লকডাউনের দিনলিপি


স্মৃতি আর এই ক্ষত

সুমন গুণ

ব্রুকলিন ব্রিজে ছিলাম অন্তত ঘন্টাদুয়েক। দূরে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি, হাডসন নদীতে নানা আকারের জলযান, আর ব্রিজভর্তি অজস্র মানুষ। সারা পৃথিবী থেকে এসেছেন তাঁরা। সেই ছবিটি দেখছিলাম। এইতো, এক বছর আগের কথা। দেখছি আজকের ব্রুকলিন ব্রিজ এর ছবিও। উৎসাহ ও উল্লাসের ঠিক উল্টোদিকে এই বিপন্ন শূন্যতা, ওই কপর্দকহীন বেঞ্চ। আমার মনে পড়ল ‘বিফোর সানরাইজ’ নামের সেই করুণ ছবিটি, যেখানে সদ্য পরিচিত যুগল একটি উদ্দাম রাত ভিয়েনায় কাটিয়ে আবার নিজের নিজের গন্তব্যে চলে যাবার পরে ক্যামেরা ফিরে আসে সেই সব নির্বাক পার্কে, সড়কে, ব্রিজে, নদীতীরে— কিছুক্ষণ আগেও যা ভরা ছিল সখ্যে, সান্নিধ্যে।
নিউইয়র্কে আমি ছিলাম চেলসিয়ায়। মনে পড়ছে সেই মিঠে পাড়াটির কথা। নিউইয়র্ক, গতির শহর নিউইয়র্ক স্তব্ধ হয়ে গেছে— এমন অবিশ্বাস্য দৃশ্য এ জীবনে দেখতে হবে কোনওদিন কি ভেবেছিলাম?
মনে পড়ছে প্যারিসের কথা। প্যারিস শুনলেই সংস্কৃতির শরীরে হাত দেবার শিহরণ হয়। আমার মনে আছে, ল্যুভরের উল্টো দিকে মেট্রোগহ্বরের পাশে দাঁড়িয়ে দু’হাত ছড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিলাম : I am in Paris! হেমিংওয়ে যে রেস্তোরাঁয় এসে বসতেন, তার জানালায় হাত দিয়ে স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম সৃষ্টিশীলতার শীর্ষ মুহূর্তকে। সেই প্যারিস, সৃষ্টির শহর প্যারিস আজ মৃত্যুর শহর। মনে পড়ছে সেই পাবটির কথা, মধ্যরাত থেকে ভোর পর্যন্ত যেখানে বোদলেয়ারের জন্মদিনে তরুণতম ছেলেমেয়েরা মৃদু আলোর নিচে একের পর এক পড়ে শুনিয়েছিল বোদলেয়ারের কবিতা। সেই সুরম্য চর্চা-বিপণি আজ নিস্তব্ধ। মধ্যরাতের প্যারিসে এখন অসহনীয় মৃত্যুর নিঃশ্বাস!
জুরিখে এক বেলার জন্য গিয়েছিলাম। অভূতপূর্ব হ্রদের ধারে অতুলনীয় জুরিখ। সেখানেও করোনার থাবা সব তছনছ করে দিয়েছে। যা কিছু সুন্দর, যা-কিছু আরাধ্য, রমণীয়, তার শরীরে আজ অসহ্য ক্ষতচিহ্ন। একি আমাদের সময়েরই রূপক? 

Post a Comment

0 Comments