ধারাবাহিক উপন্যাস

মেয়েবেলা হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। গোল্লাছুটের দুপুর এখন দিগন্তের পাখি। একলা আঁধারে মুখ নেমেছে পথের হাওয়ায়। বাহির থেকে ঘরে ফেরার অশ্রুতপূর্ব-কথার আখ্যান। নেইবাড়ির মেয়েরা। লিখছেন অঙ্কন রায়


চার
হাসভাসার রাস্তায় ঋজুদাদা আমার সঙ্গে আরও কয়েকদিন ওরকম কাণ্ড করল। একদিন তো হঠাৎ ধানক্ষেতের নিরিবিলিতে সাইকেল থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল একটু ভিতরের দিকে। আমায় জড়িয়ে ধরে নিজের ঠোঁটটা আমার ঠোঁটের ওপর চেপে রেখে অনেকক্ষণ পর্যন্ত চুমু খেল। আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। মুখটা ছাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু যত চেষ্টা করি ততই শক্ত করে আমার ঘাড়ের কাছটা দু’হাতের দশটা আঙুল দিয়ে আঁকড়ে ধরে। আমার মুখ দিয়ে শুধু একটা গোঙানির আওয়াজ বেরোচ্ছিল। কথা বেরোচ্ছিল না।
এক সময় ওর বোধহয় শখ মিটতে ও আমার মুখটা ছেড়ে দিয়ে হাঁফাতে লেগেছে। আমি কোনও রকমে কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, ‘তুমি এরকম কেন কর আমায় ঋজুদাদা?’
ঋজুদাদা বলল, ‘কি করলাম আমি? তোকে কেউ ভালবাসে না। আর আমি এই এত্তো এত্তো ভালবাসি। তাই তো এত আদর করি তোকে’।
আমি বললাম, ‘ভাইকে তো সবাই কত্তো আদর করে। কই ওকে তো কেউ এরকম করে না?’
ঋজুদাদা বলল, ‘ও হল গিয়ে ছেলে। আর তুই মেয়ে। দু’য়ে তফাৎ থাকবে না? আর একটু বড় হলেই বুঝবি কেন আমি তোকে এরকম করি। তখন তুইও আমায় এরকমই আদর করবি। চল এখন স্কুলে চল। আর এসব কথা কাউকে গল্প করবি না। তাহলে আমিও আর তোকে ভালবাসব না’।
সেদিন স্কুলে একটুও মন বসলো না। শুধু মনে হচ্ছিল মেয়ে বলেই আমাকে আদর করার ধরণটা অন্য রকম হয়ে যাবে? হয় কেউ ভালবাসবে না, আর না হয় ঋজুদার মতো ভালবাসবে?
বাড়ি ফিরে সেদিন রাতে পুরো ঘটনাটা মা-কে না বলে পারলাম না। ঋজুদাদার মানা সত্ত্বেও না। মার মুখটা সব শুনে থমথমে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, ‘এত সব কথা তুই এতদিন বলিসনি? কাল থেকে তোর স্কুল যাওয়া বন্ধ’।
পরদিন বাবার সঙ্গে মা বোধহয় এই নিয়ে বেশ কিছু আলোচনা করেছেন। কারণ সকাল থেকে ওঁদের দুজনকেই বাইরের বৈঠকঘরে বসে চাপা গলায় আলোচনা করতে শুনেছি, দেখেছি। কি কথা বলাবলি হচ্ছিল তা অবশ্য বুঝতে পারিনি। তবে একটু বেলার দিকে যখন স্কুল যাওয়ার সময় এগিয়ে আসছে, বাবা গম্ভীর গলায় তাঁর ঘরে আমায় ডেকে পাঠালেন। সামনে যেতেই বললেন, ‘তুমি অনেক কথা আমাদের লুকিয়েছ মামণি। এমন ঘটনার কথা পাড়া গাঁয়ে জানাজানি হয়ে গেলে আমার মানসম্মান সব ডুবে যাবে। তখন হাসভাসার বিলে আমার ডুবে মরা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। তুমি আজ থেকে বাড়িতেই পড়াশোনা করবে। বাইরে কোথাও, কোনও স্কুলে যাওয়ার দরকারই নেই। আর ঋজুকে আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে দেব না। তোমায় যেন কখনও ওর সঙ্গে কথা বলতে না দেখি’।
আমি কি করেছি নিজেই বুঝতে পারলাম না। কিন্তু আমার স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কয়েকদিন তো মা প্রায় নজরবন্দী করে ঘরের মধ্যেই আমায় আটকে রাখলেন। তারপর একটু আধটু বাইরে বেরোলেও ওই তিন চারজন স্কুলছুট বান্ধবীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলা, গল্প করা আর চটপট বাড়ি ফিরে আসা হয়ে গেল আমার দৈনিক রুটিন।...

