সম্পাদকীয়

রোমান্স ভুলছি কমিউনিফেকে

আবীর মুখোপাধ্যায়


একবার নববর্ষের সময়। ‘রবিকাকা’ শান্তিনিকেতন থেকে চিঠি লিখছেন তাঁর ‘প্রাণাধিকেষু’ ইন্দিরাকে।
সন-তারিখ ১৩২৯-এর ২ বৈশাখ।
‘‘কল্যাণীয়াসু,
নববর্ষের আশীর্ব্বাদ গ্রহণ করিস। শিলাইদা ঘুরে এলুম— পদ্মা তাকে পরিত্যাগ করেচে— তাই মনে হল বীণা আছে, তা’র তার নেই। তার না থাকুক, তবু অনেককালের অনেক গানের স্মৃতি আছে। ভাল লাগল, সেই সঙ্গে মনটা কেমন উদাস হল।...’’
বর্ষ শুরুর দিন, ডাকপিওন যদি এমন কোনও নববর্ষের চিঠি আপনাকে দিয়ে যায়, প্রথমটা খুব অবাক হবেন, তাই না! করোনা-ক্লান্ত এই নির্বাসনে অবশ্য কেউ এখন চিঠি দিতে আসবে না আপনাকে। কেন না, চিঠি লেখা সহবত যে কবেই বাতিলের দলে নাম লিখিয়েছে! তাই নববর্ষের দিন চিঠি পেলে আমরা ভাবি, নিশ্চয় কেউ মশকরা ফেঁদেছে!
অথচ এই সেদিনও নববর্ষ অথবা বিজয়ার সকালে বাঙালির ডাকবাক্সে এমনতরো চিঠিই আসত দূর থেকে দূরের প্রিয়জনের কাছ থেকে। এমনতরো চিঠির জন্য অপেক্ষা ছিল। পথ চেয়ে কাল গোনার অপেক্ষা। সেটাই ছিল সহজ, স্বাভাবিক। সুখ-দুঃখের নানা কথার ঝাঁপি সেই সব চিঠিতে যেন উপুড় করা থাকত। থাকত, আশ্চর্য এক স্পর্শের সুখানুভূতিও! ‘স্নেহ’, ‘ভালোবাসা’, ‘শ্রদ্ধা’, ‘প্রণাম’— বাংলা শব্দগুলো সেদিন যেন অন্তরের গহন থেকে লেখা থাকত ওই চিঠিগুলোয়। শুধু চিঠিতেই— কেন না, সেদিন আমাদের নাগালের বাইরে ছিল পারস্পরিক যোগাযোগের নব্য মাধ্যমের পথ। তখনও বাঙালির মগজে ঢোকেনি হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, মেসেঞ্জারে টুকুস করে স্রেফ ইমোজি পাঠিয়ে জীবনের সকল লেনদেন ফুরানো! গ্রাফিক্স পাঠিয়ে সুখ-শান্তি-ভালবাসা বিলোনো!
খুব ছেলেবেলায় দেখেছি, খাঁকি উর্দির ডাকপিওন আনন্দকাকার নতুন বছর শুরুর কয়েকদিন আগে থেকে চিঠির তাড়া নিয়ে আসত। নববর্ষ অথবা বিজয়ার দিন মামারবাড়ি থেকে হাত চিঠি বয়ে আনত হিরালাল। সেই চিঠি নিয়ে আমাকে আর বোনকে পড়ে শোনাত মা। আমাদের জন্য কি লিখেছে— সে কথা কেবলই জানতে চাইতাম। পড়তে পড়তে কখনও মায়ের চোখের কোণ চিকচিক করে উঠত। তারপর, এক চিলতে কাগজে ওই ভৃত্য হিরেমামার হাতেই উত্তর লিখে দিত মা। আমরা মায়ের সঙ্গে সঙ্গে চিঠির উপর ঝুঁকে পড়ে দেখতাম, মা সুলেখা কালিতে লিখছে, ‘শ্রীচরণেষু বাবা...।’ চিঠি নিয়ে হিরেমামা চলে যেত। একসময় পল্লির গাছ-গাছালির ফাঁক দিয়ে, আমরা ভাই-বোন চেয়ে থাকতাম দূরে মামারবাড়ির পথের দিকে চেয়ে।
