লকডাউনের দিনলিপি

সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে রোজ 


রূপক বর্ধন রায় (ফ্রান্স থেকে)


রাতটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। ২৫শে জুলাই ২০১৬, ইস্তানবুল।শহর থেকে ইউনিভার্সিটি, বেশ খানিকটা দূরে।
ক্যাম্পাসেই পাশাপাশি দুটো বাড়ির ফ্ল্যাটগুলোয় পি এইচ ডি ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা। বিগত ১৬ ঘন্টা ল্যাবে কেটেছে। কোনওক্রমে নাকে মুখে কিছু গুঁজে দুজনে একটা সিনেমা নিয়ে বসেছি। বসার ঘরের হঠাৎ শোরগোলে বেরোতেই হল। টিভির সামনের ভিড় কোনওক্রমে সরিয়ে দেখি, সিএনএন দেখাচ্ছে বসফরাস ব্রিজ ভেসে যাচ্ছে ট্যাংক আর বন্দুকধারী সৈন্যে। মুহুর্মুহু গুলির আর কুচকাওয়াজের শব্দ। ফেসটাইমে প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ানের টার্কিশে বিবৃতি। পরিষ্কার কিছু বোঝার আগেই আয়কুট বললো; “রূপক, মনে হচ্ছে মিলিটারি কু।” 
আগেও শুনেছি, ঐতিহাসিক তুরস্ক, সামরিক কু দেখেছে একাধিকবার। তা বলে একেবারে চোখের সামনে? হয় নাকি? ঠেলা মেরে আয়কুট বললো “এটিএম চল, টাকা তুলে রাখার দরকার”। গিয়ে দেখি কু শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এটিএমের সার্ভার বন্ধ করা হয়েছে। ফিরে এলাম। সারাটা রাত কাটলো প্রচণ্ড ভয়ে। মাথার উপর দিয়ে পর পর উড়ে গেছে হেলিকপ্টার। বসার ঘর কেঁপেছে টিভিতে দেখানো গুলি আর বোমার শব্দে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে বিদ্রোহী সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সাধারণ মানুষ এবং রাষ্ট্রীয় সেনার সংঘাত আর একাধিক মৃত্যুর খবর। পরেরদিন সকাল সকাল বাজার ছুটেছি। ইউনিভার্সিটি ছেড়ে বাইরে বেরনোর উপায় নেই। ক্যাম্পাসে একটাই দোকান। কিলোমিটার খানেক লাইনের পর কুড়িয়েবাড়িয়ে যা পাওয়া যা। একটাই ছোটো ডাক্তারখানা তাও বন্ধ। আরো বেশ কিছু দিন এইভাবেই কেটেছে। ক্যাম্পাসে ছিলাম, তাই ল্যাবে কা্জে গেছি ঠিকই তবে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফেরত যেতে পারেনি গোটা ইউনিভার্সিটি। হপ্তা তিনেক পরে শহর নিজের গতিতে খানিকটা ফিরলেও গোটা দেশ থমকে গেছে বছর কয়েক। তুরস্ক বেশ খানিকটা পিছিয়ে গেছে এর্দোয়ানের লৌহমুষ্টির চাপে। এই ঘটনার আড়াই বছর পরে ও দেশ ছেড়েছি। তারপর বছর খানেক জার্মানিতে কাটিয়ে ফ্রান্সে এসে ঘাটি গেড়েছি হালেই। আজ ২৯শে মার্চ, ২০২০। দুঃস্বপ্ন পেছন ছাড়ে না! 
সংখ্যাটা বেড়েই চলেছে রোজ। বিগত দেড় মাসে শুধু মাত্র ফ্রান্সে করোনা (COVID-19) আক্রান্তের সংখ্যা ৭ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭৫০০র বেশি। মৃতের সংখ্যা ১ থেকে প্রায় ২০০০। ঝামেলার সূত্রপাত মালহাউসে ২০০০ এভাঞ্জেলিকাল ক্রিশ্চানদের কনফারেন্সের হাত ধরে। রাস্ট্র তার নাম দিয়েছে করোনা বম্ব। সেই ২০০০-এর বেশ কিছু সংক্রামিত ছিলেন। তারাই ছড়িয়ে পড়েছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সম্পূর্ণ লকডাউন চালু হয়েছে মৃতের সংখ্যা ১৪৮ ছুতেই। ২ সপ্তাহের বেশি হল স্কুল, কলেজ, অফিস প্রায় সমস্ত কিছুই বন্ধ। রাস্ট্র সন্ত্রস্ত, মানুষ সন্ত্রস্ত, এ যেন এক যোদ্ধার সহনক্ষমতার, ধারণক্ষমতার পরীক্ষা। অনেক মানুষ দিনের শেষের খাবারটুকু কতদিন আর পাবেন সেই চিন্তায় চিন্তিত। আমরা যারা চাকুরীজীবী, তারা ভীত অনেক কষ্টে অর্জিত জীবনের সম্বলটুকু যুদ্ধে হারানোর উতকন্ঠায়। তার মাঝেই দাঁতে দাঁত চেপে নিঃশব্দে লড়ে যাচ্ছেন স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা আর গ্রসারীস্টোরের মানুষগুলো।
সব করছেন ম্যাকরন। তাঁর কিছু ভুল, কিছু ঠিক। শুরুর দিকে মানুষের মাঝে নিজে পৌছে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন স্বাভাবিক জীবন সম্ভব। আবার নিজেই ইটালির দিশায় যাতে না যেতে হয় তাই তাদের তুলনায় অনেক আগেই স্তব্ধ করেছেন দেশকে। সবশেষে বলেছেন, একনায়ক্তন্ত্রে না পৌছে গণতন্ত্রের হাত ধরে এই সঙ্কট পেরনো যায় কিনা সেটাই আসল যুদ্ধ।তুরস্কে কু পরবর্তী বছরগুলোয় একটা অশান্তি মনে মনে কাজ করেছে ক্রমাগত; এই শেষ তো? তবু কোথাও মনে হয়েছে রাজনৈতিক ঝড় তো, মানুষ চাইলেই থামাতে পারে।
কিন্তু এক্ষেত্রে? এই মৃত্যুপথযাত্রা মানুষের আয়ত্বের বাইরে। সবশেষে স্তব্ধ হলেও একটা প্রশ্ন আমাদের তাড়া করে বেড়াবেই। এই শেষ তো? সময়ই শুধু তার উত্তর জানে। আর জানে মানুষের বাচতে চাওয়ার অদম্য ইচ্ছা। 
‘‘হাস্তা লা ভিক্টোরিয়া, সিয়েম্প্রে!’’

Post a Comment

0 Comments