বইপাড়া

হিরণদা আঁকেন না, আঁকে চারপাশ

দেবর্ষি বন্দ্যোপাধ্যায়


হিরণ মিত্র। ঋত্বিক ঘটক নীচের ফ্রেমে যাঁর জন্য অমন ঈশ্বরের মতো তাকিয়ে আছেন। যেন বলছেন, ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে। সব পুড়ছে। লাল রক্তের ছিটে। গামলা ভর্তি রক্ত। শপিং মলে রক্ত। কল খুললে রক্ত। কফির কাপে রক্ত। ক্যানভাসে ক্যানভাসে, পত্রিকার প্রচ্ছদে প্রচ্ছদে, নাটকের মঞ্চে বা সিনেমার পর্দায়-বিগত দশকগুলি যিনি ধরে রাখলেন, ধরে রাখলেন, সাদাক-কালো বা লাল রেখায়-তিনি, আর কেউ নন, এক অভিশপ্ত মাইকেলেঞ্জেলো, যিনি প্রশ্ন করেন বারবার, জল জলের আদত মানে কি না! জানতে চান, জীবনব্যাপী অনুসন্ধানে তলিয়ে থেকে, লাল-নীল-সবুজ রং বা বর্ণ-শব্দের ভেতরের ধ্বনি, শ্বাস-প্রশ্বাস-ঘাম-তন্তু-কোষ, ভেঙেচুরে দিয়ে বর্ণমালা--সেই, আমাদের শহরের পরাক্রান্ত সিসিফাস, হিরণ মিত্র; বছর ৭৬ এর এক গেরিলা ছবি-যোদ্ধা।
এ বছর ভিমবেটকায় গিয়ে অবাক বিস্ময়ে পাথরের গায়ে দেখছিলাম হাজার বছর আগের মানুষের হাতের দাগ। আতলামিরা যাওয়া হয়নি। পিরামিড না দেখলেও অজন্তা-ইলোরা দেখেছি। কারা তুলেছেন এসব পাথর, কারা বানালেন এই ঐশ্বর্য তা নিজের আত্মজীবনীতে প্রশ্ন করেন বার্গম্যান। আমরাও জানি না। কিন্তু হিরণদা জানান, তাঁর রেখায় মিশে আছে হাজার বছর ধরে এঁকে চলা পাঁজরের চিৎকার, মধ্যরাত্রির প্রলাপ। জানান, তিনি আসলে আঁকেন না। আঁকে, তাঁর চারপাশ। একান্নবর্তী দুনিয়া। তিনি শুধু ক্যাওস থেকে অর্ডারে যান। দিনমান। আজও। তাঁর ম্যুর এভিনিউয়ের বাড়ির স্টাডি বা ছাতে। তিনি এঁকে চলেন। নিরন্তর। মজা করে বলেন, আসলে খুন করে চলেন। নামিয়ে আনেন দস্যু-জানোয়ারদের। তারপর চলে অবিরাম প্রলাপ। খুন-জখম। ফ্রেমে এসে লাগে রক্তের ছিটে। সে ছিটে শুকোতে থাকে খোলা ছাতে বা মাঠে। বাড়তে থাকে তার দৈর্ঘ্য। এক সময় ফ্রেম-ট্রেম ভেঙে বেরিয়ে যায় ছবির আত্মা। হিরণদা হাসেন। ঘটকের মতোই সে হাসির মানে, সব পুড়ছে, ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে!
‘মুখ-মুখর’ বইটি হিরণদার জীবনের এক জরুরি দলিল। গত চার দশকে তাঁর জীবনের আত্মার পাণ্ডুলিপি। যাঁদের সাথে তিনি বেঁচে থেকেছেন, যাঁরা তাঁর সহযাত্রী-কমরেড-বন্ধু, তাঁদের মুখ চেয়ে আছে এ বইয়ের পাতায় পাতায়। হিরণদা জানান, তাঁরাই আঁকিয়ে নিয়েছেন ছবিগুলি। হিরণদা শুধু দর্শক সেখানে। প্রলাপের ঘোরে একটানা সবার বিভঙ্গ আঁকতে আঁকতে হিরণদা হরিণের দ্রুততায় ভেঙে দেন প্রচলিত পোট্রেটের বয়ান। ভেঙেদেন এক-রৈখিক ইতিহাসের কিছু প্রচলিত ব্যক্তির ব্যজস্তুতি, উঠে দাঁড়ায় এমন অনেক মানুষ বা নাম, যারা ৭০-৮০-৯০ দশক জুড়ে কলকাতাকে করে তুলেছিল আন্তর্জাতিক এক শহর। সেই বিকল্প ইতিহাস স্বার্থক ভাবেই মুছে দিয়েছে মূলধারা। কিন্তু হিরণদা তাঁদের ভোলেননি। আর ভোলেননি বলেই, ইতিহাস এসে হাত রেখেছে অনন্য ভাবে এই বইতে। এমন অনেক নাম, যেমন দীপক মজুমদার, অরিন্দম চক্রবর্তী, মানস রায়, অনিরুদ্ধ ধর, সুবিমল বসাক, রানা সরকার, গৌর, কলাবতী মজুমদার, গৌতম চট্টোপাধ্যায়, মনসিজ মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শুচিস্মিতা ঘটক, সুবিমল মিশ্র, অনিরুদ্ধ লাহিড়ি, কমলকুমারদের একটানা এঁকে রাখেন তিনি।