আমি যে সময়ে মামারবাড়ি থেকে ভৃত্যের চিঠি বয়ে আনার কথা বলছি, সেটা তিন-সাড়ে তিন দশক আগের কথা। বিদ্যুৎ পৌছালেও, গ্রামে গ্রামে টেলিফোন তখনও ‘রূপকথা’! একুশ শতকের শুরুতেই বিপ্লবতাড়িত তথ্যের প্রসারিত মোহপাশ এসে প্রথম বাঙালিকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরল। এই বিপ্লব, ইনফর্মেশন রেভলিউশন। কথাটার অনেক কেতাবি ব্যাখ্যা। কখনও নলেজ রেভলিউশন, কখনও যোগাযোগ বিপ্লব। সাগরপারে এতে আর যাইহোক আমাদের বঙ্গজীবন বদলে গেল আপামর! চিঠির মতো টেলিফোনও হয়ে উঠল বাঙালির সুখ-দুঃখ, অভাব-অনুযোগের নিত্য রোমান্স-সঙ্গী। জীবন অভ্যেসের হাত ধরে একটু একটু করে সে ঢুকে পড়ল আমাদের শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতির অন্তরমহলে। মনে পড়ছে পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘কথোপকথন’— সাত বছর পর ইউরোপ-ফের্তা নন্দিনী এক বৃষ্টি দিনে টেলিফোনে যোগাযোগ করলে, শুভঙ্কর বলে, ... টেলিফোনে হঠাৎ আমাকে?/ কি করে নাম্বার পেলে? কে জানাল এই সময়েই/ নিজের গহ্বরে একা থাকি? উত্তরে নন্দিনী জানিয়েছে কি করে সে জোগাড় করেছে শুভঙ্করের ‘মহার্ঘ্য’ নম্বর।
নববর্ষের বা বিজয়ার চিঠি জন্য যেমন অপেক্ষা ছিল, টেলিফোনে একটি ‘কল’-এর জন্যও অপেক্ষায় দিন কাটাতাম আমরা। এত সহজ ছিল না সেদিন— ‘কেমন আছিস’, ‘খেয়েছিস’, ‘ভাল থাকিস’, ‘ঘরে থাকিস’— কথাগুলো মুহূর্তে জানার-জানানোর! অপেক্ষা দুঃখ, অপেক্ষার আনন্দ ছিল!
মনে পড়ছে অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ‘অন্তহীন’ ছবির একটি দৃশ্যের কথা। ছবিতে দেখা যায়, নায়ক অভির পিসিমা সারা জীবন একটি টেলিফোন কলের জন্য অপেক্ষা করে পার করে দেয়। ছবিতে সে অভির প্রশ্নের উত্তরে জানায়, বাইশ বছর আগের সেই দ্বিপ্রহরের কথা। তাঁর স্মৃতি থেকে তুলে আনা সংলাপ ছিল এইরকম,
—বাইশ বছর তো হবেই। ভরদুপুরে টেলিফোনটা বেজে উঠল। মাঝবয়সি পুরুষের গলা।
—হ্যালো কমলিনী...
বুঝলাম, রং নম্বর।
—বাড়ি ফিরেছ তাহলে?
বললাম,
—না, এখানে কমলিনী বলে তো কেউ থাকে না।
—সরি, সরি মাপ করবেন আমাকে!
—না, এতে মাপ করার কি আছে।
