রবিবার

কবিতার একাল-সেকাল। কবিতার ঘর-বাহির। কাব্যময় শব্দের খেয়াল-খাতা, যতি চিহ্নের টপ্পা-ঠুংরি। কবি ও কবিতার ভুবন নিয়ে অন্তর্ঘাতের প্রচ্ছদ। লিখছেন সুমন গুণ


বাংলা কবিতার এখন ভরা সংসার। গত কয়েক বছরে কত নতুন কন্ঠের মন্ত্রোচ্চারণ শুনলাম আমরা। নানা জায়গা থেকে নানা ঘরানার, নানা মাত্রার কবিরা নতুন নতুন সম্ভাবনার গমকে চমকে দিচ্ছেন আমাদের। আমি বেশ কিছুদিন ধরে এইসব তরুণ কবির লেখা অনুসরণ করছি। তাঁদের অনেকের লেখা নিয়ে এদিক ওদিক কিছু কিছু আলোচনাও করেছি। আজ এই লেখাটিতে সেইসব লেখা স্পর্শ করে আরও কিছু নতুন কথা বলব, আবার নতুন করে চিনে নিতে চাইব এইসব ধ্বনির ভেতরের রহস্য ও সন্ত্রাস।
সৌম্যজিৎ আচার্যর ‘বাকিটা উহ্য থাক’ অভিজ্ঞতার মেধাবী সমারোহে হয়ে-ওঠা কয়েকটি উদ্যত কবিতার সংকলন। গদ্যধরনেই আস্থা বেশি এই কবির, উচ্চারণের তির্যক মোচড়ে প্রতিটি কবিতা স্বরবহুল। ‘অ্যাপ্লাই’ আর ‘নবকুমার ও এয়ারহোস্টেস’ কবিতাদুটি পড়লে বোঝা যায় নিজস্বতার বিরামহীন নিরীক্ষায় বিশ্বাস করেন কবি। অনেকটা ছড়িয়ে কথা বলতে চান তিনি, তাই বিভিন্ন অভিজ্ঞতার নির্যাস কবিতায় বুনে দিতে পারেন। ‘জুলাই মাসের রাস্তা’ কবিতায় দুতিন লাইনের অনেকগুলি স্বয়ম্ভর অংশ আছে  : ‘গ্রামের পুকুর ঘাট ধরে নেমে যাচ্ছি নীচে/এ কোথায় টানছো পূর্বজন্ম?/আয়নায় আমার প্রতিবিম্বরা অপেক্ষা করছে আজো’। কিংবা : ‘স্মৃতি আসলে উলের সোয়েটার/বৃষ্টিতে ভিজলেই ভারি হয়ে ওঠে’। একটি চাপা দার্শনিকতার টান তাঁর কবিতাকে ভেতর থেকে ধরে রাখে, ফলে কখনওই তা এলিয়ে পড়ে না। ঋজু ও স্বয়ম্ভর এই ধরনটি সৌম্যজিৎ-এর কবিতাকে এই সময়ের অন্যান্য কবিদের লেখা থেকে বিশেষভাবে আলাদা করেছে। মনন ক্রিয়েশানস প্রকাশিত বইটির ছাপা-বাঁধাই ঝকঝকে। 
কস্তুরী সেনের কবিতার ভাষা এই সময়ের কবিতার একটি সম্ভাবনাময় প্রচ্ছদ বলে আমার মনে হয়। ‘ধীরে, বলো অকস্মাৎ’ বইটির কবিতাগুলি পড়তে পড়তে বোঝা যায়, যে-কোনও শব্দকে  দক্ষতার সঙ্গে, সকৌতুক ঘূর্ণিসহ, কখনও চাপা সহাস্যে তিনি খেলাতে জানেন। কথার ভেতরে অন্তর্ঘাত বজায় রাখেন তিনি, সরাসরি পাঠকের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর মধুর আপত্তি আছে।  যেমন এখানে : ‘এ বর্ণ অছিলামাত্র,/এ অক্ষর শস্যদেহে বাসনার অপরূপ ভাষা,/এ উন্মাদ কটিবস্ত্রে/অধিক উন্মাদ রচে/ আমাদের সমরসুচারু ভালোবাসা’। অসামান্য! কখনও একটু ঝুঁকে, কিন্তু আত্মবিষময় : ‘অন্তরালে কোলের ওপর চিরকালীন গ্রীষ্ম লুটায়/ফুৎকারে তার দীপ নিভে যায়, অনন্যোপায় অনন্যোপায়!’। কবিতায় মাঝে মাঝেই কথাবার্তার চালু ধরনটি এনে বাঁক নিতে চান কস্তুরী, এখানে ওখানে বসিয়ে দেন গুপ্তহত্যাপ্রবণ কিছু শব্দ, ফলে একটি স্থায়ী ঝাকুনির ডৌল তাঁর কবিতা, সবসময়, সদর্থকভাবে ধারণ করে থাকে। ধানসিড়ির অন্যান্য বইয়ের মতোই ‘ধীরে, বলো অকস্মাৎ’-এর  সাজসজ্জাও ঝকঝকে, ক্ষুরধার। 
