ধারাবাহিক উপন্যাস

মেয়েবেলা হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। গোল্লাছুটের দুপুর এখন দিগন্তের পাখি। একলা আঁধারে মুখ নেমেছে পথের হাওয়ায়। বাহির থেকে ঘরে ফেরার অশ্রুতপূর্ব-কথার আখ্যান— নেইবাড়ির মেয়েরা। লিখছেন অঙ্কন রায়


সাত
যতটুকু লিখেছি এই পর্যন্ত, একদিন সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে ভানুদাদার হাতে দিয়েই দিলাম আমার লেখা দিস্তার সেই পাতাগুলো। ভানুদাদা সেগুলো নিয়ে গিয়ে আলোকবর্তিকার বাগানে বড় আমগাছটার তলায় বসে বসে পড়ছেন। আমি দূর থেকে দেখছি দাদার মুখে ভাবের বদল। যখন এসেছিলেন, হাসিখুশিই ছিলেন। সবাইকে হেঁকে ডেকে দুয়েকটা মজা করে চানার মাথায় চাঁটি মেরে বলেছিলেন, ‘কই, এক কাপ চা খাওয়া’।
চানা দৌড়েছিল চা আনতে। আর এখন ভানুদাদাকে দেখছি গম্ভীর। কপালের চামড়া কুঁচকে একদৃষ্টে আমার লেখা পাতাগুলোর ওপর ঝুঁকে বসে আছেন। মাঝে মাঝে চোখ তুলে ওই আমগাছটার মগডালের দিকে তাকিয়ে আছেন। আনমনে কিছু ভাবছেন, আবার পাতার ওপর ঝুঁকে পড়ছেন।
 একসময় দাদা উঠে এলেন বারান্দায়। আমি একটু টেনশনেই ছিলাম। কি বলেন না বলেন ভেবে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম বারান্দার রেলিং ধরে ধরে। দাদা আমায় কাছে ডেকে হাতে কাগজের দিস্তাটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘অহনা, তুই আমার মুখ বন্ধ করে দিয়েছিস। এ লেখার ভালমন্দ কিছু হয় না। আর এরকম লেখা কখনও কোনও ছোটদের উপন্যাস হতেই পারেনা। তবু তোরা ছোট। তবু এটা তোদের উপন্যাস। একেবারে বাস্তবের জীবন থেকে উঠে আসা তোদের নিজস্ব কথা। তুই লিখতে থাক। অকপটে লিখতে থাক বোন। এ লেখা আর কেউ লিখতে পারবেনা তোরা ছাড়া। লিখতে থাক।’
 বুঝলাম ভানুদাদার মনটা প্রবল ভাবে নাড়া খেয়েছে আমার এই কয়েক পৃষ্ঠা লেখায়। উৎসাহ বাড়লো আরও লেখার। আজ লিখবো চানার কথা। চানার দুঃসহ ছোটবেলার কথা।
 আলোকবর্তিকা বাড়ির অদূরে বাইরের রাস্তায় ইতিউতি ঘুরে বেড়াচ্ছিল চন্দনা। আমাদের চানা। বছর তিনেক আগে। চাইল্ডলাইনের কর্মী মলয়দাদা ওকে ওভাবে ঘুরতে দেখে নিয়ে আসেন আমাদের বাড়িতে। প্রথমে আসতে চাইছিল না। অনেক ভাবে বুঝিয়ে, স্নেহের হাত বাড়িয়ে ওকে আনা গিয়েছিল বাড়ির ভিতর পর্যন্ত। কি ভাগ্যিস মেয়েটা আমাদের বাড়ির কাছাকাছি ঘুরছিল নিজের অজান্তেই। ওর জন্য নিয়তি বরাদ্দ করেই রেখেছিল এই নিশ্চিন্ত আশ্রয়। তাই বুঝি এ বাড়ির আসে পাশেই ও ঘুরছিল আর মলয়দার চোখেও পড়ে গিয়েছিল।
 চানা ওর ছোটবেলার কথা একটু একটু করে আমাদের কাছে মেলে ধরতে বেশ কিছুদিন সময় নিয়েছিল। তারপর ক্রমশ নিজেকে প্রকাশ করেছে আমার কাছেই, কারণ দিন কতক পর থেকে আমার সঙ্গেই ওর ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে। আমার বয়সীই মেয়েটা। এই চোদ্দ কি পনেরো হবে বড়জোর।
 চানারা যে গাঁয়ে থাকত সেটা আমাদের এই সবুজবাগ থেকে অনেক দূরে। মেদিনীপুরের ওদিকে পঞ্চটিয়া গ্রাম। গাঁয়ে চানার মা’র বদনাম ছিল। সেটা প্রথম প্রথম বুঝতো না অবশ্য চানা। কিন্তু একটু বড় হতেই গ্রামের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের মুখে শুনেছিল ওর মায়ের চরিত্র ভাল নয়। অন্য গাঁ গেরাম থেকে লোকজন আসে মা’র কাছে থাকতে। থেকে কি করে তারা, সেটা চানা বুঝতো না। বোঝার বয়সও ছিল না। ওর বাবা ছিলনা। তবে একটা লোক প্রায়ই মা’র কাছে আসতো একটু রাত্তির ক’রে। সেই লোকটাকে দেখিয়ে মা বলত, ‘এই বংশীধর বাবু তোর বাবার মতোন। তুই ওঁকে বাবা বলে ডাকবি’।
