করোনা

ভারতে করোনার ছোবল কী মৃদু হবে?

বর্ষণজিৎ মজুমদার

ভারতবর্ষে COV ২ ভাইরাস এর ছোবল কী প্রাশ্চাত্যের তুলনায় মৃদু হবে? আমি বলি হ্যাঁ! এবার শুনুন কেন বলছি এই কথা!
মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারি নিয়ে ঘর করি!— এই কথাটা কিন্তু কেবল কথার কথা নয়! ভারতবর্ষের বেশিরভাগ মানুষ পাশ্চাত্যর তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক জীবাণুর মুখোমুখি হয়েছেন, কাদা মাটি, নোংরা জল, জীবাণুসংক্রমণে ভুগে বড় হয়েছি আমরা অনেকেই। এই ব্যাপারটাই ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে শাপে বর।
কিন্তু কেন?
এই ব্যাপারটা বুঝতে গেলে কিন্তু সেই Immunology-র শরণাপন্ন হতেই হবে, যদিও ব্যাপারটা একটু জটিল কিন্তু একটু চেষ্টা করে দেখা যাক সোজা বাংলাতে বলার। আমাদের দেহে মূলত দু ধরণের প্রতিরক্ষা কোষ দিয়ে গড়া সৈন্য বাহিনী। প্রথম ছবিটা দেখুন, একদল তাৎক্ষণিক সৈন্য বাহিনী (Innate Immune Cells ) এদের কাজই হলো জীবাণু বাইরে থেকে ঢুকলেই সাইটোকাইন, ফ্রী রাডিক্যালের গুলিগোলা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। এই সৈন্য বাহিনীর কোনও বাছবিচার নেই, তুমুল গুলিগোলা চালিয়ে শত্রুকে দুর্বল করে দাও, আর ইতি মধ্যে আরেক ধরণের প্রতিরক্ষা কোষ (Adaptive immune Cells) কে সংকেত পাঠাও targeted ভাবে কেবল মাত্র ঢুকে পড়া জীবাণুকে ধ্বংস করার জন্য এন্টিবডি বানানোর। ভ্যাকসিন এই এন্টিবডি বানানোর Adaptive Immune Cell সৈন্য বাহিনীকে আগে থেকেই তৈরি করে রাখে, যেন ভাইরাস ঢুকলেই টার্গেটেড ভাবে এন্টিবডির মিসাইল দিয়ে শত্রু নিধন করে ফেলে আমাদের বাঁচিয়ে দিতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে COV ২ ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে যখন ভ্যাকসিন নেই তখন আমাদের একমাত্র ভরসা তাৎক্ষণিক প্রতিরক্ষা কোষ (Innate Immune Cell) দিয়ে বানানো সৈন্য বাহিনী। ভাইরাস ঢোকা মাত্র কাছাকাছি থাকা কিছু কোষ নিঃসরণ করে Chemokine নামের একধরণের প্রোটিন যা দিয়ে মুহূর্তে বানানো হয়ে যায় এক রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে chemokine এর গন্ধ শুকতে শুকতে দলে দলে চলে আসে সৈন্য বাহিনীর বিভিন্ন ব্রিগেড, ম্যাক্রোফেজ, ন্যাচারাল কিলার সেল, নিউট্রোফিল। এই ব্যাপারটার পোশাকি নাম Homing of Innate Immune Cells । এটা মনে রাখতে হবে যে এই Innate Immune Cell এর প্রধান কাজটাই হচ্ছে প্রদাহ (Inflammation) সৃষ্টি করে জীবাণুকে ধ্বংস করা। আরও একটা ব্যাপার হল এই হিংস্র কোষকে লাগাম পরানোর জন্য কিন্তু এদের মধ্যেই মিশে থাকে প্রদাহ বিরোধী (Anti-Inflammatory ) কোষ, একটা সুক্ষ ভারসাম্য তৈরি হয় প্রদাহপন্থী আর প্রদাহ বিরোধী কোষের মধ্যে, এই দুই রকম কোষের মধ্যে সমন্বয় সাধনকারী কোষ।