পাঁচ
পুষ্পি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরের পীচ রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে হাঁক দিল, ‘অহনা... একবার শুনে যা...! দেখবি আয় একটা লোককে...!’
আমি তারে কাপড় মেলছিলাম। ওর দিকে আড় চোখে চেয়ে বললাম, ‘আসছি দাঁড়া। অত তাড়া দিলে হবে না’। পুষ্পি বলল, ‘ধুর ট্যালা, তাড়াতাড়ি না এলে দেখবি কি করে ওকে? ও কি দাঁড়িয়ে থাকবে তোর জন্য?’
এবার আমি বুঝতে পেরে ছুট্টে গেলাম পুষ্পির পাশে। ওর দেখার সঙ্গে চোখ মিলিয়ে দেখতে পেলাম ওই দূরে তেমাথার মোড়ে একটা তালঢ্যাঙা লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধুমপান করছে। পুষ্পি বলল, ‘ওটাই! ওই লোকটাই আমায় বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছিল দ্বারভাঙ্গায়। আমি যদি না সেই সময় পালিয়ে আসতাম, আজ আর তোদের এই পুষ্পি থাকতো না রে! কোথায় মরে হেজে যেত’।
আমি বললাম, ‘চুপ কর। ও সব কথা আর মনেও আনবি না। যা হয়ে গেছে তা গেছে। এখন তো তুই জলে পড়ে নেই! আমাদের আলোকবর্তিকা আছে। আমাদের মালবিকা মাসি আছে। ভানুদাদা আছে। সবার ওপরে তোর নিজের, এক্কেবারে নিজের চব্বিশজন বান্ধবী আছে। এত কিছু ক’জনের থাকে বলতে পারিস? বল বল বলতে পারিস?’
পুষ্পির গল্পটা করুণ। তবে করুণতম হতে হতে বেঁচে গেছে। ওর বাড়ি এই সবুজবাগের অদূরেই একটা গ্রামে। অদ্ভুত নাম গ্রামটার। টহলদারি গ্রাম। পুষ্পিরা পাঁচ বোন। ওর বাবার তেমন একটা রোজগারপাতি ছিল না। এই অবস্থার লোকগুলোর যা হয়, এখানেও তার অন্যথা হল না। যে কোনও লোক ধরে এনে বিয়ে দিয়ে দিতে পারলেই মাথা থেকে বোঝা নামে। পুষ্পির বাবা ওর বড়দি দুর্গার বিয়ে দেওয়ার জন্য ওই তালঢ্যাঙা লোকটাকে কোত্থেকে যেন খুঁজে পেয়েছিল। কিছুই করে না লোকটা। শুধু শোনা গেছে কোনও এক বড় কোম্পানির সিকিউরিটি গার্ডের হয়ে মাঝে মাঝে খেটে দেয় ওর জায়গায়। এতেই বাতেলা দারুণ।
সেই লোক তো পুষ্পির দিদিকে দেখতে এল। আর ওর চোখ পড়বি তো পড় পুষ্পির ওপরেই প’ড়ে স্থির হয়ে গেল। নড়েও না, চড়েও না। পুষ্পির বাবা বুঝেছে এ মালের ওর মেজ মেয়েকে মনে ধরেছে। মুখটা বেশি মিষ্টি কিনা! তা ওর মনোভাব বুঝে নিয়ে পুষ্পিকেই পাত্রস্থ করতে ওদের বাবার বিন্দুমাত্র দ্বিধা হল না। আর মা তো কলের পুতুল। বাবা যা বলবে, করবে, সেটাই ফাইনাল। মা’র কাজ শুধু বাবাকে সায় দিয়ে চলা।
তা সেই তালঢ্যাঙার সঙ্গেই ড্যাঙ ড্যাঙ করে একদিন বিয়ে হয়ে গেল পুষ্পির। ওর বয়স তখন মাত্র এগারো বছর। পুরোনো কালিতলার মন্দিরে নিয়ে গিয়ে তালঢ্যাঙা পুষ্পির কপালে লেবড়ে সিঁদুর মাখিয়ে দিল। ব্যাস, পুষ্পি ওর সম্পত্তি হয়ে গেল। এখন ওকে নিয়ে যা খুশি করা যায়। আদর করা যায়... পেটানো যায়... বিক্রি করে দেওয়া যায়...!
তা সে বিক্রিই হয়ে যাচ্ছিল আর একটু হলেই। দু-চারদিন ওর অল্পবয়সী ছোট্ট কচি শরীরটাকে নিয়ে যা খুশি ভাবে উল্টে পাল্টে খেলা ক’রে যখন মন ভরে গেল তালঢ্যাঙার, তখন একদিন রাতে তিন-চারজন সাগরেদের সঙ্গে শলা করছিল সে নীচু গলায়।
কি ভাবে পুষ্পিকে দ্বারভাঙ্গায় বেচে আসা যায়, তাই নিয়ে প্ল্যান কষছিল। ভাগ্যিস সব কথা পুষ্পি আড়াল থেকে শুনে নিয়েছিল। প্রাণপণ চেষ্টায় সে রাতেই পালালো ও। তালঢ্যাঙার চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। তবু পালাতে পেরেছিল। অনুকূল ভাগ্যের জোরে আলোকবর্তিকায় সেই রাতেই ঠাঁই মিলেছিল পুষ্পির। সেই থেকে আজ পাঁচ বছর পুষ্পি আমাদের বাড়িতে। আমার চেয়ে একটু বড়। ক্লাস টেনে পড়ে। ওর বাবা ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি বাড়ি। একে মানুষটা মূর্খ, নিরক্ষর। তাই পরিবারে আরও গণ্ডায় গণ্ডায় ছানা পোনা, বউ। তার মাঝে একবার বিয়ে দিয়ে ঝেড়ে ফেলা মেয়েকে আবার ফিরিয়ে নেওয়া যায় নাকি!!