শাশ্বতী সান্যাল এই মুহূর্তে বাংলা কবিতায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দের সফলতম রূপকারদের একজন।  শুদ্ধ ও ধারালো তাঁর ধরন। ‘ব্রেইলে লেখা বিভ্রান্তিসমূহ’ বইটির প্রতিটি লেখাই উদ্ধৃতিযোগ্য। ‘কাপালিক’ কবিতাটি যেমন : ‘তোমার ভিতরে একটা পাথরের কাপালিক আছে/কত কত রাত আমি ঘুমিয়ে থেকেছি তার পায়ে/শুকনো জবার মতো/খিদে, তেষ্টা, ব্যাকরণ – কিছুই বুঝিনি’। খিদে, তেষ্টা –এমন দুটি আমিষ শব্দের পরেই ব্যাকরণ-এর মতো ধাতব শব্দ বসিয়ে কবিতাটির ডানা ছড়িয়ে দিলেন তিনি। কোনও কোনও কবিতায় চোরা আত্মকৌতুকের ধার রাখেন শাশ্বতী  : ‘বেশ সিনেমার মতো দুপুর এখন/রায়সাহেবের কুঠি মনে হচ্ছে পাশের বাড়িকে/স্মৃতিতে বটের চারা। ঝুরি নামে। শেকড় ছড়ায়’। নতুনতর কবিতাগুলিতে শাশ্বতী আরও নির্মম, আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছেন। বিশেষ করে  মিথের উচ্চারণ এমন অনায়াস হয়ে ওঠে তাঁর কবিতায়, পড়ে স্তম্ভিত হতে হয়।  এমন ধ্রুপদি প্রয়াস-এর জন্য তবুও প্রয়াসকে অভিনন্দন।  
 বেবী সাউ -এর কবিতায় যে উষ্ণ সংহতি, এই সময়ের বাংলা কবিতায় তা সুলভ নয়। সনেট লিখেছেন তিনি, কিন্তু সনেটের প্রকাশ্য খরতা উহ্য রাখার ক্ষমতা তাঁর সহজাত। 'শরীরে হেমন্ত দিন, ঝরে পড়ে পাতার শীৎকার / অকাল জলের স্রোতে, ভাসে শুভ বৃহস্পতিবার...'। এমন স্বচ্ছন্দ ঘূর্ণির কবিতা বারবার পড়তে সাধ  হয়।  কোনও কোনও কবিতায়  শব্দের শেষে যুক্তাক্ষর রেখে ( বিশেষ করে চরণের শেষ শব্দে) দুরূহ পরীক্ষা করেছেন বেবী, মধুরভাবে সফলও হয়েছেন। বইটির প্রকাশক আমাদের প্রিয় কবিবন্ধু ‘আবহমান’-এর  হিন্দোল ভট্টাচার্য। ‘ছয় মহলা বাড়ি’ নামে বেবীর পরের বইটিও বহুতল ও ঘনায়মান। ভেতরের দিকে টান এই বইয়ের কবিতাগুলিতে আরও বেশি। ‘ভোরের উঠোনে আজ, দেখো, জবা ফুটে আছে’ —এমন আলোকময় সরলতার পাশাপাশি, বরং, ‘নীলগাই এক হেঁটে যায় মোহানার দিকে/জাবরে লেগে আছে মাতৃগন্ধ/ঘাসপাতা’  জাতীয় সংহতির প্রতিই এই বইয়ের প্রশ্রয় বেশি।  এই বইটি নিয়ে পরে বড়ো করে লেখার ইচ্ছে রইল।  
