আনন্দপাঠশালা

বন্ধুদাদার চিঠি

গতকাল স্বাধীনতা দিবস গেল বন্ধুরা। আর এই প্রথম এই বিশেষ দিনটিতে তোমাদের জন্য আমার নতুন করে মনখারাপ করল।

এই বিশেষ দিনে প্রতিটি স্কুলে স্কুলে তোমাদের উদ্যম, উৎসাহ আর আনন্দ থাকে চোখে পড়ার মতো। তোমাদের পতাকা উত্তোলন, তোমাদের প্যারেড, মিষ্টি খাওয়া... সব... সব কিছু ভরিয়ে রাখে আমাদের। আমরা তোমাদের চোখ দিয়ে দেখতে পাই আগামী পৃথিবীকে। কিন্তু এ বছর? এ বছর শিশুশূন্য বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সারা দেশের মাস্টারমশাই, দিদিমনিরা প্রথা অনুযায়ী পতাকা উত্তোলন করলেন। আমিও এমন একটি বিদ্যালয়ে অংশ নিতে গেলাম আর নতুন করে তোমাদের জন্য মনখারাপ নিয়ে ফিরে এলাম বাড়ি। তোমাদের আবার দেখবো। আবার ভ'রে উঠবে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ তোমাদের প্রাণপ্রাচুর্যে, এমন স্বপ্ন বুকে বেঁধে রাখি।

বন্ধুরা, কোভিড মুক্ত দেশ আমরা যেন ফিরে পাই, এই প্রার্থনা রাখি প্রতিদিনের মতো আজও আমাদের প্রকৃতিদেবতার কাছে। আজ আনন্দ পাঠশালায় আরেক ছোট্ট বন্ধু ‘ইস্কুল নেই’ সিরিজে লিখেছে তার মনের কথা। আর আছে গল্প কবিতা ছবির মালা। পড়ো আর আমাদের অবশ্যই জানাও কেমন লাগলো। ভাল থেকো এই অসময়ের দিনগুলোয়। সাবধানে থেকো। 

তোমাদের বন্ধুদাদা—

অঙ্কন রায়

(ছবি : সাইনা খাতুন, পঞ্চম শ্রেণি, রাহুল জ্যাক এন্ড জিল স্কুল, খয়রাশোল, বীরভূম)

ইস্কুল নেই/ ৫

নতুন দেশে উড়ে যেতে মন চায়

শুক্তিমা চক্রবর্তী 

এ বছর শুরুতেই বেশ আনন্দ হয়েছিল। নানা জায়গায় ঘুরেছিলাম। পিকনিক আর বসন্ত-উৎসবও হয়েছিল। ইস্কুল ভালভাবেই চলছিল৷ কিন্তু এরপরই করোনার জন্য সব কিছু বন্ধ হয়ে গেল। ইস্কুলও নেই। বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলোও নেই। নেই হই-চই, হাহা-হিহি। তাই খুব মন খারাপ। এরপর অনলাইনে ক্লাস শুরু হল। আবার দিদিমনিদের সঙ্গে দেখা হল। কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করা যায় না। সারাদিন এখন অনেক সময়। আমি উপরের ঘরে কম্পিউটার খুলে বসে থাকি। এটা খুব ভাললাগে। অনেক সময় হিজিবিজি লিখে সময় কাটাই। এর মধ্যে একা থাকতে থাকতে মন খারাপও হয়। জানলায় তাকিয়ে দেখি নীল আকাশে পাখিরা কুহুতান করে উড়ে যায়। ওদের বোধহয় ক্লান্তি নেই এবং করোনাও হয় না। ওদের সঙ্গে নতুন দেশে উড়ে যেতে মন চায়। তার মধ্যে দিদা কখনও ফোন করে। আমি নানান গল্প করি। এই করেই দিন কেটে যায়। 

তৃতীয় শ্রেণি, নব নালন্দা স্কুল, শান্তিনিকেতন

ছোটগল্প

রূপান্তর

পাপড়ি দত্ত

একরত্তি তুলোট সাদা মেঘটার খুউব মন খারাপ। আজ কাজলি মেঘের ওপর ভার পড়েছে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ার। 

