বইপাড়া

বিশ্বভারতীর প্রথম বই

সুশোভন অধিকারী


এই খবর আমরা সকলেই জানি যে, টিন-এজ রবীন্দ্রনাথের প্রথম কবিতার বই প্রকাশ পেয়েছিল ১৮৭৮ সালে। হিসেব মতো তাঁর বয়স তখন সতেরো বছর। অবশ্য অঙ্কের হিসেব এখানে বড় কথা নয়, কথাটা ভিন্ন প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই। খেয়াল করলে দেখি, বেশ খানিকটা পিছিয়ে, রবীন্দ্রনাথের প্রথম বই প্রকাশের ঠিক একশো বছর আগে ১৭৭৮ সালে, প্রথম বাংলা হরফে বই ছাপা হয়েছে। সময়ের নিরিখে কিশোর রবির ‘কবি-কাহিনী’ যখন ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পাচ্ছে ঠিক সেই সময় পূর্ণ হচ্ছে বাংলা হরফে বই ছাপার একশো বছর। একশো বছরে ছাপাখানার অনেক বিবর্তন ঘটেছে,
তা অবশ্য এখানে উপজীব্য নয়। বলতে চাই, প্রথম বাংলা হরফে বই ছাপার মতো ‘কবি-কাহিনী’র প্রকাশও সাহিত্যের ইতিহাসে এক জরুরি চিহ্ন, যার মধ্যে দিয়ে ক্রমে ‘কবি-কাহিনী’র সেই কবি সারা বিশ্বের দৃষ্টিকে তাঁর দিকে টেনে আনবেন। খোঁজ নিলে জানা যাবে, কিশোর রবির প্রথম বইটি ছেপেছিল তাঁর এক ‘উৎসাহী বন্ধু’ শ্রী প্রবোধচন্দ্র ঘোষ— তদানীন্তন কলকাতার মেছুয়া বাজার রোডের ৪৯ নং বাড়ি থেকে। একই সঙ্গে মনে রাখা দরকার, সেই প্রথম রবীন্দ্রগ্রন্থ প্রকাশের প্রায় পঞ্চাশ বছর বাদে রবি ঠাকুরের বই মুদ্রিত হচ্ছে তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতী থেকে। এই পর্বের উল্লেখযোগ্য বই ‘পূরবী’। অবশ্য স্বল্পায়তনের ‘বসন্ত’ গীতিনাটিকার কথা ধরলে সময়টা আরও বছর পাঁচেক এগিয়ে যাবে। তারিখের হিসেবে ‘বসন্ত’ হল বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত প্রথম বই— যা পরে ঋতু-উৎসবে সংকলিত হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করা ‘বসন্ত’ ছাপা হয়েছে ১৯২৩ সালে, জগদানন্দ রায়ের তত্ত্বাবধানে শান্তিনিকেতন প্রেস থেকে। পরের বইটি রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ, চিঠিপত্র, ডায়ারি, কথিকা ইত্যাদি একত্রিত করে ‘সঙ্কলন’, তার পরে প্রকাশিত হচ্ছে ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ। তবে কেন জানি না, অধিকাংশের মতে ১৯২৫-এ প্রকাশিত ‘পূরবী’র হাত ধরে বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগের যাত্রা শুরু। কিন্তু ক্ষীণতনু হলেও ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে ‘বসন্ত’কে বাদ দেওয়া চলে না। এমনকী বিশ্বভারতীর লোগো এখানেই প্রথম মুদ্রিত হতে দেখি।
‘বসন্ত’-এর মুখচ্ছবিতে পুষ্পিত অশোক মঞ্জরীর বৃন্তটি কোন শিল্পী এঁকেছিলেন তা নিশ্চিত ভাবে জানা যায় না। তবে অনুমান করি— এটি নন্দলালের আঁকা। কারণ, এই পর্বে নন্দলাল পাকাপাকি কলাভবনের দায়িত্ব নিয়ে শান্তনিকেতনে এসেছেন, কলাভবন কর্ণধারের হাতে কবি তাঁর গ্রন্থসজ্জার ভার তুলে দেবেন, এইটিই প্রত্যাশিত। আর ছবিটির সঙ্গে পরবর্তী কালে নন্দলালের ‘নটরাজ ঋতুরঙ্গশালা’য় আঁকা পুষ্পিত অশোকগুচ্ছের সাদৃশ্য সুম্পষ্ট। এক্ষেত্রে এটাও বলতে হয়, কেবল সাদামাটা ভাবে বই ছাপানো নয়, একেবারে সচিত্র ‘বসন্ত’ দিয়ে বিশ্বভারতী প্রকাশনার সূত্রপাত। আবার পিছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে, প্রথম বাংলা সচিত্র গ্রন্থটির নাম ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের ‘অন্নদামঙ্গল’— যা ১৮১৬ সালে কলকাতার ফেরিস অ্যান্ড কোম্পানির ছাপাখানায় মুদ্রিত। ‘অন্নদামঙ্গল’-এর সমাদরে প্রবল উৎসাহিত ফেরিস কোম্পানির প্রেস থেকে নাকি পর পর ছবিওয়ালা বই বেরোতে থাকে, তার মধ্যে একটি মকরবাহিনী গঙ্গার চিত্রভূষিত ‘গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিনী’। অনুসন্ধান করে জানা যায় একের পর এক এই ধরণের চিত্রিত বই ছেপে প্রকাশক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ভালোই মুনাফা করেছিলেন। যদিও এই খবরে আজকের প্রকাশকদের দীর্ঘশ্বাস পড়বে, কারণ শুনতে পাই এখন বইয়ের বাজার বেশ মন্দা। তবে সে অন্য প্রসঙ্গ। এই বিষয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ছবি দেওয়া বই পাঠকের কাছে আদৃত হয়েছে তার জন্মলগ্ন থেকে— সেই আমাদের আদিপর্বের অডিও-ভিসুয়াল।
 সন-তারিখের হিসেবে শান্তিনিকেতনে রবি ঠাকুরের ছাপাখানা থেকে ছবি দিয়ে সেজে যে বই মুদ্রিত হল তা ‘অন্নদামঙ্গল’-এর একশো বছর পার করে। এই সাজ ছাপাখানার মার্কা দেওয়া সজ্জা নয়, এক বিশেষ শিল্পীর হাতে, শিরোনাম লেখা হল অনেকটা আলপনার ছন্দে। কবির আশ্রমে নন্দলালের মতো চিত্রী থাকতে ভাবনা কিসের? কিন্তু শুধুই কি নন্দলাল? নন্দলাল ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের হাতের নাগালে রয়েছেন অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, অসিতকুমার হালদার, সুরেন কর থেকে আর একটু পরের ধাপে বিনোদবিহারী, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রামকিঙ্কর, মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত থেকে দেশের প্রথম সারির শিল্পীদল। তাই প্রথম দিনেই সে সকলের মন কেড়ে নিলো বৈকি! এতো গেল বইয়ের সাজসজ্জার কাজ। অন্যদিকে বইয়ের অন্দরমহল সামলাতে তৈরি থেকেছেন ইন্দিরা দেবীচৌধুরাণী থেকে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ, চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, কিশোরীমোহন সাঁতরা, সুধীর কর, কানাই সামন্ত, পুলিনবিহারী সেন বা বিজনবিহারী ভট্টাচার্যের মতো ব্যক্তিত্ব। আবার সরাসরি কাজের সূত্রে না থেকেও সহায়তা করছেন রাজশেখর বসু, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, সজনীকান্ত দাস থেকে নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো মানুষ— যাঁরা প্রত্যেকে যেন একেকটা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান। ‘বসন্ত’ বা ‘পূরবী’র অনেক আগে ১৯০৯ সালে ‘চয়নিকা’ প্রকাশিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান পাবলিশিং হাউস থেকে। সে বইয়ে নন্দলালের অনেকগুলি ছবি থাকলেও তবে তার মলাট ছিল কবির হস্তাক্ষরে। বছর তিনেক পরে ‘ছিন্ন পত্র’ বইয়ের মলাটে পাওয়া গেল নন্দলালের রেখাঙ্কন— পদ্মের পাপড়ি ঝরে পড়ার ছবি, যা অনেকটা অজন্তার ভঙ্গিতে আঁকা। পরের বই ‘জীবনস্মৃতি’র অন্দরমহল অসাধারণ চিত্রমালায় ভরিয়ে তুলেছেন গগনেন্দ্রনাথ। কিন্তু নন্দলালের আঁকা ‘ছিন্ন পত্র’-এর রেখাঙ্কনটি এখানেও প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহারের কারণ জানা নেই। এই দুটি বইয়ের প্রকাশক কবির মধ্যম জামাতা নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী, শিলাইদহ, নদীয়া। মুদ্রিত হয়েছে ‘আদিব্রাহ্মসমাজ প্রেস, ৫৫, আপার চিৎপুর রোড, কলিকাতা’ থেকে। তবে কারণ যাই হোক, এ-কথা বেশ স্পষ্ট, শান্তিনিকেতনে যোগ দেবার আগেই বইয়ের সাজসজ্জার ব্যাপারে নন্দলাল হয়ে উঠেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর আশেপাশের মানুষজনের অন্যতম প্রধান ভরসাস্থল। পরবর্তীকালে তাঁর চিত্রিত ‘ছড়ার ছবি’ বা ‘নটরাজ ঋতুরঙ্গশালা’র পাতা থেকে আজকেও চোখ ফেরানো যায় না।
ছবির পাশাপাশি তাঁর ডিজাইনের বোধ কোন স্তরে উন্নীত তা আজকে এতরকম আঙ্গিকের কারিকুরির পরেও আমাদের আবিষ্ট করে রাখে।

Post a Comment

0 Comments