রবিবার

ফেলে আসা সাইকেল

বিশাখা রায়


সকাল গড়িয়ে কখন যে ক্যাম্পাসে সন্ধে নামে তা ছুটি না থাকলে টের পাই না। সন্ধের পরে রবির বানানো গরম চা বেশ কয়েক কাপ আর মোবাইলে টুকটাক কথা এভাবেই সাঁঝবেলা রাতের অন্ধকারে মিশে যায়। সবার খবর পেতে ফেসবুকই ভরসা, তা সে লেখালেখি হোক বা অন্যকিছু।

সন্ধের পরে বারান্দার সোফায় গিয়ে বসি দখিনা হাওয়ার টানে। সামনে বিশাল লন মালির আদরে রূপসী হয়েছে বেশ। তার এককোণে শান্তিনিকেতন থেকে আনা গুলঞ্চে অনেক খোসামোদে ফুল ধরেছে। সামনে ধূমায়িত ফার্স্ট ফ্লাশ পানীয় আর গান ও কবিতাভাণ্ডার, আমার চির-সখা আমার একান্ত নিজস্ব ভুবন।
মোবাইলে আলোয় জ্বলে ওঠে একটা প্রশ্ন— “আপনি কী অমুক স্কুলে পড়েছেন?”
লিখলাম –“হ্যাঁ”।
“ইয়ার- ১৯?”
“হ্যাঁ”।
তারপরের ভেসে ওঠা লাইনটিতে বুঝলাম ইনি আমায় বেশ ভাল করেই চেনেন।
লিখল— “তুমি কি এখনও ওমন মুখ নীচু করে মাটির দিকে তাকিয়েই হাঁটো?”
 চমকে উঠলাম। কবিতার মতো শোনাচ্ছে যে! চুপ করে ভাবছি কী বলব।
আবার লিখল— “তোমার বাড়ির ঠিকানা— এন, গরচা ফার্স্ট লেন আর ল্যান্ডলাইন। তাই তো?”
 এবার আমি বাকরুদ্ধ। সে তো চৌত্রিশ বছর আগেকার ঠিকানা। সেই লাজুক মুখ-নীচু মেয়ের ঠিকানা, ফোননম্বর, আমার ফেলে আসা দিনের কথা এমন সযত্নে আগলে রেখেছে কে? কেন?
আমার হতচকিত অবস্থা বুঝতে পেরেই বোধহয় সে লিখল— “আমিও B.G.H.S.”
“মানে?”
লিখল— “বালিগঞ্জ গভঃ হাই স্কুল”।
লিখলাম— “কিন্তু আমি তো সেখানে পড়িনি। কোথাও ভুল হচ্ছে”।
লিখল— “জানি তো। এতদিন পরেও তুমি এত সহজ, একটুও বদলাওনি”।
লিখলাম— “আপনি আমায় দেখেছেন?”
লিখল— “আচ্ছা, তোমার নালন্দা টিউটোরিয়ালের কথা মনে আছে?”
লিখলাম— “অবশ্যই। কত প্রাইজ পেয়েছি ওখান থেকে। রাখা আছে আমার ছোটবেলার খামে। কিন্তু এত সব আপনি কী করে জানলেন? আপনি কে? আমার খোঁজ পেলেন কী করে?”
লিখল— “লেখার হাত তো ভালই। ঐ বসিরহাটের দাঙ্গাবিরোধী লেখাটা যদি শুভব্রতকে না পাঠাতে তবে তুমি এখনও অধরা থেকে যেতে”।
লিখলাম— “শুভব্রত তো আমার ফেসবুকের বন্ধু”।
আবার প্রশ্ন— “খাস্তকে মনে আছে?”
“কোন্ খাস্ত?”
“আরে, খাস্তগীর। ওর বোন পড়ত তোমার সঙ্গে আর খাস্ত আমার সঙ্গে”।
“হ্যাঁ হ্যাঁ। সোমা। ও তো কখনও আপনার কথা বলেনি! ওর দাদা তো কালপ্রিট। কিছুতেই সোমাকে বলতে দিল না। বলল বাড়িতে জানলে সোজা গলা ধাক্কা আর উদোম ক্যালা…সরি।”
লিখল— “এবার আমার পরিচয় না দিলে অন্যায় হবে। আমি জয়তোষ বন্দ্যোপাধ্যায়। পাথর ফাটানো আমার কাজ”।
