লকডাউনের দিনলিপি


নির্বাসনের চিঠি


গুলশনারা 


এ যাবৎকালে ছুটি শব্দটায় অনীহা জেগেছে। ভিতরে উস্কানি, যদি একটু মুখ দেখা যায় রাজপথের। বাইরে ভাইরাসের চোখরাঙানি। আমরা ভেবেছিলাম ছুটি পেলে শীতের দেশে যাব। বোশেখ বড্ড চোখ জ্বালা দেয়। দহন তবু প্রিয় এখন। ভাইরাস নাকি পুড়ে যায়। অথচ, অন্দর জুড়ে বেরনোর নেশাকে ডমিনেট করছে মৃত্যু ভয়।
আচ্ছা আমরা কি বাঁচতে চেয়েছিলাম? তাহলে, দিনযাপনের সময় এতগুলো নিরবিচ্ছিন্ন অ্যালজোলাম পকেট ভরে এনেছিলাম কেন? এখন রাতে ঘুম আসে না। বেয়াড়া কোকিলটা মিঠে ডেকে পাড়া জাগিয়েছে। আমার আর কোকিল-ডাকে মন ভাসে না। মন কাঁদে। যদি ভালবাসা না-পেয়ে, একলা ঘরে পায়েস রেঁধে খেতে হয় সারাজীবন? প্রতিদিন মেকআপ তোলার সময় ভাবতাম একটা বেশ করে ছুটি পেলে ভাস্কর পড়ব দিনরাত।
আহা মেকআপ নেই, কাজল নেই এমন আমি দিন কাটাব। তাহলে কেন মেক-আপের গন্ধটা মন টানে? কেন বারবার কোকিলটাকে বলি, ‘চুপ কর শয়তান, আমায় ঘুমোতে দে।‘ গুরুসদয় দত্ত রোডের রাস্তাগুলো এতকাল আকুল ছিল। হয়ত, গাছ-কোটরে পাখিরা রাতবিলাসের চুমু খাবে, তখনই বেয়াড়া শব্দের হুশ গাড়িটা একমুখ ধোঁয়ায় কালো করে বেরিয়ে গেল। এই চৈত্রে গাছগুলো বেশ আছে। গাড়ি-বাড়ি গৃহবন্দী। পাখিরা নিরলস চুমু খায় এখন। মৌটুসি দেখে, দু-পেয়েরা কেমন রাত-জাগে, পথ জাগে না। গাছেদের নির্বাসন নেই। হাওয়া দেয়। আলো দেয়। আমার ছাদে পায়রা আসে সিনেমা শেখাতে। সূর্যটা চোখ মারে। পিটুনিয়া গাছটা, নিয়ম ভেঙেই ২০টা ফুল ফোটাল।
বাড়িতে চাল নেই। গোটা সেদ্ধ নিয়ে বেশ আছি। আহা, কোমরে যেন মেদ না লাগে। নির্বাসনের চয়েস। শুনলাম গাজিয়াবাদে নাকি মরার চয়েস কেড়ে নিয়েছে ওরা। হতকুচ্ছিত, গায়ে গন্ধ শ্রমিক। বাড়ি গিয়ে মরতে চাওয়ার বাসনাটুকু কাঁধে নিয়ে হুড়ুমতাল রাস্তায় নেমেছিল। রাজা, কেক খেয়ে, হাত ধুয়ে বিধান দিলেন, বোলাও জল্লাদ। জল্লাদ, ভুঁড়ির কষি আলগা করে বাঁকা হাসে। ছোট জাত, বাড়িতে স্বদেশে মরার শখ দেখ। নির্বাসনের জাত নেই। শ্রেণি আছে। গরিবের নির্বাসন নেই। আকুতি আছে। ফ্যান দাও মাগো। এ পরবাসে মরে গেলে, ছোঁবে না কেউ। ওই যেমন, এতকাল ছোটজাত অচ্ছুত। ভাইরাসে জাত গেছে সব। এখানে বিলেতও অচ্ছুত। ডোমেরা নাক সিটকায়। এ ভাইরাস বড় হিসেব মিলিয়ে নিচ্ছে বেকুব পৃথিবীটার।
মন ভাল নেই। তবু ফোন ভাল আছে। টুংটাং ফেসবুক, সবজে আলোর হাসি। বিদেশী গন্ধে হাত মুছে, লেডি ম্যাকবেথ শুদ্ধ করে নিজেকে। আর কাশ্মীর? প্রেমিকা বসেছিল, প্রিয় আসবে না। সেতো ফেরেনি সন্ধ্যা নামার আগে। আহা, লকডাউন স্মৃতি চোখে নিয়ে মরেছিল যে শিশু, সেইই বুঝি ঈশ্বরকে জানাল, মানুষ বড় মারছে। তুমি ঈশ্বর হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াও। রাজনীতির ভাঁড়ার শূন্য হলে দোকান খুলবে। চর্চা চলবে। ছোঁয়াছুঁয়ি হবে ফের। তবু মানুষ কিছু মরবে। গাছেরা পাতা দেবে, ফুল দেবে। বরফ দেবে শান্তি। আজ একবার হিমালয়কে জিজ্ঞেস করো তার নির্বাসনের কথা। পাহাড় হেসে বলবে,  ‘এই দেখ পাহাড় হাসছে।’ নির্বাসনে প্রেম মুছে গেলে। আমাদের কি আরও প্রেম মজুত করার কথা ছিল না রিজার্ভ ব্যাঙ্কে?

(অভিনেতা)

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব সুন্দর। চমৎকার লাগলো।

    ReplyDelete