ব্লগ : স্বগতোক্তি/১৫ । দুই ভ্যাকসিনের দূরত্ব যেন ইলাস্টিক


দুই ভ্যাকসিনের দূরত্ব যেন ইলাস্টিক

তড়িৎ রায়চৌধুরী 

“এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার। ওকি পাখির কুজন নাকি হাহাকার”। 

সকালে মেসেজ টোন শুনলেই বুক কেঁপে ওঠে। এক তো নয় কোনও কোনও দিন একাধিক খবর। যেন কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্পে কাটছে দিন। তফাত একটাই, আজও আমরা ভুলিনি নাৎসী অত্যাচার। সেই আতঙ্ক প্রভাবশালী সারা বিশ্বে। কিন্তু এই সব দিনগুলি রাতগুলি সহজেই আমাদের ভুলিয়ে দেবে দক্ষ রাজনীতির কারিগরেরা। গতবার দেশে হঠাৎ ডাকা লকডাউনে যারা সোচ্চার ছিলেন শ্রমিকদের জন্য তারাই এবার রাজ্যের হঠকারিতায় সাফাই গাইছেন। ভোট মিটেছে, ঈদ গেছে এবার করাই যায় বন্ধ। আর বিজ্ঞানও তো আজকাল পোঁ ধরতে ওস্তাদ হয়ে গেছে। 

“কিছু করার নেই এটা করতেই হত”। করতে যে হত দু মাস আগে সে কথা ভুলে যাও। আহা যা হয়ে গেছে, তা গেছে; এখন কি করা যায় তাই ভাবো। অতএব সেই অলাতচক্রে চক্রমন। আপনি লকডাউনের কষ্ট সহ্য করে করোনা কমাবেন; আমরা আমাদের দরকারে আবার বাড়াবো। খেলতে খেলতে চলে আসবে দুর্গাপুজো। তারপর পঞ্চায়েত ভোট। আপনি না পারলে, আমরা ভোট আনতে সদলবলে পৌঁছে যাব বাড়ি বাড়ি। কিন্তু ভ্যাকসিন আপনাকেই মরতে মরতেও লাইনে দাঁড়িয়েই নিতে হবে। যদিও সে ভ্যাকসিনের গায়ে আমরা লিখে দিয়েছি আপনার শরীরের প্রতিক্রিয়ার জন্য আমরা কেউ দায়ী নই। এই প্রথম পৃথিবী সেই আশ্চর্য ভ্যাকসিন দেখছে যার কোন সময়ের সীমা নেই। ছয় থেকে নয় নয়; একেবারে বারোর চাল। দুই ডোজের মধ্যবর্তী দূরত্ব বাড়ছে ইলাস্টিকের মতো। কতদূর স্তাবক হয়েছে বিজ্ঞান!

আর প্রশাসন যখন যা করে নিরুপায় হয়েই নাকি করে। লক বা আনলক— সত্য সকলই সত্য। মিডিয়া থেকে মাতব্বর সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে সে সত্য প্রমাণের পারঙ্গমতায়। কে বা আগে ‘মান’ করিবেক দান! আমরা তুমুল খিল্লি করবো, আর বাক স্বাধীনতার গব্বে অর্ধেক রুটি পাবার দিন জিজ্ঞাসা করতে ভুলে যাব আমাদের প্রাপ্য পুরো রুটিটা কই? দেশের বুদ্ধিমান প্রজাতি তাই মাঝে মাঝেই আমাদের খিল্লির মশলা যোগান দেন। স্কুলের ম্যাজিশিয়ানের মতো। ইচ্ছা করেই ধরা পড়ে যায়, মনে হয় বুঝি এ খেলাটা সে পারবে না। তারপর আমাদের সবটুকু সহজ বিশ্বাস কে তছনছ করে সে প্রমাণ করে ওস্তাদের মার শেষ রাতে। বেমালুম হার মানতে হয় তখন।

হেরে গেলে মার খাওয়া ছাড়া তো উপায় নেই দাদা। বুলডোজারে ভেঙ্গে দেওয়া দোকানের টুকরো টাকরা কুড়োতে কুড়োতে বলছিল শামিম। একটু একটু করে তাক বাড়িয়ে বাড়িয়ে সব্জী-পাতি ভালোই সাজিয়েছিল। এখন সব শেষ। আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। আমাদের স্বাভাবিক ভোট-নামচা।

— তো তোমরা ওই দল কে সাপোর্ট দিতে গেলে কেন? ওরা তো...

— ধর্ম আমাদের পেটে থাকে গো দাদা, টাকা পেলে মাল দি। সে কি খদ্দেরের ধর্ম দেখে দি?

— তাহলে কোনদিকে না থাকলেই পারতে। খামোকা মার খেতে না।

— রাস্তার বসে মাল বেচি দাদা, মাঝে তো আর বসতে পারব না। যে কোন একটা ধারেই তো বসতে হবে। গণৎকারও নই যে বুঝবো কোন দিকটা বেশি নিরাপদ। এ জীবন জুয়ার সামিল।

সত্যিই এ তো টিভিতে বসে ভোটের ভবিষৎ বলা নয়। হারা-জেতার বাজি লড়ে জীবন যাপন বলে কথা। শেষ কথাটা কেমন ঢেউ তোলে ভিতরে। এ জীবন জুয়ার সামিল। ওর না হয় উপায় নেই, আমাদের? করোনার প্রথম ঢেউ এ যখন হাহাকার পড়েছে বহির্বিশ্বে আমরা ওদের তালে নেচেছি। অকারণ অতি দীর্ঘ লকডাউন করেছি। থালা বাজিয়ে আলো জ্বালিয়ে ভেবেছি “মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি”। ঈশ্বর, আল্লা, গড আমাদের রক্ষা করবেন। উজাড় করে দিয়েছি ভক্তি। যুক্তি মেনে প্রস্তুতি নিইনি। তাই এবার জীবনই লকডাউনের পাল্লায়। আমরা সেই রাস্তার মোড়ে, ভাগ্য যেদিকে নিয়ে যাবে। চিরকাল অন্য নির্ভরতায় আপন ইন্দ্রিয়ের সকল যোগ ছিন্নকারী যোগাসনকেই আমরা মুক্তির পথ ভেবেছি। এখনো ভাবছি। “দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?” তাই সংসারের অনিত্যতা রোজ এসে কড়া নাড়ছে ফোনে। “জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?” 

সব কথাই কেমন অন্য মানে নিয়ে আসে আজকাল!


Post a Comment

0 Comments