লকডাউনের দিনলিপি

করোনা তোমার কোন পথ দিয়ে

নীতা মণ্ডল


দেশে লকডাউন ঘোষণা হয়েছে। সবাই বন্দি। হোক না নিজের ঘর, তবুও বন্দি তো! মানুষ নামের যে প্রাণী শত বাধা অতিক্রম করে আকাশে উড়েছে, সমুদ্রে ভেসেছে, মহাকাশে পৌঁছেছে, চাঁদের মাটি ছুঁয়ে এসেছে তারা বদ্ধঘরে থাকবে?
থাকবে। কারণ আবার একদিন তারা একটা সুস্থ পরিবেশে শ্বাস নেবে, বেঁচে থাকবে। তাদের ছেলেমেয়েরা এক বাসযোগ্য পৃথিবীতে চলে ফিরে বেড়াবে। সমগ্র মানবসভ্যতার অমন বিপর্যয় আটকাতে কটা দিন কী আর এমন!
ভেবে দেখলে নিজগৃহে বন্দিত্ব নতুন কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথের নিষ্কৃতি কবিতার মঞ্জুলিকাকে মনে পড়ে? ‘বাপের ঘরটি আপনি মোছে ঝাড়ে,/ রৌদ্রে দিয়ে গরম পোশাক আপনি তোলে পাড়ে,/
ডেস্কে বাক্সে কাগজপত্র সাজায় থাকে থাকে;/ ধোবার বাড়ির ফর্দ টুকে রাখে।’ আমাদের এই পরনির্ভরশীল জীবনে ধোপা নাপিতও বন্ধ। সংসারের কাজ করতেই দিন ফুরিয়ে যাবে।
হঠাৎ ছেলে প্রশ্ন করে, ‘কী করে বন্ধুদের না দেখে থাকব মা?’
আমি দাঁত খিঁচিয়ে ওঠি। হাতে ভাঁড়ারের কৌটো। খুলে খুলে দেখি কী আছে, কতটা? মানসচক্ষে ভাসে ছেলের বয়সী আমি। অহরহ বন্ধু বিরহে কাতর। স্কুল থেকে ফিরেই নাকেমুখে গুঁজে একছুটে খেলার মাঠে। রোদ ঝড় বৃষ্টিতেও ইশকুল কামাই করা চলবে না। ওদের না দেখে থাকব কী করে!
লকডডাউন শুরু হয়েছিল একটি সংখ্যা দিয়ে। একুশ। পরের দিনগুলো আরও সংখ্যাময় হয়ে ওঠে! খবরের হেডলাইনে মন ভার হয়। জীবনের রস শুকোয়। চেতনায় নতুন সংখ্যা যুক্ত হয়। পৃথিবী জুড়ে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ে। বাড়ে মৃত্যুর সংখ্যা। এদেশে হাসপাতালের সংখ্যা কম, আই-সি-ইউ, ভেনটিলেশনের সংখ্যা অপ্রতুল! সংখ্যাগুলি তালগোল পাকায় মস্তিষ্কে। উন্মোচিত হয় দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার হাল। স্পষ্ট হয় শিক্ষা, অশিক্ষা ও কুশিক্ষার চিত্রটিও।
প্রথমে একুশ সংখ্যাটিকে মনে হয়েছিল প্রতীকী। যেমন সন্তান জন্মের পর একুশ দিন আঁতুড় ঘরে প্রসূতির একলা বাস। আমরা যেমন নিজেদের গুটিয়ে নিতে নিতে প্রায় মাতৃজঠরে ঢুকে পড়ার মতো অবস্থায় পৌঁছলাম। একুশটা দিন তেমন আমাদের নিয়ে গেল আমাদের জন্মক্ষণে। তবে কি একুশ দিন বাদে আমাদের নবজন্ম হবে? 
অজ্ঞাত জীবাণু ঠিক হার মেনে ফিরে যাবে। সঙ্গে সামাজিক ব্যাধিগুলোও উধাও হয়ে যাবে! জন্মে দেখব প্রতিটি মুখে দেবদূতের ছবি। দেখব, রাগ-দ্বেষ-হিংসাকে ছাড়িয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ভালোবাসা। ধর্ম নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে না আর। সবাই বুঝেছে, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নাই কিছু মহীয়ান’! একুশদিন ধরে আকুল হয়ে ডাক্তারদের দিকে, স্বাস্থ্যকর্মীদের দিকে, বিজ্ঞানীদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সকলে কিছুটা যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠেছে। উন্নতি করছে, তবে স্বার্থপরতা বর্জন করে। টিভিতে বিতর্ক চলছে না, ‘কেন জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পঁচিশোর্ধ ছেলেমেয়েরা গবেষণা করবে!’ বরং কথা হচ্ছে, ‘সবার জন্যে স্বাস্থ্য, সবার জন্যে শিক্ষা।’
হঠাৎ কানে আসে শব্দের কোরাস। কল থেকে জল পড়ছে, ছেলে গুনছে ‘এক দুই তিন...’ ওর হেলথ এলার্ম বেজেছে। তরল সাবানে হাত ধুতে অন্তত কুড়ি সেকেন্ড লাগবে।
এই কদিন ও ঘরের বাইরে পা রাখেনি। নতুন ক্লাসের বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে একদিন স্বগতোক্তি করেছে, ‘কী যে হবে! বড়ই হতে পারলাম না। বোর্ডের পরীক্ষা দেওয়া হল না। কলেজে যাওয়া হল না!’
অপলকে ওর হাত ধোয়া দেখতে দেখতে অকারণ বাৎসল্যে বলে উঠি, ‘রোগা হয়ে গেলি রে বাবু!’ ও বলে, ‘জীবিত তো আছি। এখন আবার রোগা আর মোটা!’
যার ভয়ে আজ প্রায় পুরো বিশ্ব এক হয়ে গিয়েছে, সে যে সাম্যবাদী জীবাণু তাতে সন্দেহ নেই। তার সামনে গরিব-বড়লোক, উচ্চ-নীচ, নারী-পুরুষ, ফর্সা-কালো, নাস্তিক-আস্তিক সবাই সমান। সে যা উপহার দিয়েছে তা আদি অকৃত্রিম মৃত্যুভয়। তবে কি এই একুশ দিনের বিছিন্নতা প্রতিটি শিশুর মনেও মৃত্যুচেতনা জাগিয়ে দিল!

Post a Comment

0 Comments