লকডাউনের দিনলিপি

মনে মনে কতদূর চলে এসেছি

সৌরভ চক্রবর্তী


আজ ৩১ মার্চ ২০২০। একটি সাক্ষাৎকারে একবার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, জীবনে উপন্যাস লেখার ভার যখন তাঁর ওপর প্রথম আসে উনি তখন একটি দিন এবং তার সামনে আর পিছনে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোকে সুন্দরভাবে পরপর লিখতে থাকলেন যা হয়ে উঠল এক-একটি উপন্যাস আর অমরকথা! এখন আজকের দিনে যখন করোনা ভাইরাসের প্রবল আক্রমণে আমরা সব্বাই দেশজুড়ে বাধ্যতামূলক গৃহবন্দী দশা অতিক্রম করছি তখন নিজের টুকরো টুকরো কিছু প্রাত্যহিক কথা আর অনুভূতিকে আপনাদের সামনে কোলাজ আকারে তুলে ধরছি। আমি নিজে সাংবাদিক হওয়ার কারণে বাধ্যতামূলক গৃহবন্দী অবস্থা মানা সবসময় সম্ভব না হলেও সপ্তাহে অন্তত তিন দিন তা মেনে চলছি। এই বাড়িতে থাকার সময়ে আমি নিজের সঙ্গে কথা বলার অনেকটা সময় পাচ্ছি আর তার মাধ্যম হল কখনও আপন মনে বাউল গাইতে থাকা বা ধরুণ একের পর এক বই পড়া। গত সপ্তাহে আমি পড়ে ফেললুম অংশুমান করের লেখা বই 'পিগমিরা লিখছে', সুপ্রতীম সরকারের লেখা বই 'আবার গোয়েন্দাপীঠ', আবীর মুখোপাধ্যায়-এর বই 'পৌষমেলা স্মৃতির সফর' এবং বুদ্ধদেব বসুর অনুদিত টি.এস.এলিয়টের কবিতার বাংলা সংস্করণ বই।
বেশ, এখন ব্যাপার হল এই গৃহবন্দী দশায় আমার পুরনো একটি নেশা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আর সেটি হল ম্যাপ দেখে দেখে জায়গা খোঁজা আর সেই জায়গা এবং তার ইতিহাস নিয়ে পড়তে থাকা আর ব্লগ লেখা! যেমন ধরুণ বাংলার উত্তরে দ: দিনাজপুর জেলার মুখোশ-এর গ্রাম কুশমণ্ডির মহিষবাথান নিয়ে পড়াশুনো, বা ধরুণ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবং-এর গহনা বড়ি, পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকের বর্গভীমা মন্দির বা ধরুণ গড়বেতার গনগনি যা কিনা বাংলার গ্র‍্যান্ড ক্যানিয়ন নামেও খ্যাত, এছাড়াও রয়েছে দার্জিলিং থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে গ্রাম দাওয়াইপানি নিয়ে জানতে থাকা! এভাবে ম্যাপ দেখে দেখে প্রতিদিন নিজেকে এক-একটা স্থানের নাম দিচ্ছি  ও তার ইতিহাস নিয়ে পড়াশুনো করছি! আজ বলব দাওয়াইপানির গল্প। তবে হ্যাঁ, কথাপ্রসঙ্গে এটি বলে রাখা ভাল এই জায়গাটিতে আমি নিজেও গিয়েছি তাই গল্প বলার ছলেই আমি আমার নিজের কথাগুলো, ভাবনাগুলো মেলে ধরলাম। অনেকটা বৃষ্টিভেজা গুয়াহাটিতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পাপনের গুনগুন করা আর রান্নাঘরে তখন মায়ের হাতের গরম গরম পাটিসাপ্টা পিঠের মতোন চনমনে যাই হোক চোখ বন্ধ করে চলে আসুন আমার সঙ্গে পাহাড়ের কোলে নিজের কাছে ফিরে যাই চলুন।