এই এত্ত বড় আকাশটাতে ও যে বড় একা হয়ে পড়বে। বুকের ভেতর ঝড় ওঠে। ভাবনারা তোলপাড় হতে থাকে। যখন থেকে ও আকাশটাকে চিনতে শিখেছে, তখন থেকে কাজলিদিদির সঙ্গ ছাড়া হয়নি কখনও। এ পৃথিবীর আনাচ কানাচের কত ঘটনার সাক্ষী ওরা দুজনে। কি-ই বা হত কাজলিদিদি থেকে গেলে! পৃথিবীর তিনভাগ তো জলেই পূর্ণ, তবু বুঝি আশ মেটে না। ভীষণ অভিমান হয় ওর। দূর থেকে তাকিয়ে দেখে কাজলির ভেসে যাওয়া।

কাজলিদের জীবনটা বড় অদ্ভুত। সূর্যের সঙ্গে নীল পাহাড়ের প্রেমের কথা সকলেরই জানা। সেদিন পাহাড় চূড়ার দুধসাদা বরফের দেশে বেশ একটা রোমাঞ্চকর শিহরণ লাগল। সূর্যের উষ্ণ ভালবাসার আলিঙ্গনে জন্ম নিল কাজলি। এমন খুশির খবর শুনে সূর্যের রাঙা রোদ রংধনু রঙ ছড়িয়ে দিল আকাশের বুকে। 

পাহাড় কোলে কাজলির সঙ্গী বলতে শুধু মেঘের দল। কত কিছুর খবর জানে ওরা। নীল সাগরের খবর,  সবুজ বনের খবর,  আর সেই দেশটা যেখানে ওদের ঝরতে মানা। সে দেশের পোশাকি নাম মরুভূমি। শুনতে শুনতে কাজলি হারিয়ে যায়। ছুঁয়ে আসে সেইসব অদেখা দেশের মাটি। এভাবেই বড় হতে থাকে  কাজলি। মিষ্টি মায়ের দুষ্টু মেয়ের এখন আর এক মুহুর্ত পাথরের ঘেরাটোপে আটকে থাকতে ইচ্ছে করে না। মনের গভীর থেকে কে যেন তাকে বারেবারে হাতছানি দিয়ে ডাকে বলে, ‘চল কাজলি বেরিয়ে পড়ি’! 

সত্যি সত্যিই একদিন সব কিছুকে পেছনে ফেলে বেরিয়ে পরে কাজলি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটে যায় অজানার উদ্দেশ্যে। প্রথম প্রথম ভয় যে একটু করছিল না তা নয় কিন্তু এগিয়ে চলার প্রতিটা মুহুর্তে ভাললাগার অনুভূতিগুলো অদ্ভুত রকমের সুন্দর। কেমন যেন নেশা লেগে গেল। থামার কথা মনেই রইল না। ধীরে ধীরে সদা চঞ্চলা কাজলি কেমন শান্ত হয়ে পড়ল সমতলের মাটির স্পর্শে।

তখন কাজলি পূর্ণ যৌবনা। ওর কাঁচ স্বচ্ছ রূপের ছটায় ঠিকরে পড়ছে চাঁদ সূর্যের আলো। সবাই ডুব দিতে চায় ওর গভীরতায়। তবে ছুটে চলার নেশা ওকে বেশিদিন এক জায়গায় স্থির থাকতে দেয় না। পাহাড় জঙ্গল মাঠ ঘাট সবার ভালবাসা আঁজলা পেতে নিতে নিতে কেবলই এগিয়ে চলে অজানা লক্ষ্যের দিকে। তবে চলার পথে ওর মনও ভেঙেছে বেশ কয়েকবার।

সেদিন যখন মহুলডাঙার ঘোষেদের ছোটোবউ কলসি কাঁখে এসে বসেছিল ওর পাশে, অসহায়ের মতো বুক ভাসিয়ে শোনাচ্ছিল ওর হৃদয়ভাঙা হাহাকারের গল্প, দুমরে মুচরে একাকার হয়ে যাচ্ছিল কাজলির সজল মনটা... আর সেখানে দাঁড়াতে পারেনি কাজলি। ঘোষবউয়ের দুঃখের বোঝা ভাসিয়ে নিয়ে আছড়ে পড়েছিল উজানতলির ঘাটে।ওর দীর্ঘ চলার পথে এমন কত করুণ কাহিনী যে বুকে ধারণ করেছে তা বলে শেষ করা কঠিন। তবে প্রকৃতির আদর ভালবাসা ওর সমস্ত ব্যথা বেদনার উপশম ঘটিয়েছে নিমেষে।