 প্রথম দুটি বইয়ে উদ্যত অথচ  নিঃশব্দ উদাসীনতাকে প্রতিষ্ঠিত করে অরুণাভ রাহারায় তাঁর ‘খামখেয়ালি পাশবালিশ’  বইটিতে স্বরবহুল হয়ে উঠেছেন।  শান্ত অথচ স্বাধীন ভঙ্গিতে কথা বলেন তিনি, মাঝে মাঝেই দুরূহ এক একটি ঝলকে ভেতরের দিকে ভাঙচুর ঘটিয়ে  দিতে পারেন।  আগেই লিখেছিলেন তিনি: ‘ধোঁয়াশা ছড়িয়ে পড়ে, ঋতুমাঠে রঙ / যামিনী ঘনিয়ে আরও গাঢ় হলো আজ/ পাঁজরে নেমেছে যত নতজানু মেঘ’। মেঘের ‘নতজানু’ বিশেষণটির মধ্যে যে-নীরব রহস্যময়তা আছে, সেটা খেয়াল করার মতো। কিছুদিন ধরে সর্বস্ব দিয়ে প্রেমের কবিতা লিখছেন অরুণাভ, এই সৌন্দর্যময় সরণি তাঁকে কোন গন্তব্যে নিয়ে যাবে, সেদিকে আমাদের গভীর অভিনিবেশ রইল। বইয়ের নামটি যতই পরিবহনহীন হোক, এই বইটিতে সক্ষম কিছু কবিতা আছে, আছে এমন সব পাগল-করা লাইন : ‘কীভাবে আকাশ ভাঙো?/কীভাবে মেঘের পাশে খেলা?/ছাদের দুধারে আজ/ঘুড়ি-হাতে, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে—/তোমার আমার ছেলেবেলা’। ভাষালিপি এই বইটিও নিখুঁত যত্ন নিয়ে বের করেছে।  
চিরশ্রী দেবনাথের বইয়ের নাম ‘প্রেমে সন্ত্রাসে’।  আত্মকথনের স্বচ্ছন্দ প্রচ্ছদ তাঁর কবিতা। নিজের  জীবনের আলোছায়াময় অভিজ্ঞতার কথা কবিতায় বলার জন্য যে-নিপুণ মুন্সিয়ানা জরুরি, তা তাঁর আয়ত্ত্বে। ক্রমশ শব্দের অপূরণীয় সম্ভাবনার সখ্য  অর্জন করছেন তিনি।  তাঁর নিজস্ব একটি ধরন আছে, প্রত্যক্ষ ও উৎসুক এই ভঙ্গিটি তাঁর কবিতাকে আলাদাভাবে ধারালো করেছে। ‘সাদা জ্যোৎস্নার বিধবা শস্যভূমি’র মতো আশ্চর্য উচ্চারণের পাশাপাশি তাঁর কবিতায় থাকে ‘লাল বধ্যভূমি’র ঢেউ, ‘জলে, ঘামে, প্রেমে, বিষাদে, ঋতুস্নানে’ জীবনযাপনের ঘ্রাণ। কৈলাশহর, মনু নদী, পাহাড় লাইন, জুরী, বরাক, জাটিঙ্গা—উত্তরপূর্বের উর্বর ভূগোল ‘প্রেমে সন্ত্রাসে’ বইটির কবিতায় অনায়াসে স্পর্শ করার আনন্দ পাওয়া যায়।  নীহারিকা  এই বইটিও অত্যন্ত যত্ন নিয়ে প্রকাশ করেছে।     
দৃশ্যের অন্তর্গত সুসমাচার ধারণ করে কথা বলে ওঠে রিমি মুৎসুদ্দির  কবিতা : ‘তারপর একদিন তিনতলার ঝুল বারান্দার নীচে/ক্রমশ ঘন হয়ে জমা হওয়া শ্যাওলা আর আগাছাদের শিকড় জুড়ে/নতুন গল্প, নতুন ষড়যন্ত্র, নতুন ইতিহাস লেখা হবে’।  রিমি শান্ত আনন্দের সঙ্গে বলতে পারেন : ‘জলের কাছে পৌঁছে যাওয়া সব রঙিন পরাজয়গুলো/ছোট ছোট কাগজের নৌকায় ভেসে বেড়াবে’। কবিতায় জটিলতার উদ্বোধনে তাঁর আস্থা কম, সাদা কথায় সব অনটন ও নিশ্চয়তার কথা নিখুঁতভাবে ধরে দিতে জানেন তিনি। তাঁর কবিতার আড়ালে, এটাও বলা দরকার, একটি মেধাবী ও আত্মসচেতন মন সবসময় জাগ্রত থাকে। কলিকাতা লেটার প্রেস-এর যে-কোনও বইয়ের মতোই ‘মিথ্যে ছিলনা সবটা’ বইটিও প্রচ্ছদে-ছাপায়-বিন্যাসে সুঠাম। 
এই সময়ের বাংলা কবিতার বিভিন্ন ঘরানা কয়েকজন তরুণ  কবির লেখায় আনন্দের সঙ্গে স্পর্শ করলাম।

Post a Comment

0 Comments