ছবিতে তারপর পিসিমা স্বগোতোক্তির ঢঙে বলে চলেন, ‘‘কিন্তু জানিস, ভদ্রলোক ফোনটা ধরেই রইলেন। আর আমিও ফোনটা কাটলুম না। আমরা দুজনেই চুপচাপ। ফোন ধরে। কিছুক্ষণ পর ভদ্রলোক বললেন, ‘রং নম্বর হলে লোকে এত বিরক্ত হয়, আপনিই প্রথম যিনি এত সুন্দর করে বললেন। একটুও বিরক্ত হলেন না।’ আর আমি, আমি জানিস, বলেই ফেললাম, ‘আপনার গলাটা কী সুন্দর!’ একটি রং নম্বর থেকে দুই হৃদয়ের সম্পর্ক, চিরদিনের।
এখন রং নম্বর খুব বেশি হয় না আর। জেনে বুঝেই অনেকে ফোন করেন। কখনও কথা হয়, কখনও হয় না! এনগেইজড টোন পেলে অন্য নতুন কোনও কলে চলে যাওয়াই হালফিলের সাইবার-সহবত। অপেক্ষা আর কোথায়! বাঙালিদের জীবন থেকে অপেক্ষার রোমান্স হারিয়ে যাচ্ছে এই নিত্য সুলভ-সংযোগে। কমিউনিফেকে!
এই নির্বাসন-পর্বে নিত্য এত মানুষ পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছেন— একে কি আমরা কমিউনিফেক বলব? কেউ কেউ নিরন্তর বলছেন। কেউ কেউ তিনবেলা। বেহালায় ছাদে দাঁড়িয়ে যে যুবতী সারা সকাল কথা বলছেন... অথবা ওই যে কানে সেলফোন রেখে বাঁকুড়ায় রান্না-ঘরে যে মহিলা বিউলির ডাল আর পোস্ত রান্না করছেন বা যে যুবক উদ্দেশ্যহীন ভাবে কানে ফোন নিয়ে সারা আবাসন ঘুরছেন— এঁদের অনেকেই কি মিথ্যে মিথ্যে ইথারে উড়ছেন? বিরামহীন এই যোগাযোগ তাহলে ‘ভান’? সংযোগ ভান! চারপাশে একটা নতুন কথা শুনছি— নির্বাসন পর্ব শেষ হলে নাকি নতুন এক পৃথিবীর জন্ম হবে। কেমন সে পৃথিবী জানতে চাই না। শুধু নতুন সময়ের কাছে দাবি রাখি— মিথ্যে হোক কমিউনিফেক! নতুন বাংলা বছরের শুরুতে এইটুকু কামনা করি— আমাদের জীবনের প্রতিটি শব্দে, যতি চিহ্নে, ছত্রে ছত্রে ভরে থাকুক অনুভব। সংযোগে মিলুক স্পর্শ সুখ! কেমন সে সত্য-সুন্দর ও সহজ সংযোগ? কথার পিঠে কথা সাজিয়ে লেখা তেমন একটি চিঠি পড়ব। ১৯১৮ সালের অক্টোবর মাসে, ‘ভানুদাদা’ লিখেছেন তাঁর ‘প্রিয় রাণু’-কে।
‘‘রাণু, তোমাকে যদি ‘প্রিয় রাণু’ লিখি তা হলে কি রকম শোনায়? তাহলে আমি জানি তুমি নিশ্চয় রাগ করবে— কেন রাগ করবে বলব? কেন না, প্রিয় বিশেষণটাকে যদি চিঠি লেখবার একটা পাঠ করে তোলা যায় তা হলেই ওর সত্যকার মানেটা দৌড়ে পালায়। অথচ ‘প্রিয়’ শব্দটার খুব একটা মস্ত মানে— অত বড় মানে যখন পালিয়ে যায় তখন শূন্য কথাটা ভয়ঙ্কর একটা ফাঁকির মত পরিহাস করে। প্রথম যখন তোমার চিঠি পেয়েছিলুম তখন তোমার চিঠিতে ‘প্রিয় রবিবাবু’ পড়ে ভারি মজা লেগেছিল। ভাবলুম রবিবাবু আবার প্রিয় হবে কেমন করে?...।’’




Post a Comment

0 Comments