শরতের স্নিগ্ধ ভোরে ওর মন ভাল করতে কাশেরা তার দুইপাড় সাজিয়ে দিয়েছে মনের মতো করে। চারিদিকে তখন সেজো সাজো রব। অসুরদলনি দুর্গামায়ের আগমনীর সুরে সুরে বুঁদ হয়ে আছে সকলে। তারপর কত আনন্দ দুঃখরা নৌকায় সওয়ার হয়ে পার হল এপার থেকে ওপারে। দশমীর দিন ঢাক ঢোল কাঁসর ঘন্টা বাজিয়ে ছেলেবুড়োর দল ‘আসছে বছর আবার এসো মা’ এই প্রার্থনা করে মা-কে বিসর্জন দিল কাজলির কাঁচস্বচ্ছ বুকে।

দিন পেরোয় মাস পেরোয় বছরের পর বছর ঘুরতে থাকে। এক আষাঢ়ের মধ্য রাতে প্রবল বর্ষণের ছন্দে ছন্দে পাগল হয়ে ওঠে কাজলি। শুরু করে প্রলয় নাচন। দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য কাজলির প্রবল আঘাতে জর্জরিত দুই পার যন্ত্রণা নিয়ে আছড়ে পরে তারই বুকে। ধীরে ধীরে সম্বিত ফেরে কাজলির। ওর নিজের ধ্বংসলীলার ছবি চোখ মেলে দেখার মত শক্তি জোটাতে পারেনা। ব্যথায় নীল হয়ে যাওয়া শরীরটা মুক্তি পাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে।  

সময় থেমে থাকে না। পূর্বকৃত ভুল শুধরে প্রায়শ্চিত্ত করে শুদ্ধ হয় কাজলি। সজীবতার বীজ বুনে নতুন করে সাজিয়ে তোলে কত শহর গ্রাম। এভাবে চলতে চলতে প্রৌঢ়ত্বের সীমানায় এসে প্রবেশ করে কাজলি। বয়সের ভারে এখন তার গতি স্তিমিত। ইচ্ছেরা ফিরতে চায় জন্মভূমির কোলে। আকাশের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে কাজলি। সবকিছু দেখে শুনে সূর্য আর চুপ থাকতে পারে না। পরম আদরে কাজলির সমস্ত দুঃখকে দহন করতে থাকে। সুখ দুঃখ, মোহ মায়ার জাল কেটে কাজলির মুক্তি ঘটে। মুক্ত কাজলি বাষ্প হয়ে নিশ্চিন্তে আশ্রয় নেয় নীল আকাশের এক কোণে। জন্ম হয় কাজলিমেঘের। নতুন জীবন নতুন খেলাঘর নতুন বন্ধুর আনাগোনা। এভাবেই একদিন তুলোট মেঘের সংস্পর্শে আসা। আবারও জড়িয়ে পড়া মোহমায়ার জালে। আজ সেই বন্ধনও ছিঁড়তে হল। নতুন করে কাজলি ফিরবে তার পুরোনো জীবনে হয়তো কোনও নতুন ঠিকানায়! সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে কত প্রাণের স্বপ্ন। তাদের টানেই বারে বারে ফিরতে হয় কাজলিদের।

ওদের মরণ হয় না কোনওদিন, শুধু যেটা ঘটে সেটা হল রূপান্তর!

কবিতা

দুপুরবেলা, নূপুরবেলা 

সৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায় 

সকাল থেকে মনখারাপ 

চা-কফিতেই ব্যস্ত কাপ!


দিন তো মোটেই মেঘলা নয়

আশায় আছি, একসময়...


বেশ, তা হলে, ডায়াল কর

অন্যরকম একটা স্বর...


না-জানি ফোন ভাবছে কী

পাঁচিলঘেরা চকমকি!


এই দুপুরে নূপুর কই?

ডিভানজুড়ে এক-শো বই...


তোর ইশারার মাপকাঠি

মন খেয়ে নিক একবাটি... 


আর যদি যায় মেঘ করে

তুই লিখে যা রোদ্দুরে...


ঝড়বাতাসের পূর্বাভাস?

বৃষ্টি নেব— হ্যাঁ, দাঁড়াস...

Post a Comment

0 Comments