপর, কোনওমতে ভাগ্যক্রমে একটা ট্যাক্সি পেলে, সোজা বাড়ির ঠিকানায়। ট্যাক্সির মধ্যে হু-হু করে বইছে সান্ধ্য হাওয়ার দাপট। যদিও তাতে গরম কিছু কমছে না। মনে মাথায় গেঁথে যাচ্ছে হালকা এফ.এম নেশা। কলকাতার গান কলকাতার প্রাণ!

 

...‘‘নাহ, প্রথম দোকানের ছেলেটা ঠকাতে পারেনি, বুঝলে। এইটুকু দাম হবে না! কত কাজ রয়েছে কানের দুলটায়, আর..আর ওই কুলোটা? কুলোর গায়ে যে মা দুর্গার চুলের অংশটা, তাতে কী অপূর্ব ফ্যব্রিকের কারুকাজ ভাবো তো! না...না ঠকিনি, ঠকিনি! দাম ঠিকই নিয়েছে। কী বলো, ঋতু?’’

ঋতুর চোখে রিমলেস চশমা, পরনে টাইমলেস ফ্যাবের নরম কালার টেক্সচারের কটন সালওয়ার কামিজ। ঋতু খিলখিলয়ে হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘যা পেয়েছি, যথেষ্ট পেয়েছি। ছাড়ো তো… ভিড় ঠেলে কেনার মজাটাই আসল!’’

‘‘তাই তো, তাই তো!’’ এই ব'লে, আমি মনে মনে ঋতুর আর আমার আনন্দগুলো পড়ে ফেলার প্রাণপণ চেষ্টা করছি। ফুটপাথের ধারে দরদর করে ঘামতে ঘামতে, কী কিনছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিনছি, ভিড় ঠেলতে পারছি… এসবের আনন্দ কী আর মুখে বলে প্রকাশ করা যায়! উফফ! ক’দিন যাবৎ যা এক ভ্যাপসানি গরম পড়েছে না ...।’’ ব’লে, ঋতু ওর কানের পেছনে কুচো চুলগুলো সরিয়ে নিচ্ছে। 


স্মার্ট, আধো আধো কথা বলার ভঙ্গিমায় ঋতুর সেই হাসিমুখের ছবি, টাইম ট্রেভেল করে কলকাতা থেকে এখানে ভেসে আসে, আজও! ডেকে বসে নিউ জার্সির বসন্ত রোদ পোহাতে পোহাতে তোমায় খুব মনে পড়ছে ঋতু! কত চৈত্র মাস চলে গেল, কত বসন্ত পেরিয়ে এলাম, এখানে সময় থমকে গেছে! এখন আর চৈত্র মাসের সেলে ঘামাঘামি করে শপিং হয় না, মায়ের মন্দিরে সন্ধ্যা আরতি দেখা হয় না, কোনও-না-কোনও ছুতোয় অফিস বাঙ্ক করে, বড়রাস্তার মোড়ের মাথায় ডাব জল, লস্যি সিপ করা হয় না। প্রথম সিপের পরই আমি ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলকে আনন্দ বুটিকের কালেকশান আলতো চোখ বুলিয়ে নিতাম, তা-দেখে তোমার সে কী হাসি, সে কী হাসি! 

এখন চৈত্র মানে একটা অন্যরকম, দিক ভুল করা দিশাহীন সময়। এখন চৈত্র মানে ছেলে মেয়ের স্প্রিং ব্রেক, বছরের শেষে বাড়িঘর পরিষ্কার করতে করতে ক'টা পুরনো পাণ্ডুলিপির কবিতা ভেবে, কিছু লেখা ঘাঁটাঘাঁটি করা, মেয়ের স্কুলে তোলা কয়েকটা পোর্ট্রেট ছবি দেখে আঁতকে উঠে মনে মনে মেয়েকে বলা," ওমা! কী কিউট ছিলি তুই, দিনে দিনে কবে যে এত বড় হয়ে গেলি!" 

এখন চৈত্র মানে একটু একটু করে সন্তানদের পুরোনো পোশাকের মায়াচিহ্নে হাত বোলাতে বোলাতে নিজেকে বোঝানো যে, এবার এরা বড় হয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে বাড়ছে আমার চোখের চালশে, সিঁথির ফাঁকে বাড়ছে আরও দু'চারটে গ্রে -লাইন্স। এসব ভাবতে ভাবতে অন্তহীন কোথাও যেতে-যেতে, একটা ক্লান্ত দিনের শেষ।

এখন চৈত্র মানে, পাড়ার লেকের পাশে বেঞ্চে বসে, খুব নির্জনে স্মৃতির ব্যাগে পড়ে থাকা নানা রঙের দৃশ্যের সঙ্গে বাস্তবমন গুলে, এক মনে কাফকা পড়া। পড়তে পড়তে বহেমিয়ান সময়টাকে টেনে টেনে লম্বা করে নদীর স্রোতের মতো কেবল সামনের দিকে বয়ে চলা। 