 চানা বুঝতো না বাবার মতোন হলে কেন বাবা বলে ডাকবে। মতোনদের কি বাবা ডাকা যায়? ওর বন্ধুদের বাবারা তো কেউ মতোন নয়। তারা তো সব সত্যিকারের বাবা। ওর কেন একটা সত্যিকারের বাবা নেই? এসব ভাবতো চানা আর ওই লোকটাকে বিশেষ পাত্তা দিত না। মা মাঝে মাঝে রেগে গেলে ওকে ছড়ি দিয়ে পেটাতেন, সেই ভয়ে সামনাসামনি ও লোকটাকে বাবা বলেই ডাকত অবশ্য। তবে ওকে চানার একটুও ভালো লাগতো না।
 ঠিক আমার মতোই যখন ক্লাস ফাইভ চানার, সেই সময় একদিন ওর হিসুর জায়গা দিয়ে রক্ত এল। সেটা দেখে ভয়ে ও মাকে বলতে গিয়েছিল ছুটে। বলেছিল, ‘মা, আমি আর বেশিদিন বাঁচব না। আমার কঠিন রোগ হয়ে গেছে। হিসি দিয়ে রক্ত পড়ছে’। মা ওর কথা শুনে কোথায় ভয় পাবেন, তা নয় উল্টে হাসতে হাসতে বললেন, ‘এইবার তুই বড় হয়ে গেলি চানা। আর আমার কোনও চিন্তা থাকলো না’।

আট
সুলেখা দিদি আমাদের ছবি আঁকতে শেখান। আলোকবর্তিকা বাড়িটার চারদিকে অজস্র গাছপালা দূরে অদূরে ছোটখাটো টিলার মতো উঁচু নীচু জমি আর খানিক তফাত দিয়ে বয়ে যায় কোপাই নদী। সমস্ত জায়গাটা নিরিবিলি আর ছবির মতো সুন্দর। দিদি আমাদের কাগজ পেন্সিল রঙ দিয়ে এই প্রকৃতির মধ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে যার যেটা মনে আসছে আঁকতে বলেন। উনি নিজেও একটা কাগজ আর রঙপেন্সিল নিয়ে আঁকতে বসে যান কোনও টিলার উপরে বা সোনাঝুরি গাছের গোড়ায়। আমরা প্রকৃতিতে যা দেখছি সেটাই আঁকতে বলেন। কিন্তু ওঁর আঁকাগুলো হুবহু প্রকৃতির দৃশ্যপট হয় না। অন্যরকম হয়ে যায়। একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘দিদি, তোমার আঁকা বুঝতে পারি না কেন? আমরা আঁকলে তো বোঝা যায় কোনটা কি। তোমার গাছটা ঠিক গাছ নয়, মানুষগুলোও পশুর মতো, রঙ ভরছো যেখানে যা খুশি... আমাদের একটু বলবে গো এরকম আঁকার কারণ কি’।
 সুলেখা দিদি বলল, ‘আসলে দেখ আমরা খালি চোখে যেটুকু দেখছি, সেটাই তো শুধু সত্যি নয়। এই সত্যির বাইরে একটা দিক আছে বাস্তব। আর একটা দিক আছে কল্পনা। এই বাস্তব আর কল্পনার রঙ মিলে মিশে তৈরি হয় একটা বিমূর্ত ভাবনা। সেই ভাবনাকেই রঙ তুলিতে প্রকাশ করেন শিল্পীরা। কিন্তু তার আগে সত্যিকারের প্রকৃতিকে চিনতে হয়। জানতে হয়। তোদের এখন সেই চেনা আর জানার স্টেজ। আরও বড় হলে আমার ভাবনাগুলো নিজের ভাবনার মিশেল দিয়ে দেখতে শিখবি। তখন আমার ছবির মানে বুঝবি। কেমন? এখন কি এঁকেছিস দেখা’।
 আমি দিদিকে দেখালাম আমার একটু আগেই আঁকা ছবিটা। সেখানে অনেক গুলো বড় বড় গাছের ফাঁক ফোকড় দিয়ে মাটিতে নেমে আসছে সূর্যের আলো আর সেই আলো গায়ে মেখে শুয়ে আছে একটি উলঙ্গ শিশু।
 দিদি বললেন, ‘বাঃ। এই ছবিটা কত সুন্দর। প্রকৃতির মাঝে এ যেন এক দেবশিশু। এর কোনও পোষাকের প্রয়োজন নেই। আর গাছেরা যেন ওর বাবা, মা, ভাই... সবাই মিলে ওকে আগলে রেখেছে। অপূর্ব তোর কল্পনা’।
 আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম, ‘দিদি, এই গাছ গুলোর আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা জামা কাপড় পরা কতগুলো লোকের ছবি যদি এঁকে দিই তাহলে সেটা খুব খারাপ দেখাবে, তাই না গো?’