লিখলাম— “মানে?”
লিখল— “মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার”।
মাথার মধ্যে কেবল ঘুরছে মুখ নীচু, ঠিকানা, ফোন নম্বর। কেমন ঘোর ঘোর আবেশ! সে নিমেষে কত টেক্সট করে চলেছে। কিচ্ছু পড়িনি। হঠাৎ চোখ গেল “তোমার মোবাইল নম্বরটা দাও তো। অনেক কষ্টে পেয়েছি। তোমার নামের বানানটা এত উদ্ভত কেন বলতো। মুখটা মিললেও নামের বানানটার জন্য সাহস পাচ্ছিলাম না। তারপর ভাবলাম জয়তারা বলে কপাল ঠুকে দেখি না! নম্বর দাও। বিস্তর কথা আছে। রাত জাগো? তাহলে রাতেই কথা বলব। অসুবিধে হবে?”
রাত জেগে বই পড়ি, গান শুনি, আড্ডা দিই। ফোন নম্বরটা দিয়ে লিখলাম— “বেশি রাত পর্যন্ত জাগি না। সকালে স্কুল থাকে”।
মেসেজ আসা বন্ধ হল। কিন্তু মনের মধ্যে তখন ফেলে আসা দিনকে নতুন করে দেখার রোমাঞ্চকর এক আশ্চর্য অনুভূতি!
ফোন এল সেই রাতে। এক নিশ্বাসে ও যেন ওর সব কিছু বলে দিতে চায়। ওর পড়া, বাড়ি, চাকরি, স্কুল কলেজের বন্ধুরা, কোথায় কবে পোস্টিং, প্রেম, বিয়ে, মেয়ে, দিদি, ভাই, মা, বাবা— সব, সব বলে চলে।
আমিও হাঁটতে থাকি। সেই মেরুন স্কার্ট, সাদা শার্ট, লম্বা বিনুনি। উল্টোদিকের ফুটপাতে চলেছে দুটো চোখ। পার হয়ে আসতে চাইছে আমার কাছে আর খাস্তকে হাতে পায়ে ধরে দুচোখকে বলছে, তোর এই কীর্তি জানলে না বাড়ি থেকে বের করে দেবে। আরও হাঁটছি। মেরুন রঙ স্কার্ট আর ক্রিম লেসের টপ। বাড়ির লোকের পাহারায়। একটু গল্প। দুচোখ দূর থেকে দেখছে। কখনও একা পেলে কাছে এসে জিজ্ঞেস করছে— “ঘণ্টা পড়ে গেছে? অথবা কখন এলে?”
আমার অতি সংক্ষিপ্ত উত্তরে সে বুঝে নেয় কাছে ঘেঁষা মুশকিল। ভেবে নেয় এটা আমার অবজ্ঞা। ছুটির ঘণ্টা পড়তেই দোতলার সিঁড়ি থেকে সবার আগে নামা দুচোখের কেবল একটু দেখার জন্য। মাস পেরিয়ে বছর ঘোরে। নালন্দার ক্লাস শেষ হয়। দুচোখ কেমন করে যেন আমার ঠিকানা খুঁজে পায়।
তারপর ফাইনাল পরীক্ষা, ছুটি, রেজাল্ট।
মাসতিনেক পরে আমি যখন সাদা শাড়ি, কমলা পাড়ে কালো টেম্পলের কাজ আর কালো ব্লাউজ, তখন হাঁটতে হাঁটতে কয়েকবার শুনেছি আমার পাশে পাশে একটা সাইকেল চলেছে আর বলেছে “চিনতে পারছ? আমি জয়, জয়তোষ। নালন্দায়?”
মাথা নীচু করে হেঁটেছি। “আরে! আমরা তো সহপাঠী। উত্তর নেই কেন? কোন স্ট্রীম? সায়েন্স তো? নালন্দার কাছেই স্যার খুব ভাল অঙ্ক করান। যাবে?”