চেরি, টিউলিপের পাপড়ি বেয়ে এখন সন্ধে অনেক দেরিতে নামে। ইদানীং সন্ধে হতে হতে প্রায় সাতটা সাড়ে সাতটা বেজে যায়। তখন স্ট্রিট লাইটস জ্বলে উঠলে আমার পাশের বাড়ির অ্যান্ডি বাড়ি ফেরে। কোভিড সময়ের আগে অ্যান্ডির সঙ্গে তেমন দেখা হত না। কোভিডের আগে পাড়ায় বেরনোর সময় কোথায়! তখন আর-পাঁচটা মানুষের মতো সারাদিন কাজেকর্মে ছুটে বেড়াচ্ছি, জীবনের একটা সহজ, সরল, গতে ফেলা সরলরেখা ধরে। মহামারির পর, সকলের জীবনের ফ্রেমওয়ার্কগুলো যেন দুমড়ে-মুচড়ে ভয়ংকরভাবে এলোমেলো হয়ে গেছে।

অ্যান্ডি সিঙ্গল ফাদার। ঠিক বছর পাঁচেক আগে আমার সঙ্গে ওর পরিচয় হয়। সেদিন ও বাড়ি ঢুকে সদ্য জিনিসপত্র আনপ্যাক করছে। শরীরের অনেকখানি শক্তি এক জায়গায় জড়ো করে একটা ঢাউস বাক্স ঠেলার চেষ্টা করছে বাড়ির দেওয়ালের এক কোণে। তার লম্বা গড়ন, শক্ত চোয়াল ভর্তি খরখরে দাড়ি। যেন দু'দিন বা তারও বেশি সময় ধরে দাড়ি কামায়নি। চোখ দু’টোতে বড় কষ্ট মাখানো। মনে হয় এক যুগের জমানো ব্যর্থতা। তবু, পাতলা ঠোঁটের কোলে ঘুরে দাঁড়ানোর কী অদম্য, দৃঢ় হাসি! অ্যান্ডির দুই পুত্র সন্তান এখন হাই স্কুলে যায়। সপ্তাহের বেশিরভাগ সময়টা তারা তাদের বাবার কাছে থাকে। অ্যান্ডিকে দেখে আমি ঘড়ি না-দেখে সময় আন্দাজ করতে পারি। সকাল থেকে সন্ধে ঘড়ির কাটা মেপে সন্তানদের মানুষ করছে, পাল্লা দিয়ে নিজের অফিস, জিম— সব একলা হাতে মেটিকিউলাসলি এক অদমনীয় ক্ষমতাবলে সামলে চলেছে। 

ওর লিভিংরুমের লাগোয়া একটুকরো জানলার ব্লাইন্ডস অধিকাংশ সময় খোলা থাকে। আমার পারকিং লট থেকে অ্যান্ডির রান্নাঘরের ডিম্-আলো দেখতে পাই, আমি। ঘরের ওপেন-কিচেন ক্যাবিনেটসের র‍্যাকে বাসনপত্র থেকে আনাজপাতি কী সুন্দরভাবে সাজানো-গোছানো। আমি এত বছর যাবৎ রোজ একই ভাবে বিস্মিত হয়ে, মুখে কোনওকিছু না-বলেও অ্যান্ডির জীবনে তার বাবা-হওয়ার পর্বকে কুর্নিশ জানাই, আমার নীরব ভাষায়। 

আজ বিকেলে একটা লিনেনের উল্টো কাঁথা ড্রেস পরে, হাঁটতে বেরিয়েছি। দু'হাজার আঠেরো সালের শুরুর দিকে এই উল্টো কাঁথা ড্রেস খুব ইন ছিল, কলকাতার ফ্যাশন স্টেটমেন্টে। এখানে ফিরে এসে তেমন পরা হয়নি ড্রেসটা। কোথায় পরব। কবে পরব। বছরের ছ'মাস হাড়কাঁপুনি ঠাণ্ডায় কেটে যায়। তখন উঁচু বুট, নরম স্কার্ফ আর তিন চার পরতের উলেন ভারী জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে আওড়াতে থাকি, ‘এখানে তুষার গাভীর মতো চরে...।’ 

মন ও বডি ক্লকে কলকাতার চৈত্র লেগে থাকলেও এখনও বিকেলের পর হালকা শীত নেমে আসে। তাই, আজ ড্রেসের সঙ্গে টিম আপ করে পরেছিলাম একটা ফুল স্লিভ সুতির কালার্ড শার্ট। ঠিক সন্ধে নামার মুখে অফিস ফিরতি অ্যান্ডির সঙ্গে দেখা। অ্যান্ডির অফিস নিউ ইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটে। ও ভীষণ পোশাক বিলাসী। আমায় হাঁটতে দেখে গাড়ি পার্ক করে, আমার দিকে এগিয়ে এল...ও। 

‘‘ওয়াও! কোথা থেকে আসছ? ড্রেসটা দারুণ,তোমার! কী অপূর্ব সব আর্টওয়ার্ক!’’ 

