নেইবাড়ির মেয়েরা/ ১

মেয়েবেলা হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। গোল্লাছুটের দুপুর এখন দিগন্তের পাখি। একলা আঁধারে মুখ নেমেছে পথের হাওয়ায়। বাহির থেকে ঘরে ফেরার অশ্রুতপূর্ব-কথার আখ্যান। নেইবাড়ির মেয়েরা। লিখছেন অঙ্কন রায়

আমাদের না শহর না গ্রাম এই কোপাই নদীর ধার ঘেঁষা জনপদটার নাম সবুজবাগ। আর আমরা যে বাড়িতে থাকি সেই বাড়িটার নাম ‘আলোকবর্তিকা’। যেমন সুন্দর জায়গাটার নাম তেমনি বাড়ির নামটাও সুন্দর। আমাদের বাড়ির পিছনেই আছে অনেক অনেকটা জায়গা জুড়ে ইউক্যালিপটাস আর সোনাঝুরির বন। সেই বনের দিকের জানলাগুলো হাট করে খুলে রেখে আমি আর আমার মত আরও মেয়েরা ওই সুদূর নিরিবিলিতে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকি। আমাদের বাড়ির পিছনের বাউন্ডারিতে ছোট পাঁচিলের উপর লোহার রড দিয়ে পিলারের মত করা আছে। সেগুলো তারকাঁটা দিয়ে আটকানো। তাই জানলা খুলে রাখলে বাইরের বন পুরোটাই পরিষ্কার দেখা যায়। আমরা মেয়েরা যখন খুশি ওই জানলায় দাঁড়িয়ে ইউক্যালিপটাস আর সোনাঝুরির ফাঁক গ’লে দূরের নিশ্চিহ্নগ্রামে হারিয়ে যাই মনে মনে। আমি মাঝে মাঝে গান গাই ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা.... মনে মনে... মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা.... মনে মনে....
আজ সকালে আমাদের বাড়ি ‘আলোকবর্তিকা’য় কবিগুরুর জন্মদিন পালন করা হল। আমাদের এই বাড়িটা আমার মত ছোট বা একটু বড় পঁচিশজন মেয়ের বাড়ি। মানে আমরা পঁচিশটা মেয়ে এখানে হেসে, খেলে, গান গেয়ে, পড়াশোনা ক’রে দিন কাটাই। আর আমাদের বন্ধু দাদা দিদিরা দেবদূতের মতো আমাদের এই ভালো ভালো জিনিষ গুলো শেখাতে আসেন। তারা আমাদের নিয়ে অনুষ্ঠান করেন... বাইরে কখনও সখনও পিকনিকে নিয়ে যান... গল্প... খেলা... পড়া... সব... সব হয় ওঁদের ঘিরে।
আমি অহনা। ক্লাস নাইনে পড়ি। আমাদের আলোকবর্তিকা’র কাছেই একটা মেয়েদের স্কুল আছে। সেই স্কুলে আমি পড়ি। স্কুলের চারদিকটা উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তার ভেতরে আমরা নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করি। খেলি। পড়া করি।... বাইরের কোনও বিপদ, কোনও খারাপ লোকজন আমাদের এখানে এসে ছুঁতেও পারেনা। স্কুলে যাওয়া আসার পথে আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যান মালবিকা মাসি। এই মাসি আমাদের পঁচিশটা মেয়েকে সারাক্ষণ মানে সারা দিন রাত দেখাশোনা করেন। রান্নাঘর সামলানো তমালদাদার তদারক করা... সময়ে সময়ে আমাদের পড়াতে আসা, গান কবিতা শেখাতে আসা দাদা দিদিদের আপ্যায়ন করা, চা দেওয়া... সব করেন এই মালবিকা মাসি। আমাদের ভালোও বাসেন খুব। রাতে মাঝে মাঝে আমরা পঁচিশটা মেয়ে এক জায়গায় জড়ো হয়ে মাসির কাছে ভূতের গল্প, ইতিহাসের গল্প, সামাজিক গল্প... খুব মন দিয়ে শুনি আর আনন্দ পাই। খুব খুউব আনন্দ পাই।