বিকেলে বেরোলাম পায়ে হেটে গ্রাম ঘুরতে। ছবির মতোন সুন্দর গ্রাম। পাহাড়ের কোল বেয়ে রাস্তা আর গ্রামে ভেষজ গাছের বেশ কয়েকটির দেখা মিলল। গ্রামের মধ্যে বেশ কিছু হোমস্টে আছে। গ্রামের মানুষের সঙ্গে পড়ন্ত বিকেলে গল্প করতে গিয়ে জানতে পারলাম ইংরেজ আমলে এই টি এস্টেট-এর নাম ছিল বন্দীকামান টি এস্টেট! টি এস্টেটের কাজের সূত্রে এক ইংরেজ এখানে আসেন। তার পায়ে এক জায়গাতে একটি পুরনো ক্ষত ছিল, যে কারণে তিনি জুতো পরিধান করতে পারতেন না। খালি পায়ে যাতায়াত করতেন আর তার যাতায়াতের রাস্তায় একটি ঝর্ণা ছিল। ঝর্ণার জল রাস্তার ওপর দিয়ে গড়িয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পড়ত। কিছুদিন পরে সেই ইংরেজ ভদ্রলোক লক্ষ্য করলেন তার পায়ের ঘা আস্তে আস্তে শুকিয়ে যাচ্ছে। এবং আরও কিছুদিন পরে একেবারেই সেরে যায়। তিনি বুঝতে পারেন তার ওই পায়ের ক্ষত সেরে যাওয়ার সঙ্গে ঝর্ণার জলের সম্পর্ক রয়েছে। তিনি সেই ঝর্ণার জল পরীক্ষার জন্য পাঠান এবং পরীক্ষাতে দেখা যায় যে সেই জলে আছে প্রচুর খনিজ উপাদান। অর্থাৎ কিনা মিনারেলস আছে, এরপর সেই কথা চারিদিকে জানাজানি হতেই সেই গ্রামের নাম হয়ে যায় মিনারেল স্প্রিং বস্তি। পরে সেই নাম পাল্টে হয় দাওয়াইপানি। দাওয়া মানে ঔষধ আর পানি মানে জল। কিন্তু গ্রামের নিচের অংশের নাম এখনও মিনারেল স্প্রিং বস্তি। এর কারণটিও বেশ অন্যরকম এই পাহাড়ের ওপরের অংশের সঙ্গে নিচের অংশের যোগাযোগের ভাল কোনও রাস্তা নেই। একই গ্রামের দুটি নাম। এর কারণ গ্রামের নিচের অংশের সঙ্গে দার্জিলিং পাহাড়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায় তাই কোনও দরকারে নিচের অংশের মানুষদের আর ওপরে যেতে হয় না। আর ওপরের অংশের মানুষজন দার্জিলিং যায় ঘুম জোড়বাংলো দিয়ে। সুতরাং একই গ্রাম কিন্তু তারা এক অর্থে আলাদা ওপরের অংশ দাওয়াইপানি আর নিচের অংশ মিনারেল স্প্রিং বস্তি। ধীরে ধীরে সন্ধে হচ্ছে আর দার্জিলিং সহ অন্যান্য পাহাড় ততই সহস্র জোনাকির আলোর মতোন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। এখন খুব কুয়াশা নাহলে এই দৃশ্য আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মেঘলা আকাশ আর হালকা বৃষ্টি মনটা কেমন উদাস হয়ে গেল, আমি কাঠের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম আর দেখলাম দূরে পাহাড়ের ঢালে চা বাগানে শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার তাড়া…হাতের ধূমায়িত কফিতে চুমুক দিয়ে ভাবলাম এক চক্কর দিয়ে আসি হঠাৎ একটা পাহাড়ী গান “কে তোকে বাঁধি দিলাই হিলকি দিলকি খোপা হায় রে/ কে তোকে বাঁধি দিলাই হিলকি দিলকি খোপা হায় রে/ কে তোকে নজরি লাগাই/ হে বৃন্দাবন হো হাই রে গো সখি কে তোকে নজরি লাগাই/ হে বৃন্দাবন রস লাগাই …” আহা মন ভরে গেল আর মনে হতে লাগল এই সহজ সরল সাধারণ মাটির কাছাকাছি হতে এত্তো অসুবিধে… এই সময় চিনু ভুটিয়া তার মেয়ের সঙ্গে এল। বলল স্যার আজ রাতে কি খাবেন? আমি বললাম,আজ রাতে হাল্কা মশলা দিয়ে চিকেন স্ট্যু বানিও…সে চলে গেল…দিনের আলোর ঝলকানি বিলীন হতে লাগল রাতের গহ্বরে…রাতের পাহাড় বড্ড অচেনা…দূরে পাহাড়িয়া গান, ঠাণ্ডা হাওয়া, মন কেমন করা, রাতের অন্ধকার, আর সমগ্র পাহাড় জড়িয়ে আলোর নাচন। আমি বলাই-এর মতোন ভাবলাম আমিও সেই অচেনা, শতাব্দীর রহস্যে ঘেরা বটবৃক্ষের কুটরীর ভেতরে অমৃতের যাত্রী।

Post a Comment

2 Comments

  1. ভালো বললে কম বলা হবে, আসলে খুবই ভালো লেখাটি😊

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লিখেছেন,চোখের সামনে ছবিটা ফুটে উঠল। লকডাউনে এই স্মৃতিগুলোই বাঁচার রসদ যোগাচ্ছে।

    ReplyDelete