 দিদি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, ‘ঠিক বলেছিস রে। সেটা খুব খারাপই দেখাবে। সেটা হবে ঘোর বাস্তবের ছবি। ওই জামাকাপড় পরা লোকগুলো নগ্ন দেবশিশুটির মর্যাদা দিতে পারবে না। ওটা হয়ে উঠবে একটা অশ্লীল ছবি’।
 বাকিটুকু আমার ভাবনার জন্য রেখে দিয়ে সুলেখা দি চলে গেলেন চানার কাছে। ও বোধহয় তখন একটা সমুদ্রের ছবি আঁকছিল।
 চানার যেদিন হিসুর জায়গা দিয়ে রক্ত এসেছিল সেদিনই রাতে ও মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেছিল ওই লোকটাকে। মা’র বুকের আঁচলটা নামানো আর সেখানে অন্য কোনও জামা নেই। মা বলছে, ‘আজ নিচের দিকে নেমো না। ওখানে রক্ত আছে। আর একটা খবর দিই। আমাদের চানারও আজ রক্ত এসেছে। এবার ওকে তুমি কাজে লাগাতে পারবে। আমায় এবার ছাড়ো তো বাপু। তোমায় নতুন জিনিষ দিচ্ছি। মোটা টাকা আদায় করবো’।
 চানা মা’র কথা সবটা বোঝেনি, কিন্তু এটা বুঝেছিল যে রক্ত আসাটা কঠিন রোগ নয়। আর ওর জন্য কোনও অজানা দুর্দিন অপেক্ষা করছে খুব শিগগিরি।

নয়
বংশীধর নামের লোকটা চানার মা’র সঙ্গে প্রতিদিন রাতে যা করতো, একদিন সেটাই করতে এল চানাকেও। সেদিন মা বেরিয়েছিল অন্য কোথাও। হয়তো ইচ্ছে করেই। ওই লোকটাকে সুযোগ দেওয়ার জন্য। সেদিন সে কথাটা চানা বুঝতে পারেনি। এখন পারে। আমায় একটু একটু করে ওর কষ্টের দিনগুলোর কথা ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে বলে আর চোখের জল ফেলে। আমি ওকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলি, ‘সে সব দিন তো শেষ হয়ে গেছে বোন আমার। ও নিয়ে একদম ভাববি না। দেখনা, আমরা আলোকবর্তিকায় এতজন মেয়ে কি আনন্দে থাকি। ভানুদাদা আমাদের গান শেখাতে আসেন। সুলেখাদি ছবি আঁকা শেখান। ভাল ভাল ভাবতে শেখান। আমাদের আর কষ্ট কি বল?’
 চানা বলছিল, ‘সে দিন রাতের কথা ভুলতে পারিনা রে। যে লোকটাকে মা ‘বাবা’ বলতে শিখিয়েছিল, সে ঘরে ঢুকে এসে আমায় মায়ের মতো করে দিল। আমি বাধা দেওয়ায় আমার হাত পা খাটের পায়ার সঙ্গে বেঁধে মাথা দিয়ে, মুখ দিয়ে আমার সারা শরীর...’
 আমি বললাম, ‘চুপ চুপ। আর বলতে হবে না। কতবার বলবি এই এক কথা। ওই লোকটা একটা নোংরা লোক। আর তুই আমি আমরা হলাম সমুদ্রের মতো। সেদিন মালবিকা মাসি বলছিল না, আমাদের অনন্ত ঢেউ। সেই ঢেউয়ের ঝাপটায় যত পাপ... যত পাপী সবাইকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেবার ক্ষমতা রাখি আমরা। কাঁদবিনা। চল আমরা ভানুদাদার আগের দিন শেখানো গানটা প্র্যাক্টিস করি। ওই যে, ‘বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, বাঁধ ভেঙে দাও, ভাঙো...!’