আমি পড়াশোনায় ভালো। আমাদের বাড়ির পঁচিশটা মেয়ের মধ্যে আমি সেরা, এ কথা চিত্রভানুদাদা আমাদের পড়াতে এসে প্রায়ই বলেন। স্কুলে ফার্স্ট সেকেন্ড হইনা ঠিকই কিন্তু এই পঁচিশ জনের মধ্যে সেরা। আমি মাঝে মাঝে কবিতা লিখি... দু একটা গল্পও লিখেছি। সেগুলোর খবর বন্ধুরা ঠিক চিত্রভানুদাদাকে বলে দিয়েছে। আমি ওঁকে ছোট করে ভানুদাদা বলে ডাকি। তো ভানুদাদা আমার এই সব গোপন গুণের কথা জানতে পেরে আজ সকালে রবি ঠাকুরের জন্মদিনে আমায় দিয়ে একটা আমার নিজের লেখা কবিতা পড়িয়েছেন। আমি প্রথমে খুবই লজ্জা পাচ্ছিলাম। তারপর হঠাৎ এক সময় আড়ষ্টতা ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে মাইকের সামনে গড়গড় করে মুখস্ত বলে গেছি আমার লেখা কবিতা ‘কবি রবি’। অনেক বাইরের লোকজন, বিশেষ মানুষ সব এসেছিলেন আমাদের আলোকবর্তিকা’র সামনের মাঠে বাঁধা প্যান্ডেলের নীচে। সার সার চেয়ারে বসেছিলেন সবাই। আমার কবিতা পড়া হতেই এক সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে সে কি হাততালি ওঁদের। অনেক প্রশংসা পেলাম। আদর পেলাম। তারপর দুপুরে একটু নিরিবিলিতে আমায় একা পেয়ে মাথায় স্নেহের হাত রেখে ভানুদাদা বললেন, ‘অহনা, তুই একটা উপন্যাস লেখ। বানানো গল্প নয়। তোদের জীবনের গল্প। সেই গল্প জুড়ে জুড়ে তৈরী হবে ছোটদের উপন্যাস। আমি হলফ করে বলতে পারি এমন ছোটদের উপন্যাস আজ পর্যন্ত কোনও বাঙলার লেখক লিখে উঠতে পারেন নি। তুই পারবি। আমি জানি। কারণ তোর জীবন, তোদের জীবন আর পাঁচটা সাধারণ আদরযত্ন পাওয়া নিরাপদ বাঙালী মেয়ের জীবন নয়। তুই লেখা শুরু কর।’
আমি ভানুদাদার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম ওঁর চোখে কি প্রত্যয়, কি বিশ্বাস আমাকে নিয়ে। আমি বললাম, ‘আমি চেষ্টা করব দাদা। আমি লিখতে বসবো। আজ থেকেই লিখতে বসবো আমাদের ছোটদের উপন্যাস।.....

সপ্তমীর হাট গ্রামে আমি আর আমার মত আরও চার পাঁচটি ছোট মেয়ে খুব আনন্দে হই হুল্লোড়, লেখাপড়ার মধ্যে বড় হচ্ছিলাম। আমার বাবা ছিলেন ওই গ্রামেই প্রাইমারি স্কুলের হেডসার। আমাদের যত্নে, আদরেই বড় করছিলেন আমার বাবা মা...। আমার একটা ছোট ভাই ছিল। অনিশ। ও আমার থেকে দু কি আড়াই বছরের ছোট। ওকে নিয়ে আমার বান্ধবিদের মজা করার অন্ত ছিলনা। ভাইকে দেখতে খুব মিষ্টি ছিল তো, তাই সবাই ওকে খুব ভালোবাসতো। আদর করতো। আমি বোধহয় ততটা ভালো দেখতে ছিলাম না। তাই আমার ভাগে আদরের পরিমাণ একটু কমই থাকতো।
আমি যখন ক্লাস ফাইভে উঠি, বাবার প্রাইমারি স্কুল থেকে বেরিয়ে তখন আমায় যেতে হল পাশের গ্রাম হাসভাসায়। ওখানকার হাইস্কুলে ভর্তি হবার পর আমায় প্রথম প্রথম কিছুদিন সাইকেলে চাপিয়ে নিয়ে যেত আমাদের পাশের বাড়ির ঋজু দাদা। ঋজুদাদা বাবার পুরোনো ছাত্র। বাবা ওকে ছোট থেকে পড়িয়েছেন। এখন ও ক্লাস টেনে পড়ে। বাবা ওকে দিয়ে নানান কাজ করান। ও বাধ্য ছাত্রের মত সব করে দেয়। বাবা তো নিজের স্কুলের কাজে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন, তাই আমায় ঋজুদাদার সঙ্গেই সাইকেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন পাশের গ্রামের স্কুলে। ওখানে ঋজুদাদাও পড়তো।
মা ভাইকে নিয়ে বেশি বেশি ব্যস্ত থাকতেন বলে আমায় তেমন সময় দিতে পারতেন না। তাছাড়া ভাই তো আমার চেয়ে দেখতে অনেকটা মিষ্টি...
