লকডাউনের দিনলিপি

যেভাবে ‘লক’ জীবনে ‘ডাউন’ হচ্ছি

ইলোরা গঙ্গোপাধ‍্যায়


বেশ কিছু দিন হতে চলল একটা গোটা দেশ তার বন্দিদশা কাটাচ্ছে। বিনা অপরাধের এই নিরূপায় কারাবাসের মেয়াদ সম্পর্কে আমাদের কারুর‌ই সম‍্যক ধারণা নেই। শুধুমাত্র সুস্থভাবে বেঁচে থাকার লক্ষ‍্যটুকু নিয়ে এই বিবর্ণ দিনযাপন ক্রমশ‌ই অসহনীয় হয়ে উঠছে। গোড়ার দিকে এই মাথাব‍্যথাটা কিন্তু ছিল না। আমি বরাবর‌ই একটু বিচ্ছিরি রকমের ঘরকুনো। ছুটির দিনে সুযোগ পেলেই আমার এই ছোট্ট ঘরটার মধ‍্যে নিরুপদ্রবে সময় কাটানো আমার বেশ পছন্দের। কাজেই ২১ দিনের এই লকডাউনের খবর শোনার পর দুশ্চিন্তাটুকু চাল ডাল আর ওষুধপত্রের মতো নিতান্ত কেজো ব‍্যাপারগুলোর জন‍্য‌ই তুলে রেখেছিলাম। বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ব‍্যাপারটা অত সহজ নয়।
পরিচিত মানুষজনের কাছে শুনছি, তাঁরা বাড়িতে বসে থাকার এই সময়টুকু কাজে লাগিয়ে এন্তার ‘প্রোডাক্টিভ’ কাজকর্ম করে চলেছেন। তাঁদের মানসিক ক্ষমতা দেখে আমি বিস্মিত। পৃথিবীটা নাকি এই কদিনে হঠাৎ করে অনেক সুন্দর হয়ে উঠেছে। ঝকঝকে নীল আকাশ। সকালবেলায় পাখির ডাক। যখন তখন দু'চাকা আর চার চাকার দানবগুলোর গর্জন থেকে নিষ্কৃতি। এসব দেখেও দেখা হয়ে উঠছে না কেন আমার?
পাত পেড়ে খাওয়ায় অভ‍্যস্ত আমাদের পরিবারে গত কয়েকদিন ধরে খাওয়ার টেবিলে একমুঠো ভাতে আঙুল নাড়াচাড়া চলতেই থাকে। মধ‍্যরাত অবধি ঘুমহীন চোখে বিছানায় এপাশ ওপাশ। সুস্থ সুন্দর জীবনযাপনের ওপর কে যেন সাইক্লোন ব‌ইয়ে দিয়ে গেছে। কাল রাতে ছাদে একা হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ছিল প্রোফেসর শঙ্কুর স্বপ্নদ্বীপের সেই আশ্চর্য ফুলগাছগুলোর কথা। জ‍্যান্ত মানুষের মগজ থেকে যাবতীয় বিচার বোধ, কল্পনাশক্তি, সৃষ্টিক্ষমতা শুষে নিয়ে তারা পুষ্ট হয়। এই অদৃশ‍্য মারণদূতটাও বোধহয় তেমন‌ই। কেবল মানুষের জীবন কেড়ে নিয়ে সে ক্ষান্ত হয়নি। আমার এবং হয়তো আরও অনেকের খেয়ালি দুনিয়ার রংটুকুও কেড়ে নিয়েছে সাময়িকভাবে। নাহলে প্রতিমুহুর্তে এলোমেলো ভাবনা মনে ঝড় তুলছে, অথচ একটাকেও গুছিয়ে কলমের ডগায় আনতে পারছি না কেন? কেন মনে হচ্ছে পছন্দের গান শোনা কি ব‌ই পড়াটাও এখন বিলাসিতা? ক্রিকেট রানের মতো চড়চড়িয়ে বাড়তে থাকা মৃতদেহের সংখ‍্যা আর গোটা বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা এই উন্মাদের পাঠক্রম একদন্ড শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। অদৃশ‍্য এই মারণদূত হয়তো তার তান্ডবলীলা শেষ করে একসময় চলে যাবে। কিন্তু তারপরেও টিকে যাওয়া মানুষগুলোর মনে আতঙ্কের এই গভীর ক্ষত সারতে আরো কত সময় লেগে যাবে জানি না।
তবু যতদিন একেবারে হেরে যাইনি, কিছু না কিছু শিখে নিচ্ছি রোজ। যে সে নয়, সে এক গভীর জীবনবোধের শিক্ষা। বেঁচে থাকার জন‍্য সত‍্যি কত অল্প প্রয়োজন আমাদের। অথচ বাড়তিটুকুর লোভে দিনরাত কামড়াকামড়ি করে চলেছি। জানি না, এই ভয়ানক আঘাতের পরেও মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার, ক্ষমতার দম্ভ ভাঙবে কিনা।
গাছপালা, পশুপাখিরা কয়েকদিন একটু নিশ্চিন্তে খোলা হাওয়ায় বেঁচে নিক। বলা তো যায় না, সুযোগ পেলেই আবার আমরা আমাদের চাহিদা মেটাতে দাঁতনখ বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ব।
লকডাউন কাছে এনে দিয়েছে আমার পরিবারের বাকি দুটো মানুষকে। একসঙ্গে নিজেদের সাহস জোগাচ্ছি। যারা একা রয়েছে এখন, তারাও কিন্তু আসলে একা নয়। আমরা সবাই এক‌ই লড়াইয়ে শামিল।
অনেক শিক্ষা পেলাম এই কদিনে। আর নয়। এবার শিক্ষাটুকু জীবনে প্রয়োগ করার সুযোগ চাই। বন্ধ দরজার আড়াল থেকে আমাদের এই লড়াই খুব তাড়াতাড়ি শেষ হোক।

Post a Comment

0 Comments