ছয়
পুষ্পি’র বাবা না হয় অশিক্ষিত ছিল। কিন্তু আমার বাবা! বাবা তো ছিলেন আমাদের গাঁয়ের স্কুলের হেডস্যার। কত কত ছেলে মেয়ে বাবার হাতে পড়াশোনা করে বড় হল... মানুষ হল...। তবু একটা জায়গায় পুষ্পি’র বাবার সঙ্গে আমার বাবার কোনও তফাত থাকল না। সেটা আমার প্রতি তাঁর আচরণ। পড়াশোনা তো বন্ধই করে দিলেন, সেই সঙ্গে বাইরে বেরোনো, বন্ধুদের সঙ্গে খেলা... সব... সব বন্ধ। শুধু ঘরে বসে বসে মা’র কাজের ফাই ফরমাস খাটা আর ভাইয়ের দেখভাল করা। ওইটুকু বয়সের একটা মেয়ের কি শুধু এইভাবে দিন কাটাতে ভালো লাগবে? তোমরাই বলো। লাগবে না তো? আমারও লাগত না। তাই তো মাঝে মধ্যে বাবা মা’র নজরকে ফাঁকি দিয়ে নিঝুম দুপুরের রোদে বেরিয়ে প’ড়ে চলে যেতাম বটপুকুরের ধারে। ওখানে প্রকাণ্ড ঝুরি নামা বটগাছটার ছায়ায় বসে বসে ভাবতাম কত কি। ভাবতাম পুরোনো স্কুলের কথা... বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলোর কথা... নতুন স্কুলে ভর্তি হবার পর কত রকমারি মজার কথা...।
আচ্ছা, ঋজুদাদা যদি আমায় ওরকম না করত, তাহলে তো আমার স্কুল যাওয়া বন্ধ হত না। কিন্তু ও বলেছিল আমায় ভালবাসার কথা বাড়িতে না জানাতে। আমি যদি না জানাতাম তাহলে তো দিন দিন ওর ওরকম করা আরও বেড়ে যেত। বেড়ে যাচ্ছিলই। সেটা কি ভালো হচ্ছিল? আমার কোথায় দোষ? আমি কি করেছি যে আমায় এত বড় শাস্তি পেতে হচ্ছে? আমায় ভাইয়ের থেকে খারাপ দেখতে বলে না কি আমি মেয়ে বলে?
ঋজুদাদা বলেছিল আমি মেয়ে বলে আমার আদরটা অন্য রকম হতেই হবে। তাই ও ওরকম করে। তাহলে বাড়িতে বলতে বারণ করেছিল কেন? আমি কোনও কিছুর হিসেব মেলাতে পারতাম না। হয়ত তখন সেই বয়সও হয়নি। এখন এই ক্লাস নাইনে পড়া অহনা বাগদি’রই কি সেই সব বোঝাবুঝির বয়স হয়েছে নাকি? আমার জীবনের পরিস্থিতিই আমায় সব... সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে।
একদিন শীতের শেষ দুপুরে বটপুকুরের পাশে গাছের তলায় বসে থাকতে থাকতে একটু ঘুম ঘুম মতো এসেছিল চোখে। হঠাৎ একটা শব্দ হতেই তাকিয়ে দেখি সামনে ঋজুদাদা দাঁড়িয়ে আছে। আমি চমকে গেলেও ওকে সেটা বুঝতে না দিয়ে গলায় ঝাঁঝ এনে বললাম, ‘তুমি এখানে কেন? তোমার বারণ আছে না আমার কাছে আসার? দেখতে পেলে বাবা তোমাকে আর আমাকে দুজনকেই লাঠি পেটা করবে। যাও শিগগির। যাও বলছি’।