কিছুদিন যাওয়া আসার পর ঋজুদার আচরণে একটা পরিবর্তন বুঝতে পারলাম। ও আমাকে সাইকেলের পিছনের কেরিয়ার থেকে নেমে একদিন সামনের রডে বসতে বলল। তখন আমরা হাসভাসার রাস্তায় মাঝামাঝি। আমি বললাম, ‘সামনে বসলে তুমি চালাবে কি করে ঋজুদাদা? আমি তো এখন বড় হয়ে গেছি। তোমার হাত আটকে যাবে। সামনেটা দেখতে পাবেনা।’
ঋজুদাদা বললো, ‘কোনও অসুবিধে হবে না রে। দেখ না, পিছনের চাকাটায় হাওয়া কম। পাম্প দিতে ভুলে গেছি। আজ একটু কষ্ট করে সামনে বোস। আমি ঠিক চালাতে পারবো।’
আমি সামনের রডে এসে বসলাম। একটু অসুবিধে হচ্ছিল তো ঠিকই, কারণ গত চার পাঁচ মাসের মধ্যে আমার রোগা টিঙটিঙে চেহারাটা হঠাৎ একটু মোটাসোটা হয়ে গেছে। একটু অস্বস্তিও হচ্ছিল। ঋজুদাদা তবে ঠিক কায়দা করে সুন্দর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সাইকেলটা।
ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ঋজুদাদা আচমকা বললো, ‘তোকে বাড়িতে কেউ ভালোবাসেনা। না রে? তোর ভাই বেশি বেশি আদর নিয়ে নেয়।’ আমি বললাম, ‘ঠিক বলেছো ঋজুদাদা। আর আমার বান্ধবিগুলোও খুব খারাপ। এতদিন একসঙ্গে পড়লাম, এখন আর একসঙ্গে বড় স্কুলে যাবে না। বলে বেশি পড়ে কি হবে? তুই তো পন্ডিত হবি। তুই যা। ‘ ওরাও কেউ আমায় ভালোবাসেনা।’
ঋজুদাদা আমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, তারপর বললো, ‘আমি কিন্তু তোকে খুব ভালোবাসি রে অহনা। তুই বুঝতে পারিস না? এই দ্যাখ, তোকে রোজ ইস্কুলে নিয়ে যাই। নিয়ে আসি। তোর জন্য কোনও বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে ছুটির সময় গল্প করি না তোর বাড়ি ফিরতে দেরী হয়ে যাবে বলে। তাই না?’
আমি চুপ থেকে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেছি। কেন জানি না ঋজুদাদার কথাগুলো আমার মনের মধ্যে একটা অকারণ ভালো লাগার শিহরণ জাগিয়ে তুলছিল। আমি বললাম, ‘সত্যি ঋজুদাদা! তুমি আমায় ভালোবাসো? ‘
ঋজুদাদা হঠাৎ করলো কি, নিজের ডান হাতটা সাইকেলের হ্যান্ডেল থেকে সরিয়ে সরাসরি আমার বুকের ওপর রাখলো। মাত্র কিছুদিন হয় আমি মোটা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকটাও কেমন অন্যরকম হয়ে উঠেছে। বোধহয় আর একটু বড় হলে আমার মায়ের মতন হয়ে যাবে। আমি তো মেয়ে। মেয়েরা মায়ের মতই হয়ে যায়। তাই ও আমার বুকে হাত রাখায় আমার ভিতরটা কেমন কেঁপে উঠলো। একটু ভালো লাগা আর অনেকটা ভয় কেন জানিনা আমার বুকটায় চেপে বসলো। আমি কোনো কথা বলতে পারছিলাম না। ঋজুদাদার ডান হাতটা আমার বুকের ওপর থেকে সরছেই না। বরং আরও চেপে বসছে। ওর নিঃশ্বাস ঘন ঘন পড়ছে আমার ঘাড়ের কাছে। একটা ঘোরের মধ্যে কখন যে স্কুলের কাছাকাছি চলে এসেছি, টেরই পাইনি।...

