লকডাউনের দিনলিপি

হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তগুলো

শাশ্বত ভট্টাচার্য 


আজকে এইমুহূর্তে দাঁড়িয়ে যে শব্দটি ত্রাসের কারণ হয়ে উঠেছে, সেটি করোনা।
অদৃশ্য শক্তি, যা থাবা বসিয়েছে আজ সমগ্ৰ বিশ্বের মানবসমাজের উপর, কেড়ে নিয়েছে একের পর এক প্রাণ। নিঃশেষ করে চলেছে একের পর এক দেশ, বাধ্য করেছে মানুষকে প্রতিমুহূর্তে নিজ অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখার জন্য বাঘের মতো লড়াই করতে। কাউকে শারীরিকভাবে, আর তার থেকে অনেক বেশি মানসিকভাবে। ওষুধ নেই এ রোগের— দেশবাসীকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকার যে পদক্ষেপ নিলেন, তাতে স্তব্ধ হল দেশ।
লকডাউন হয়তো কেড়ে নিয়েছে আমাদের প্রতিদিনের গল্প-আড্ডা-মজা সমস্ত কিছু, কিন্তু একটিবারের জন্যও কী আমরা ফিরে দেখেছি যে, লকডাউন আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছে অনেকগুলো ছোটো ছোটো মুহূর্ত যেগুলো বোধহয় আমাদের অতিব্যস্ততায় পরিপূর্ণ জীবনে কোথাও একটা হারিয়ে গিয়েছিল। সেই মনটা যেটা কিনা চাপা পড়ে গিয়েছিল ভয়ানক ব্যস্ততার চাপে। আজকে কেউ মনে করতে পারি, ঠিক কতদিন আগে আমরা শেষবার মন দিয়ে বাবুই পাখিকে বাসা বাঁধতে দেখেছি, ঠিক কত বসন্ত আগে শেষবার মন দিয়ে কোকিলের ডাকটা উপভোগ করেছি, ঠিক কত দিন আগে শেষবার পিঁপড়ের দলকে মুখে করে শীতের জন্য খাবার সংগ্ৰহ করে নিয়ে যেতে দেখেছি। মনে পড়ে শেষবার আমরা কতদিন আগে একসাথে পরিবারের সকলে মিলে একটুখানি সময় কাটিয়ে গল্প-ঠাট্টা করেছি, নাহ্, পারি না, পারি না আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্ম আর ভয়ানক ব্যস্ততাকে সরিয়ে নতুন কিছু উপলব্ধি করতে। সেই যে রাস্কিন বন্ড লিখেছিলেন না, ‘The Eyes Have It’ গল্পে, ‘Well, it often happens that people with good eyesight fail to see what is right in front of them. They have too much to take in।’
আসলে, লকডাউন আমাদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বাড়িয়েছে, কিন্তু মনের ছিদ্রপথ? সে পথ যে আজও খোলা, যে পথে অনায়াসেই এক লহমায় মেঘের নৌকোয় চেপে পৌছে যাওয়া যায় সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে, মুছে দেওয়া যায় সমস্ত সীমানা, ভুলে যাওয়া যায় সমস্ত ভেদাভেদ— সেই গানের মতো—
         ‘আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি
          মন বান্ধিবি কেমনে?
         আমার চোখ বান্ধিবি, মুখ বান্ধিবি
         পরান বান্ধিবি কেমনে?’
একটুখানি সচেতনতাই বোধহয় অদৃশ্য এই মারণরোগকে প্রতিরোধ করতে পারে, বন্ধ করতে পারে সংক্রমণ। আর তাই একরাশ আশা বুকে নিয়েই অপেক্ষা, যেন দ্রুত স্বাভাবিক হোক পরিস্থিতি, মুছে যাক এই অদৃশ্য শত্রু সমগ্ৰ পৃথিবী থেকে। বেরিয়ে আসুক এক নতুন আশার আলো, দিকে দিকে সঞ্চারিত করুক নতুন প্রাণের স্পন্দন, সমাপ্তি হোক এ নির্বাসন জীবনের।

Post a Comment

0 Comments