ঋজুদাদার চোখটা অন্য রকম। মুখের ভাব ভঙ্গীও আমার অচেনা। এ সেই আগের ঋজুদাদা নয়। চোখ দুটোকে সরু করে মুখটা একটু বাঁ দিকে বেঁকিয়ে দাঁতে দাঁত চিপে বলছে, ‘আমাদের দেখতে পাবে তবে তো লাঠি পেটা? তোকে বারণ করেছিলাম বাড়িতে বলতে। সেই তুই বলেই ছাড়লি। এখন দ্যাখ তোর কি করি’। ঋজুদাদার হিসহিসে সাপের মতো কথায় আমার ভিতরটা ভয়ে কেঁপে উঠল। উঠে চলে যেতে যাব, কোত্থেকে আরও চার পাঁচটা ছেলে বটগাছের এ পাশ ও পাশ থেকে বেরিয়ে এসে আমায় চেপে ধরল। তারপর সবাই মিলে টানতে টানতে নিয়ে চলল দূরে, ওই ধানক্ষেতের মাঝখানে।...
ভানুদাদা একদিন আলোকবর্তিকায় আমাদের পঁচিশজন মেয়েকে বসিয়ে শেখাচ্ছিলেন মিষ্টি একটা শরতের গান। ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা... নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা...  লুকোচুরি খেলা...’। আমার তখন মনের ভিতরে ওই সেদিনের ধানের ক্ষেতের দৃশ্যগুলো ছবির মতো ফুটে উঠছিল। চার পাঁচটা রাক্ষস মিলে আমার গায়ের জামাটা টেনে ছিঁড়ে আদর করে দিয়েছে। ঋজুদাদা ছুটে এসে লাল ছোট প্যান্টটা টেনে নীচে নামিয়ে দিয়ে আমায় সেই ছোটবেলার মতো করে দিল। আমি চিৎকার করব কি, একজন তো আমার মুখ ঠোঁট তার লোহার মতো হাত দিয়ে চেপে ধরে আছে। একজন আমার একটু একটু মায়ের মতো হওয়া বুকটাকে শুধু ধরছে আর খামচাচ্ছে। ঋজুদাদা হিসুর জায়গাটায়...
‘আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে... উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে... আজ কিসের তরে নদীর চরে চখা চখীর মেলা...’ ভানুদাদার গান এগিয়ে চলেছে... সবাই ওঁর সঙ্গে গাইছে আর আমার বুকের ভিতরটা কোন এক দুঃস্বপ্নের ধানের ক্ষেতে নিষিদ্ধ লুকেচুরি খেলার আতঙ্কে, ঘেন্নায় উথাল পাথাল করছে।...               


(ক্রমশ)
অলংকরণ : অর্চিতা মুন্সী

Post a Comment

0 Comments