এঁরা কেউ আজ আর বেঁচে নেই। কেউ বিদেশে। কেউ ইতিহাস। কেউ প্রতিষ্ঠান। কেউ একই রকম দ্রোহপুরুষ। হিরণদা শুধু এঁদের ধরে না রাখলে, এদ্দিনে মূল ধারার গণমাধ্যম এদের মুছে দিত। আমরা, যারা ৯০-র মার্ক্স ও কোকোকলার সন্তান, তাঁরা জানতেই পারতাম না, এডিট করতে করতে কীভাবে বাঙালি ভুলে যেত কখন মাঝরাত গড়িয়ে গেছে, কীভাবে কাঁকুলিয়ার আড্ডার প্রতিভাবান শিল্পী অকালে ঝড়ে গেলেন, আন্তর্জাতিক আঙ্গিক নামের সিনেমার এক কাগজের জন্য কীভাবে অপেক্ষা করতেন স্বয়ং সত্যজিৎ, সন্দীপনের কথা শুনতে শুনয়ে কীভাবে একটানা এঁকে চলেছিলেন হিরণ তাঁকে অগোচরে, কীভাবে মহিনের ঘোড়াগুলিতে জুড়ে গেলেন হিরণদা, এই এত এত মুখ, শুধু রেখা হিসেবে ধরা দিল তাঁর কাছে। সেই রেখা, যা স্নায়বিক ও সংবেদী, যা ঝড়ের হাওয়া, যাতে উড়িয়ে দিতে চান স্বয়ং হিরণ, উড়িয়ে দেন দেখার প্রচলিত মুদ্রা, বলেন, যা দেখেছি তা ভুল দেখেছি এতকাল বা ভালোভাবে দেখিনি তাই আরেকটা সুযোগ দেন হিরণদা, অ-শিক্ষার দর্শকদের বিপর্যয়ের বর্ণমালা পাঠদ্বারে।
তিস্তাপারের বৃত্তান্তের সেটে কয়েকটা দড়ি ঝুলিয়ে নদী বানিয়ে প্রবাদ গড়ে ফেললেন তিনি। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের ঋত্বিকতন্ত্রের প্রচ্ছদে ছিটিয়ে দিলেন, দুদিকের কালোর মাঝের সাদায় দগদগে লাল; যেন ঋত্বিকের রক্তবমি; দেশভাগ। জারি বোবাযুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে এঁকে চললেন, নানা লেখকের পোর্টেট বা সময়ের দাগ বা ধারাবাহিক স্কেচ। লিটল ম্যাগাজিন বা নাটকের মঞ্চের আজ আরেকনাম হিরণ মিত্র। কবিরা লাইন দেন তাঁর বাড়িতে। নাট্যকাররা আব্দার করেন মঞ্চ সজ্জার। হিরণদা প্রশ্রয় দেন। সবাইকে। সহজ ভাবেই হেঁটে যান নিউ ইউর্ক থেকে দুর্গাপুর। গোটা দুনিয়াই তাঁর একান্নবর্তী পরিবার। মাঠঘাটে নেমে তাই আজও অক্লান্ত তিনি ফ্রেমের পর ফ্রেম এঁকে যাওয়ায়।
দ্বিধাহীন ভাবেই হিরণদা জানান, আমাদের ছবি দেখা শেখানো হয় না। কারণ সেটা সেখানো যায় না। তার জন্য কবি-লেখিক-মানুষ-সদর-মফস্বলে মিশতে হয়। মিশে যেতে হয় খালি। তাই তাঁকে দেখা যায়নি কখনও বুদ্ধিজীবীদের সাথে খুব বেশি। এখানে তিনি অদ্ভূত ব্যতিক্রমী। নিঃসঙ্গ সম্রাট। বরং তিনি স্বচ্ছন্দ রাস্তায়। ঘামে। ভিড়ে। যেখানে মানুষের গন্ধ, ভাতের গন্ধ, দিনান্তের মিছিলের মুঠো হাত...।
এই অধমকে তিনি দু’বার উপহার দিয়েছেন তাঁর ছবি। আমি এ লেখায়, আমাদের শহরের এই সাম্প্রতিক ইতিহাসের মাত্রাকে প্রণাম জানালাম।
ভালো থাকবেন হিরণদা। সলিডারিটি।

Post a Comment

1 Comments

  1. বিশাখা রায়

    খুব ভালো স্কেচ।ভালো লাগল।

    ReplyDelete