 চানা সেদিনের পর থেকে শুধু সমুদ্রের ছবি আঁকে।
 সন্ধে ছিল খুবই গরীব ঘরের মেয়ে। ওর বাবা মা ছিল না। মারা গিয়েছিল না কি কোথাও নিরুদ্দেশ, জ্ঞান হওয়ার পর থেকে সে খবর পায় নি ও। কিন্তু ওর একটা দাদা আর একটা বৌদি ছিল। তারা ওর সত্যি সত্যি দাদা বৌদি হয়তো ছিল না, তবে ওদের কাছেই সন্ধে থাকত আর ওভাবেই ওদের সম্বোধন করত।
 দাদা বৌদির বহু বছর বিয়ে হয়েও কোনও বাচ্চা কাচ্চা হয়না তাই ওরা মনমরা হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে সেই দুঃখের কথা বছর পনেরোর সন্ধের কাছে বৌদি বলে। সে কি উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। সত্যি বলতে কি কোনও উত্তর তো এ নিয়ে ওর কাছে থাকার কথাও নয়। ও গরীব বাড়ির মেয়ে। তিনকূলে কেউ ছিল না কোনওদি্ন। স্কুলের মুখ দেখেনি জন্ম থেকে। ভাগ্যবলে ছোটবেলায় বছর সাত আট আগে এই দাদা বৌদিরা ওকে পেয়ে নিজেদের কাছে রেখেছিল। তাই দুটো খেয়ে প’ড়ে ওদের ফাই ফরমাস খেটে দিন পেরিয়ে যায়।
 একদিন বৌদি সন্ধেকে বলেছিল, ‘বোনটি, আমার একটা সাহায্য করে দিবি? আজীবন সে উপকারের ঋণ শোধ করতে পারব না। তোকে একটু বুঝিয়ে বলি...’।
 সন্ধে শুনছিল বৌদির মুখের দিকে চেয়ে। বৌদি বলে চলেছে, ‘আমার জন্য একটা বাচ্চার জন্ম দিতে পারবি? এখানে নয়। আমরা অনেক দূরে অন্য একটা শহরে গিয়ে থাকব। এক বছর দেড় বছর পর ফিরে আসব। তোর দাদা মাঝে মধ্যে আমাদের কাছে যাবে। তারপর বাচ্চাটা হয়ে গেলে আবার আমরা ফিরে আসব নিজের বাড়িতে। বল না বোনটি। করতে পারবিনা আমার জন্য এটুকু? বল আমায়...বল’।
 সন্ধে নিজের কানকে বিশ্বাস করাতে পারছিল না এই কথা। ও ভাবতেও পারছিল না এরকমটা কি ভাবে সম্ভব। দাদা কি তবে বৌদিকে যা যা করার সেগুলো ওর সঙ্গে করবে? ছি ছি। ওর তো বিয়েও হয়নি। আর বোধ বুদ্ধি এ সব ব্যাপারে অনেকটাই হয়ে গেছে ওর। এমন আশ্চর্যকথা বৌদির মুখে শুনে ওদের মনোভাব বুঝতে পেরে আর এক মুহুর্ত ওদের কাছে থাকার ইচ্ছে রইল না সন্ধের। মনে হচ্ছিল পালিয়ে কোনও নির্জন জায়গায় চলে যাবে। সেখানে যত রাজ্যের ভয় থাকুক, এই রকম দাদা বৌদি তো থাকবে না।
 ও পালালো। সেদিন রাতেই ওই বাড়ি ছেড়ে পালালো সন্ধে। কোথায় যাবে... কার বাড়িতে উঠবে... কিচ্ছু জানে না। শুধু জানে এই দাদা বৌদির সঙ্গ ও আর সহ্য করতে পারবে না।

দশ
আমি মাঝে মাঝে বাড়ির কথা ভাবি। ভাবি আমার ভাইয়ের কথা। পাড়ার তিন চারজন বান্ধবীর কথা। মাঝে মাঝে এও ভাবি যে ওদের মতো ফোর ক্লাসের পর পড়া ছেড়ে দিলে আমার ওপর এরকম বিপর্যয় নেমে আসতো না। দূরের স্কুলে যেতে হতনা ঋজু নামের একটা ছদ্মবেশধারী রাক্ষসের সঙ্গে। ওর জন্য আমার জীবনের সব কিছু, সমস্ত কিছু বদলে গেল। তবে ভাল হল এটাই যে আমি আরও অনেক অনেক মানুষের প্রকৃত রূপ জানতে পারলাম। তাদের চিনতে