উত্তর আসেনি। সাইকেল চালক শেষে সচ্চিদানন্দ নাম নিয়ে বাড়িতে চিঠি দেয় পড়ার বিষয়ে জানতে চেয়ে, সঙ্গে নিজের নাম ঠিকানা। চিঠি পড়ে এক বিভীষণের হাতে। আমার বাড়ি থেকে সাইকেলের পাড়ায় গিয়ে প্রাণের ভয় দেখিয়ে তাকে দমিয়ে দেয়। লজ্জায় বলে উঠি— “আমি সত্যিই এসবের কিচ্ছু জানি না”।
জয় বলল— “আমি ভাবলাম, তুমি তো অসম্ভব সুন্দর আর পড়াশুনোতেও তুখর। তাই ভাবলাম সেই অহঙ্কারেই হয়তো তুমিই তাকে পাঠিয়েছ”।
বললাম— “ও আমার বাড়ির লোকও ছিল না। একটা শয়তান ছিল ও। তখন কেন এই অন্যায়ের কথা জানাননি? আজ বলে কী লাভ?”
আমায় থামিয়ে দিয়ে জয় বলে চলল— “ওর তীব্র যন্ত্রণার কথা, ওর জীবনের বাঁচা-মরা, ওর লড়াইয়ের কথা। তার মুখ্য ভাগ জুড়েই কেবল সেই স্বপ্নের হাঁটা ষোল বছর, দুই বিনুনি, আনত মুখ। এই এক জীবনের গল্প এক নিশ্বাসে যেন গেঁথে নিতে চায় এক লহমায়”। আমি যেন দেখছি বলতে বলতে ষোল বছরের সেই কিশোর দুচোখ এক অপার্থিব আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। ও বলে চলেছে— “বিশ্বাস করো, আমি অনেক চেষ্টা করেছি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে তোমায় সবটা বলতে। আমি পারিনি। তুমি একবারও তাকাওনি চোখ তুলে। আমি তোমার চোখ থেকে সাহস নিতে চেয়েছিলাম। তুমি একবার যদি তাকাতে আমি সব পারতাম। তোমার চোখে সম্মতি চেয়েছিলাম”।
থামিয়ে দিয়ে বললাম— “কী লাভ এসব বলে? ভাল থাকুন। শান্তিতে থাকুন”।
ও থামল না, অনর্গল বলেই চলল।
রাতের অন্ধকার চিরে বিন্দু বিন্দু ব্যথার রঙ চুঁয়ে পড়ছে আকাশ জুড়ে আর বুকের মধ্যে বেজে চলেছে— “সমস্ত জীবন জুড়ে কেবল তোমায় ভালবেসেছি। আমি তোমার সঙ্গে ঘর পেতেছি, খুনসুটি করেছি, তোমার সঙ্গে বসত করি। আজও তোমায় নিয়ে কবিতা লিখি... আজও, এখনও... আমৃত্যু। শুধু এটুকু জানো, আজ তোমার ভেতরের নরম নদী তোমার চোখ বেয়ে গলে গলে নামছে, এক অব্যক্ত ব্যথা তোমার বুক ভেঙে দিচ্ছে, সেই যন্ত্রণা আমি একা এই চৌত্রিশটা বছর ধরে বুকে করে ঘুরছি”।
(আশ্চর্য! ও কেমন করে জানল আমার চোখের ঝাপসা আলোর কথা!)
“সে কথা কাউকে বলিনি। আজ আমায় বলতে দাও প্রাণ খুলে কেবল তোমার কাছে। এবার আমায় নাও, আমার আশ্রয় হও। আমি বড় ক্লান্ত”।
বললাম— “বেলাটুকুই তো গেছে, মন তো ফুরোয়নি। আজ এই দোলপূর্ণিমায় আমার সামনের সবুজ লন পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়ার আবীরে রঙিন হয়ে উঠেছে। না-পাওয়ার রঙ ও এত সুন্দর আর অপাপবিদ্ধ! সেই রঙ দিলাম তোমায়”।

Post a Comment

1 Comments

  1. আহা! খুব মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা।

    ReplyDelete