লকডাউনের দিনলিপি

অভাব দরোজা পেরিয়ে উঠানে 

রাধামাধব মণ্ডল 


মন খারাপের মাস!
ঘরে ঘরে একটি জড়ো হওয়া মনখারাপ!
সে মনখারাপ, লকডাউন চলছে বলে নয়! একটু হলেও বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম! মাথায় ঠেকেছে হাত! মিলছে না সমস্ত জিনিস! দোকানিরা বলছে নেই জোগান! ইচ্ছে করে দাম বাড়াচ্ছে কেউ কেউ! এদিকে গ্রাম জুড়ে বন্ধ হয়ে গেছে কাজ! অভাব বার দরোজা পেরিয়ে নাচ উঠানে এসে থেমেছে! এটা সবার! গোটা গ্রাম আতঙ্কিত!
ওপাড়ার সোনামণি ও খুকুমণির মা তিন দিন জ্বরে পড়ে আছে। দানাটি কাটার ক্ষমতা নেই। বাড়িতে নেই দানার জোগানও। জ্বর আতঙ্কে কেউ যায়নি ওদের বাড়ি। রঘুনাথ গত বৈশাখে কেরলে কাজে গিয়ে ফিরেনি! দু’দিন থানার বাবুরা খাবার দিয়ে গেছে। সেই ঢেকে রেখে দু’বেলা দুমুঠো খাওয়া। ওরা আর কতো দেবে! তাই বাধ্য হয়ে ছ বছরের দুই জমজ বোনকে পাঠিয়ে দিয়েছে, নতুন খোলা ব্যঙ্কের বই দিয়ে! যদি কোনও টাকা ঢোকে! ব্যাংকবাবুরা হম্বিতম্বি করে তাড়িয়ে দেওয়াতে, শিশু দু’টি কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির পথে। রাস্তায় নজরে পড়ে পুলিশ কাকুর! আজকের মতো সে দিয়েছে দুশো টাকা। কিন্তু কাল সকাল হলেই তো আবার চিন্তা! কি করে জুটবে দানাপানি? এ ছবি গ্রামের পশ্চিমের রিফিউজি পাড়ায় বাড়ি বাড়ি! 
আমার গ্রাম থেকে ছোট বাজারের দূরত্ব এক কিমি! আর একটু বড়ো বাজার, সেটি তো প্রায় পাঁচ কিমি! প্রত্যেক বাজারেই একই খেলা লুকোচুরির! পুলিশ গাড়ির যাতায়াতের সময় ছাড়া, সব দোকানদার ঘুর পথে কেনাবেচা এখনও চালিয়ে যাচ্ছে! কি করবে? তাদেরও যে আয় ওই দোকানই! তবুও কিছুদিন সভ্যতার কথা ভেবে, যদি একটু ঘরে থাকে আত্মঘাতী বাঙালি। কিন্তু কে বদলাবে এদের! এরা শুধু ভোটারই রয়ে গেল!
তবুও আশার কথা, এবার আস্তে আস্তে আস্ত একটা বাজার কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু কেন? আজ বাজার খালি প্রশাসন করছে না, বাজার খালি করছে বুক পকেটের টান! মানুষের হাতে তেমন টাকা নেই! তাই আস্তে আস্তে রাজসিক খাদ্যবস্তু রেখে, মানুষ বাঁচার লড়াইয়ে নিজেই নিজের আতঙ্কে ভুগছে! আবার অনেকেই ফিরে আসছে গ্যাস ছেড়ে, কাঠের উনুনে। কষ্টের জীবন যাপনে অনেকেই নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে চাইছেন। চাইছেন চৈত্রের মড়া পুকুরের গিমে শাক, বাড়ির পাশের এটা-ওটা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালিয়ে নিতে! বেলা বয়ে যায়, যন্ত্রণার সময়ে। তবে এটা তো আমার গ্রামের মেটে, ডোম পাড়ার ছবি! গ্রামের বাকিরা এখনও বহালতবিয়তে, পিকনিক মেজাজে রয়েছে! গ্রামের মোড়ে মোড়ে নিয়ম করে বসছে রাত পর্যন্ত জটলা! সেখানে কোনও অন্যথা হয়নি এখনও! তবে মধু না মেলায়, রাতের প্রথম পহরেই পহরিরা আসর ভেঙে ফিরছে বাড়ি!