পারলাম। সবচেয়ে বেশি চিনলাম আমার শিক্ষিত বাবা, গাঁয়ের প্রাইমারী স্কুলের হেডসার কিঙ্কর বাগদীকে। আমার শরীরটা সেই ছোট্ট বয়সেই যে রাক্ষসগুলো খুবলে খেলো, তাদের কিছুই হল না। আমারই মাঝখান থেকে বাড়িছাড়া হতে হল চিরদিনের জন্য। বাবা সেই আমার রেপ হবার দিন থেকেই আমায় আর তাঁর বাড়িতে থাকাটা মেনে নিতে পারেন নি। তাঁর সামাজিক প্রতিষ্ঠা, তাঁর শিক্ষা আমায় দূরে সরিয়ে দিল ওঁর থেকে। আমায় পাঠিয়ে দেওয়া হল বাবার এক পরিচিতের বাড়িতে কোলকাতার এক অপরিচিত বসতি এলাকায়। মিথ্যে করে বলা হল সেটা আমার এক পিসির বাড়ি। সেখানেই আমার স্কুলে যাওয়া, পড়াশোনার ব্যবস্থা সব কিছু করা হবে। সে কথা যে ডাহা মিথ্যে, তা কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝে নিয়েছিলাম। সারাদিন প্রচুর ঘরের কাজ করাতেন আমার সেই পিসি। তারপর গঞ্জনা, অত্যাচার তো লেগেই ছিল। কথায় কথায় আমার শরীরের কথা তুলে গালাগাল দিত। বলত, ‘মরে যাওয়া ঢের ভাল একটা মেয়ের, যাকে কুকুরের দল খুবলে খায়। ‘আমি বুঝতাম না পিসি ওদের যখন কুকুর বলছে তখন আমায় মরে যাওয়ার কথা বলছে কেন! আমি তো মরতে চাইনা। আমি নতুন করে বাঁচতে চাই। প্রাইমারী স্কুলে আমি গান গাইতাম, ছবি আঁকতাম, নিজে বানিয়ে বানিয়ে ছড়া গল্প এসব লিখতাম। হেডসারের মেয়ে বলে সবার কাছে আমার খাতিরই ছিল আলাদা। সেই আমার জীবনটা এই ভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? না না কিছুতেই তা হতে দেওয়া যায় না। আমি বাঁচবো। আবার নতুন করে অন্য কোথাও, অন্য কোনও সংসারে নতুন জন্ম নিয়ে বাঁচবো।
 সেই বাঁচার পথ দেখালেন আমায় ভানুদাদা। আমাদের আলোকবর্তিকার গানের মাস্টারমশাই চিত্রভানু কর। সত্যিই, কোন এক অদৃশ্য দৈবের বলে ভানুদাদাকে একদিন পেয়ে গেলাম বসতির বাচ্চাদের ক্লাবে। এখনও ভাবলে শিহরণ ওঠে মনে। এ তবে ভাল লাগার শিহরণ। ভানুদাদাদের একটা চাইল্ডলাইনের টিম বসতিবাসী ছোট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দেখা ক’রে তাদের সুবিধে অসুবিধের কথা জানতে এসেছিল। এ ভাবেই ওঁরা কাজ করেন শহরে, গ্রামে ঘুরে ঘুরে। তো আমার সঙ্গে ওখানেই আলাপ দাদার। সুলেখাদিদিও ছিলেন সঙ্গে। আমার সব কথা ওঁদের খুলে বলেছিলাম। ভাগ্যিস বলেছিলাম! সেই বলার ফল আজ আমি আলোকবর্তিকায়। আজ আবার আমি নতুন ক’ রে বাঁচার মানে খুঁজে পেয়েছি। আমার মতো কষ্টের জীবন থেকে বেরিয়ে আসা আরও বন্ধুদের সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। পেয়েছি রবি ঠাকুরকে, তাঁর গানকে, পেয়েছি ভানুদাদাকে আর মালবিকা মাসিকে। পেয়েছি সুলেখা দিদিকে আর এভাবেই পেতে পেতে ভরে উঠেছি সবার ভালবাসার হাত ধরে। ভ’রে উঠেছি আমাদের গল্পের জন্য হাতে কলম ধ’রে। (ক্রমশ)
অলঙ্করণ : অর্চিতা মুন্সী 

Post a Comment

0 Comments