একই অধিকার, একটি ভোট
তড়িৎ রায়চৌধুরী
‘‘তুমি যদি চুরি করো, কে তোমার করিবে বিচার?’’
সহস্র বৎসরের সনাতন রীতি যাকে বিশ্বমাতা বলে এসেছে। একা ভিখারিনী অপর্ণা তাকে বলে রাক্ষসী। শেষপর্যন্ত রাজা থেকে পুরোহিত সকলেই একমত হয় তার সঙ্গে। মৃত্যু ব্যবসার মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা বিসর্জিত হয়। কিন্তু সে তো নাটকে! বাস্তবে?
লকডাউনের বার্ষিকী পালন হয়ে গেছে। ফিরে ফিরেই নতুন সে। নবরূপে গত বছরের সকল ত্রুটি সংশোধন করে ফিরেছে কিন্তু লকডাউন ফেরেনি রাজ্যে। কেন না, সেদিন তুমি রাস্তায় চা খেতে বেরিয়েছিলে। আজ রাজা নেমেছেন ভোট কুড়োতে। তাই যতই উর্দ্ধমুখী হোক গ্রাফ, এখন সব মাপ। কে তোমার করিবে বিচার? গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে রাক্ষস বলার স্পর্ধা আছে কার? তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি ছিনু লোভী বটে! আর এ জন্যই শুধু রাষ্ট্র নয় তার নিয়ন্ত্রনাধীন বিজ্ঞান থেকে আইন কারোর উপরেই আর আস্থা রাখতে পারছে না নবীন প্রজন্ম। পারস্পরিক আস্থাহীনতায় তৈরি হচ্ছে জোর যার মুলুক তার এর যুগ। পাওনা গন্ডার হিসাবে ভারি হয়ে যাচ্ছে জীবনের ছন্দ। ডাল ভাত রুটি সব্জির বাইরে যেন কোন স্বাদ নেই। মুখ ঢেকেছে মাস্কে। শয়ে শয়ে মরে গেছে চুনোপুঁটি কত চুম্বন।
এই রকমটাই তো হবার কথা। মানে হওয়া কিছু বিস্ময়কর নয়। ধাক্কা না খেলে তো বোঝা যায় না গাড়ির খোল কত শক্ত, তার দম কত জোরদার। করোনার প্রথম থাপ্পড়েই সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে সভ্যতা কতটা সারবত্তাহীন। একবছর ধরে আবেগের দোকানদারি আর জ্ঞানের ফুলঝড়ি ছড়ানো ছাড়া কি করেছি আমরা? কোন পরিকাঠামো উন্নয়ন, কোন যাপনগত পার্থক্য, কোন দার্শনিক বোধের আত্মীকরণ? যেন আটকা পড়েছিলাম ভাগ্যদোষে, মুক্তি পাবো সময়কালে। আর এই জঘন্য জনগণতান্ত্রিক মানসিকতাই আধুনিক রাষ্ট্রের জনার্দন। সে শুধু সংখ্যা বোঝে। শঙ্খ ঘোষ আর শ্মশান স্বপনের একই অধিকার, একটি ভোট। অভিজাত তন্ত্র তো অপরাধ। তো কেন কোন চর্চার দিকে যাবে মানুষ? হকের মাল চাইলে গালি জোটে; ভিক্ষা চাইলে মিষ্টি হাসি। তাই শিক্ষা ব্যবস্থা কে পঙ্গু রেখেছি দীর্ঘকাল। তার থেকে তো কোন তাৎক্ষণিক অর্থ উন্নতি নেই। আমরা লকডাউন করেছিলাম অর্থপতিদের বাঁচাতে তাই শ্রমিকদের কর্মচ্যুতি কে আড়াল করেছি। বলেছি লকডাউন করতেই হবে স্বাস্থ্য-সুরক্ষার প্রশ্ন।আবার খুলেও দিয়েছি বলেছি উপায় নেই দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। সবই এত অনিবার্য, এত অবশ্যম্ভাবী। অথচ আজ কোন মিডিয়ার পর্দায় নেই সেই সব মিথোজীবী পন্ডিতের দল। খুড়ো বলত বটে ‘‘বাবা তোমাদের সব যুক্তিই আসলে মনগড়া তক্তি(মিষ্টি)।’’ তা মোটা মাথায় কাঁঠাল ভাঙাই তো আমাদের ট্রাডিশান। বন্ধুরা বলে ট্রায়াজের কথা। নিষ্ঠুর নির্মম ভাবে স্বাস্থ্য পরিসেবা থেকে একদল কে বাধ্যত ছেঁটে ফেলার তত্ত্ব। আরে বাবা,নিরাকার ট্রায়াজ আমাদের দেশে এমনিই সুপ্রচলিত। কে না জানে ওষুধের ব্যবসা করোনা কালে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম হয়ে উঠেছে। গাড়ির তেলের খরচা শিফট হয়ে গেছে কখনও ট্যাবলেটে কখনও ভ্যাকসিনে।
—আচ্ছা, স্কুল কলেজ কেন খুলল না তেমন করে?
—কারণ তাহলে হু হু করে ছড়িয়ে পড়বে অসুখটা। ওরা(বিদ্যার্থীরা) নিজেদের সামলে রাখতে পারবে না।
—তাই! বড় বিদ্যার্থীরা, যারা বাধ্যত বিজ্ঞান কিছুটা পড়ে এসেছে। ভবিষ্যতের দক্ষ নাগরিক রূপে রাষ্ট্র যাদের স্বীকৃতি দেবে; তাদের উপর ভরসা নেই? তো ভরসা করব কাকে?
কেন? জনতার উপর। যারা পালে পালে যোগ দেয় বাজার, রাজনীতি আর ধর্মীয় সমাবেশে। কোনও হিসাব আছে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে করোনা সংক্রমণ হয়েছে কতটা আর কতটা ওইসব জমায়েত থেকে? তবু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলে সবার শেষে। বন্ধ হয় সবার আগে। দুটো বিষয়ের পরীক্ষার নম্বর কে কি অনায়াসে চারটে করে দিতে পারি ফাইনাল পরীক্ষাতেও। তো তিন দফা ভোটের ফল কে ছয় দফার রেজাল্ট ভাবলেই তো ল্যাঠা চোকে। আসলে আমরা শিক্ষায় না দীক্ষায় বিশ্বাসী। চিন্তাবিদকে বলি গুরুদেব। এখানে সম্মান অর্জনের সুবিধাজনক পথ সমর্পণ।
আবার ফিরে আসছে ফাঁকা ফাঁকা রাস্তা, ভয়ে কাঁটা মন। সকলেই আড়চোখে সকল কে দ্যাখে। মনে হয় বুঝি ওই করোনা লুকানো রয়ে গেছে।
কবে যে অপরিচিতের সাথে নদী পাড়ে আবার মচ্ছবে বসতে পারব। কে জানে?
1 Comments
পশ্চিম বঙ্গে ভোট যখন শেষের পথে তখন করোনা নিয়ে মানুষ সরব হয়েছে। তার মানে এত দিন কি কিছুই ছিল না। অন্য রাজ্য গুলোতে যখন রোগীর সংখ্যা হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে এই রাজ্যের তখন কোনো খবরই নেই। আশ্চর্য
ReplyDelete