চৈত্রের হরিনাম, গ্রাম দেবতার পুজো, মঙ্গলচণ্ডী, সবেবরাত, চড়ক এবার বন্ধ করেছে প্রশাসন। কিন্তু মেলা না বসলেও, নিয়ম করে পাড়ায় পাড়ায় চলছে তাসের আসর, জুয়া খেলা; মৃদু বকাবকিও চলছে, এ-সব এড়িয়ে!
চেনা জায়গার হাটের স্থান বদলেছে কেবল! কেমন যেন এক লুকোচুরি খেলছে আমার গ্রামবাসী ও প্রশাসন! সমস্ত হাটের জমায়েত হচ্ছে আগের মতোই, তবে গ্রামে গ্রামে। স্থান বদলে নিচ্ছে সকলে ছলনার মায়াজালে! সরকারি কেটে দেওয়া বৃত্তে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, মাল বওয়ানো থলি; আর দূরে সমবেত আড্ডা জমছে বিড়ির আগুনে বিড়ি ফুঁকে, তর্ক হচ্ছে এই কালব্যাধির নিরাময় নিয়ে!
একদল বাইক বাহিনী পঞ্চায়েতের কাগজ দেখিয়ে, জনসেবার নামে গ্রামে গ্রামে ঘুরছে, আত্মীয়তা করছে চা সরবত খেয়ে! চলছে সেলফির বন্যা! এতো সমাজসেবী দেখছি? সত্যি তো, আগে দেখিনি কখনও? তাহলে গত বছর রাখহরি মেটের বেটা ট্রেন থেকে পড়লে, ওদের কাছে কেউ তো তেমন এগিয়ে এসে করেনি সাহায্য! তাহলে, আজ কেন হঠাৎ এতো ভিড়? মিলছে না উত্তর! একদল হুজুগে সাংবাদিক এদের দৌড় করাচ্ছে, ছবি ছাপার নাম করে!
আমাদের গ্রামের মেটে পাড়ার কেষ্ট কাকা, ছোট থেকেই আমাদের চাষের জমিতে সবুজ ফলায়! কালো মাটির এই মানুষটি দুপুরে যা খান, তা কার্ডের হিসেবে মিলবে না! ফলে আজ পেট ভরছে না তার! সবার কার্ডও হয়নি। পক্ষাঘাত সামনে সবে বিছানা ছেড়ে উঠেছে ওপাড়ার দিনুর বাবা। সে-ও পায়নি ওষুধ! কেউ শুনছে, কোনও কথা!
আমাদের মতো গ্রামে সাজা বাবু মধ্যবৃত্তদের অবস্থা তথৈবচ! সমস্ত উৎসমুখ বন্ধ হয়ে গেছে! কোনও আমদানি নেই! সকাল হলেই ব্যয়! এই কয়েক বছরে একটু বাবু সাজতে গিয়ে, গ্রামের মধ্যবৃত্তরা উনুন ছেড়ে গ্যাস ধরেছে, ধান সিদ্ধ ছেড়ে চাল কিনতে ধরেছে, একটু-আধটু লোক রেখে ধরেছে রান্না করানো, বাসন মাজাতেও! সেই অভ্যাসেই ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন বামুন গিন্নি মা! এবার শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব! বাড়ি বাড়ি চিল চিৎকারে, কোকিলের ডাকও শোনা যাচ্ছে না গ্রামে! সঙ্কট কালে চরমভাবে হতাশ হচ্ছে এই শ্রেণির মানুষেরাই বেশি! উপার্জনের উৎসমুখ আটকে যাওয়ার ফলে, কেবলের বিল, নিত্যবস্তু কেনাতে হচ্ছে সমস্যা! এদিকে সুযোগ বুঝে বাড়ছে গ্রামের দোকানে দাম! কে করবে নিয়ন্ত্রণ?
বাড়ির জানলা খুললেই দেখছি, মাধুকরী জীবীর আসাযাওয়া! আসা-যাওয়া বাড়ছে দিন দিন, অচেনা মানুষের ভিড়ে চেনা মানুষের দল! মনে হচ্ছে এমনটা আর পনেরো দিন চললে, করোনা না এলেও অভাব আসবে চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের গ্রামে! সেই দিনের পথ চেয়েই কাটাচ্ছি, একলা বৈশাখ!

Post a Comment

0 Comments