লকডাউনের দি‌নলিপি


অবনী বাড়ি আছো

কুন্তল রুদ্র


সেদিন সকালে এগারোটায় রবীন্দ্রভবনের গেটে সিকিউরিটি চেকিং পেরিয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকে টেবিলে ল্যাপটপ রেখে আগের দিনের বইটি ইস্যু করতে কাউন্টারে যেতেই আমাকে যখন জানানো হলো লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে গেছে তখনই বুঝতে পারলাম বড়সড়ো এমন একটা-কিছু ঘটতে চলেছে যার থেকে শান্তিনিকেতনও রেহাই পাবে না। ছাত্রছাত্রীদের হস্টেল বন্ধের সঙ্গে সঙ্গেই রবীন্দ্রভবনের প্রদর্শনশালা বন্ধ হওয়ায় ভেবেছিলাম কয়েকটা দিন সম্পূর্ণ শান্তিতে লাইব্রেরিতে লেখাপড়া করা যাবে। নিজের পুরোনো একটি লেখা নতুন করে লেখার প্রয়োজনেই এই দফায় ওই লাইব্রেরি যাওয়া। ওঁরা অবশ্য আমার প্রতি সৌজন্য দেখিয়ে সেই সকালটুকু আমাকে কাজ করার অনুমতি দিলেন। একটার সময় রবীন্দ্রভবন ছেড়ে বেরিয়ে বাড়ির এক কিলোমিটার পথে কোনো জনমানুষের মুখ দেখা গেল না। 
অদ্ভুত এক অন্যমনস্কতা নিয়ে বাড়ি ফিরে ভাবছিলাম - মানুষ কি ভয় পাছে, অথবা পথেঘাটে এই যে গণ-অনুপস্থিতি এ তাদের বিচক্ষণতার পরিচয়? সন্ধের মুখে উত্তরটা মিললো, যখন শুনলাম পাড়ার দোকানে যে যা পারছে পাগলের মত কিনছে। প্যানিক-পারচেজিং! এক ঝটকায় মনে পড়ে গেল রান্নার মেয়েটি চাল কেনার কথা বলেছিল দুদিন আগেই। হতচকিতের মত আমিও সেই একই দোকান থেকে মিনিকিট চালের পঁচিশ কিলোর একটি বস্তা কিনে যেন খানিকটা স্বস্তিই পেলাম। 
ঘোরের মধ্যে দিয়ে দুটো দিন পেরিয়ে গেল টেলিভিশন, খবরের কাগজ আর সোস্যাল মিডিয়ায় চোখ পেতে। লেখালেখি বন্ধ। তারই মধ্যে সোস্যাল মিডিয়ায় ইতালির ছবি দেখে বেশ একটা উৎসবের আমেজ লেগে গেল যেন। রোম, ফ্লোরেন্স, মিলান-সহ বেশ কয়েকটা বড় বড় শহরে হাজার হাজার ঘরবন্দী মানুষ নিজেদের ঘরের ব্যালকনিতে, জানলায় হাত নাড়ছে আর উচ্চকন্ঠে সমস্বরে গান গাইছে। দিনকয়েকের ব্যবধানে সেই শহরগুলোই যে মৃত্যুপুরী হয়ে উঠতে চলেছে স্বয়ং ঈশ্বরেরও ক্ষমতা নেই বোঝার। অথচ ঠিক তাই হলো। বহুদূরের ওক্লাহোমা স্টেটের ছোট্ট শহর স্টিলওয়াটার থেকে পুত্র কিন্তু হোয়াটস্‌ অ্যাপে বলে যাচ্ছিল – ‘খুব খারাপ সময় আসছে, কতটা খারাপ তোমরা এখনও বুঝতে পারছো না’! 
বাল্যকালে নিজের চোখের দৃষ্টির বিনিময়ে টাইফয়েড দেখেছি, স্মল পক্স দেখেছি, সাম্প্রতিককালে ডেঙ্গি দেখেছি, প্রকৃতির রুদ্ররোষ দেখেছি ভূমিকম্পে, বন্যায়, আর যা-কিছু সে-সব তো বইয়ের পাতায় – কলেরা, প্লেগ, কালাজ্বর, স্প্যানিশ ফ্লু। অদৃশ্য এক অতি ক্ষুদ্র অথচ কী ভয়ঙ্কর শত্রুর নাচনে নাচছে আমাদের সাধের পৃথিবী। যৌবনের বিপ্লবস্বপ্ন সময়ের সঙ্গে ফিকে হলেও তারপর থেকে কত কতবার কী প্রগাঢ় অনুভবে বোধে উচ্চারণ করেছি জীবনানন্দকে - ‘সুচেতনা এই পথে আলো জ্বেলে এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে’, কোথায়, কোথায় সেই মুক্তি – সে কি শেষপর্যন্ত করোনার গ্রাসে? 
বাতাসে বিষ ভাসছে, খবরের বিষ! টেলিফোনে চেনা গলার স্বরও যেন অচেনা। এ এক বিশ্বাসঘাতক সময়। পায়ের নিচের মাটি তলতলে। করোনার প্রথম শহীদ শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব। তবু আমরা বুঝিনি। আসলে বুঝতে চাইনি। ভেবেছিলাম বালিতে মুখ গুঁজে আমরা দেখবো না, চীনে কি হচ্ছে, কি হচ্ছে দূরের ইতালিতে, ঘরের কাছে ইরানে। এখন সে দরজায় উপস্থিত, আর আমরা হাত ধুচ্ছি, হাত ধুচ্ছি,  কেবল হাতই ধুয়ে চলেছি। যেন সাবানে হাত ধুলেই দরজা থেকে সে ফিরে চলে যাবে। 
আজকাল হঠাৎ হঠাৎ রাতের ঘুমে মাটি-কাঁপার অনুভব। উঠে জেগে বসে থাকি, নতুন করে বই খুলি, ল্যাপটপের কি-প্যাডে হাত বোলাই। স্মার্টফোনে ক্লিভল্যাণ্ড থেকে বীরভূমের ছেলে বর্ষণজিৎ-এর ফেসবুক পোস্ট খুলে খুলে দেখি। পুত্র প্রত্যয়দীপ্তের ওয়ালে গিয়ে দেখি পাখিরা উড়ছে কিনা। টেনেসি থেকে বন্ধু ডাঃ  হুমায়ূন কবীরের করোনা-যুদ্ধের প্রত্যয়দীপ্ত তথ্যনিষ্ঠ উচ্চারণ গান হয় – উই শ্যাল ওভারকাম, উই শ্যাল ওভারকাম ..। মন যেন থিতু হয় কিছুটা, ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের মধ্যে রামকিংকরের কলের বাঁশির মূর্তিরা ধরা দেয়, জীবনের কী ঢেউ তাদের পায়ের ছন্দে! রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে ওঠেন টুকুদি – ‘অচেনাকে ভয় কী আমার ওরে’। বেশ একটা আশ্রয়ের মত মনে হয়। ঘুম ঢলে পড়ি। আর তারমধ্যেই সহসা শুনি করোনা-কড়ানাড়া – ‘অবনী, বাড়ি আছো?’          


ছবি : সমীরণ নন্দী

Post a Comment

0 Comments