আলোকবর্তিকা’র জানলা দিয়ে দেখছি পিছনের সোনাঝুরি বনে কয়েকজন বাউল হাতে একতারা নিয়ে বসে বসে সুর বাঁধছে। ওদের মাঝখানে আমাদের ভানুদাদা। দাদা যেন মত্ত বাউল এক! ওই একতারার সুরে সুরে... ওই বাউল দাদাদের সঙ্গে গুন গুন করে গাইছে...মিলন হবে কত দিনে... আমার মনের মানুষেরই সনে... ও আমার মনের মানুষেরই সনে...
পাশের ঘর থেকে পুষ্পি এসে বলল, ‘চল, খাবি না? কখন স্কুল থেকে এসেছিস। এখনও ড্রেস ছাড়িস নি? মালবিকা মাসি দেবে না এমন! শিগগির চল।’
আমি মনে মনে ভাবছিলাম আজ তো ভানুদাদার গান শেখাতে আসার দিন। আর এসেই বলবে আমি লেখা শুরু করেছি কিনা। যেটুকু লিখেছি, তা কি দেখানো যায় ভানুদাদাকে? দাদা কি খুব নিন্দে করবেন আমার লেখার? কিন্তু আমি কি আর লিখবো? আমার, আমাদের ছোটবেলা তো এমনই। আর আর যে সব ছোটদের লেখা, গল্প, কবিতা পড়ি, তার সঙ্গে যে মেলে না আমাদের জীবনের গল্প।... অবশ্য সে সব কথাই তো লিখতে বলেছেন ভানুদাদা আমার ছোটদের উপন্যাসে। আমার তো না লিখে উপায়ও নেই।
পুষ্পি’র সঙ্গে গিয়ে তাড়াতাড়ি হাত পা ধুয়ে খাবার নিয়ে বসলাম মালবিকা মাসির সামনে। মাসি বলল, ‘কি রে? তাড়াতাড়ি তৈরী হবি না? একটু পরেই তো চিত্রভানু চলে আসবেন। তখন কি তোদের জন্য উনি অপেক্ষা করে বসে থাকবেন?’
চুপচাপ খেয়ে নিতে নিতে মনে ঘুরপাক খাচ্ছে ভানুদাদাকে লেখাটা দেখাবো কি দেখাবো না। শেষমেশ মন বলল, ‘আরও খানিকটা এগোক লেখা। তারপর দেখাবি।’ আপাতত তাই শান্ত হয়ে খাবার খেয়ে, মুখ আঁচিয়ে পরিপাটি করে বসতে গেলাম গানের ঘরে। ওখানে আগে থেকেই সেজে গুজে বসে আছে শর্মিলা... চানা... পদ্মা... মিনটিরা। সবার সামনে মেলে ধরা আছে গানের খাতা।
ভানুদাদা আসতেই চোখে চোখে কথা হয়ে গেল আমাদের। দাদাকে চোখ বুজে আস্বাস দেওয়ার ভঙ্গীতে বুঝিয়ে দিলাম আমি লিখছি।
মিলন হবে কত দিনে..... আমার মনের মানুষেরই সনে.... ও আমার মনের মানুষেরই সনে..... ভানুদাদা একটু আগেই আমাদের বাড়ির পিছনে সোনাঝুরি বনে বসে গাইছিলেন বাউলদাদাদের সঙ্গে। আমি বললাম, ‘দাদা, ওই গানটা শোনাও না, ওই যেটা একটু আগে শিখছিলে ওই ওপাশে।’ দাদা বললেন, ‘ধুর বোকা মেয়ে। ও গান কি আমি গাইতে পারি? ও হল বাউল রাজাদের গান। ও গান গাওয়ার অন্য গলা চাই। আমি ভালোবাসি বলে ওখানে গিয়ে মাঝে মাঝে বসি। একটু গুনগুন করি।’
একটু পরে ভানুদাদা চোখ বন্ধ করে গাইতে আরম্ভ করলেন, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁওয়াও প্রাণে....’। আমরাও ওঁর সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে গাইতে শুরু করলাম আমাদের সন্ধেবেলার প্রার্থনাগান। ততক্ষণে পঁচিশটা মেয়ে এসে বসে পড়েছে দাদার চারদিকে গোল হয়ে। সমবেত স্বরে গানের ঘর গমগম করছে, ‘এ জীবন পুণ্য করো, এ জীবন পুণ্য করো, এ জীবন পুণ্য করো দহন দানে....’!           
      (ক্রমশ)
শিল্পী : অর্চিতা মুন্সী



Post a Comment

0 Comments