হিসেবে কাজ করে বিভিন্ন মাত্রার প্রদাহ প্রদানকারি কোষ (Cells of intermediate Inflammatory Status)। এই ভারসাম্যটা ঠিক ভাবে না থাকলেই জীবাণু দেখলেই এই হিংস্র কোষ বাহিনী শুরু করে দেয় প্রলয় নৃত্য বা তুমুল Cytokine Storm। এটা কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে এই করোনা ভাইরাস ২ কিন্তু নিজে মানুষ কে মারে না, ভাইরাস দেখে প্রতিরক্ষা কোষ অতিরিক্ত হিংস্র হয়ে উঠে শুরু করে দেয় Cytokine Storm যা শেষ পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়ায় Acute Respiratory Distress Syndrome (ARDS) এ। এ সবই হয় এই ভারসাম্যের অভাবে (ছবি ২)। এখন অনেক Immunologist রা একমত যে এই Innate Immune Cell এর সৈন্য বাহিনী অনেক আগে থেকেই যদি অল্প অল্প ভাবে বিভিন্ন রকমের জীবাণুর সংস্পর্শে আসে তাহলে এরা অনেকটা শিক্ষিত আচরণ করে। Inflammatory আর Antiinflammatory Cell এর মধ্যে সুস্থ ভারসাম্য বজায় থাকে, Cytokine Storm আর ARDS এর সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। আজ অবধি ইতালি, আমেরিকা বা চীন এ এই COV ২ ভাইরাস সংক্রমণ জনিত যত মৃত্যু ঘটেছে তার শতকরা ৯৯% এর কারণ কিন্তু এই ARDS। এখন অবধি যা পরিসংখ্যান তাতে ভারতবর্ষে ARDS এর সংখ্যা লোক সংখ্যার তুলনায় অনেক কম। আফ্রিকাতেও কিন্তু তাই, কারণ নানা ধরণের জীবাণুর সঙ্গে মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা ওখানকার স্থানীয় লোকেদের অনেক বেশি।
এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা না বললেই নয়, BCG ভ্যাকসিনের ব্যাপারটা। ১০০ বছররের ইতিহাস এই ভ্যাকসিনের পুরো নাম (Bacillus Calmette -Guerin ), জাপানে, ব্রাজিল, ভারতবর্ষ, পর্তুগালে ব্যবহৃত হয়েছে, প্রাশ্চাত্বে হয়নি, COVID-১৯ এ মৃত্যুর হার এই সব দেশে প্রাশ্চাত্যের তুলনায় অনেক কম। পর্তুগালের পাশের দেশ স্পেনে ব্যবহার করা হয়নি, স্পেনে COVID-১৯ এ মৃত্যুহার কারোর অজানা নয়। BCG ভ্যাকসিন কিন্তু নিজেই এক ধরণের মাইকো ব্যাকটেরিয়া, যা তৈরি করে Trained Immunity আর তাছাড়া এই ভ্যাকসিনের এডজুভেন্ট ক্ষমতা থাকার জন্য Immune Response এর পরিমানটাও অনেক বেড়ে যায়, যার ফলে বেড়ে যায় ভাইরাস বিধ্বংসী ক্ষমতাও। শুনেছি ভারতবর্ষে Indian Council of Medical Research এই ব্যাপারটাতে ভাবছে। এই প্রসঙ্গে আরো একটা কথা আমি পরিষ্কার ভাবে বলে দিতে চাই যে এই সব কথার কোনওটাই কিন্তু Social Distancing এর প্রয়োজনীয়তাকে এক ফোটাও কমিয়ে দেবে না। Lockdown বা Social Distancing অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেটা অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে।



Post a Comment

0 Comments