‘‘এটা কাঁথাস্টিচ। আমাদের নকশি কাঁথার মাঠ।’’

‘‘মানে? আরেকটু এক্সপ্লেন করো ….প্লিজ...।’’

অ্যান্ডির ইন্টারেস্ট বাড়ছে দেখে আমি আরও বললাম, ‘‘আমাদের স্টেটে পুরোনো কাপড় বা নরম ধুতি চার ভাঁজ করে বোনা হত নকশিকাঁথা। তাতে পদ্মফুল, ময়ূর, মাছ, ঐরাবত… আরও কত ধরনের ডিজাইন! কখনও সুচ-সুতোর এক ফোঁড়ে কখনও দুই ফোঁড়ে। এভাবে দৈনন্দিন কত গল্প লিখে চলেছে শিল্পীরা! সময়ের সঙ্গে কাঁথার কাজ এখন ককটেল কিংবা শর্ট ড্রেসে, ব্লেজার, এমনকী ট্রেঞ্চ কোটে।’’ ‘‘এ তো কমপ্লিট একটা আর্টওয়ার্ক! সুতোয় বোনা গল্প!’’

আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, ‘‘ইয়েস! আর হ্যাঁ, কাঁথা রিসাইকেল করা যায়। নতুন কাপড়ের জমিতে পুরোনো কাঁথার প্যাচওয়ার্ক ব্যবহার করা যায়। নেকপিস, ঝোলানো দুলে দেওয়া যেতে পারে ছোট্ট ছোট্ট কাঁথা ওয়ার্কস!’’

অ্যান্ডির চোখেমুখে আমার বাংলার শিল্পীদের প্রতি কী অদ্ভুত বিস্ময় ফুটে উঠছে।” ও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কাঁথার শিল্পীদের গ্রাম, তাঁদের কাজের পরিধি, রোজগার সম্পর্কে জানতে চাইছে। নিজের দেশে থাকতে এইসব শিল্পীদের হাতের কাজের কত দরদাম করেছি। চৈত্র সেলে। কখনও দশ টাকা কমাতে ফুটপাথের ভিড় ঠেলে আরও এগিয়ে গেছি, কখনও পনেরো টাকা কমাতে রাস্তা পার হয়ে অন্য দোকানে চলে গেছি। আজ এত বছর বাদে, বুঝি যে, ভারতীয় শিল্পের মূল্যায়ন অ্যান্ডির চোখের মণিতে অনেক অনেক বেশি। কারণ, এ-শিল্প ওর কাছে সহজলভ্য নয়।

অ্যান্ডি ওর মুখোশের দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘‘সংক্রমণ বাড়ছে জানো নিশ্চয়ই। মানুষ ভ্যাক্সিন নিয়ে আর মুখোশ পরতে চাইছে না। মনে হয় আগামী আরও এক বছর একই নিয়ম… সে মুখোশ, হ্যান্ড ওয়াশ, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। আরও দীর্ঘদিন মুখোশ পরে কাটাতে হবে। নেক্সট টাইম তুমি ইন্ডিয়া গেলে, আমার জন্য অনেকরকম সফট কালারের কাঁথাস্টিচ করা মুখোশ আনবে। আনবে তো?’’

‘‘ওখানেও সংক্রমণ বাড়ছে। জানি না কবে যেতে পারব। গেলে, নিশ্চয়ই নিয়ে আসব…’’ বলে, আমরা দু’জন ঘরে ফিরছি, এবার।

ঠিক তখন কোথা থেকে যেন গজল সন্ধ্যা নেমে আসে। তার দাঁড় বেয়ে ভেসে আসছে এই মুহূর্তে কলকাতার ভোটের স্লোগান, ফুটপাথের সেল সেল সেল বলে ককিয়ে ওঠা অসংখ্য দরিদ্র দোকানির স্বর। লেক কালি বাড়ির সন্ধ্যা আরতি, ধূপের গন্ধ মিশছে আমার এই হিডেন চেস্ট অফ ড্রয়ারে রাখা, বহু বছরের পুরোনো চৈত্র সেলে কেনা, কাঁথাস্টিচের গল্পকথা। তার সঙ্গে চৈত্র উষ্ণতার আভাস। কিছু অনিশ্চিত ভয়, ভুলে-যাওয়া বাসনা আর পড়ে-থাকা ভালবাসা। যাকে বলে পারফেক্ট ব্লেন্ড, আ হারমনিয়াস লিভিং…!

কিছু অব্যক্ত সত্যিমিথ্যে আপস করে, খানিকটা ভালো লেগে, আর অনেককিছু ভালো লাগাতে হবে ব’লে… ঠিক যেভাবে অ্যান্ডি বাঁচে…। 

Post a Comment

2 Comments

  1. খুব ভালো লাগল লেখাটা

    ReplyDelete