লকডাউনের দিনলিপি

বুকের ভার, নিজের কাছেই থাকুক

নির্মল হালদার


করোনা সংকট শুরু হতেই, মহামান্য সরকারের কাছ থেকে শুনতে হল, সামাজিক দূরত্ব। সমাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। কারণটা কি, দূরত্ব বজায় রাখলেই করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাতে পারবে না।
আমি বলবো, ভাইরাস ঢুকেই আছে অনেকদিন আগে থেকেই। মহামান্য সরকার বাহাদুর দেখতে পাননি। এখনও দেখতে পাচ্ছেন না, কিন্তু অন্যান্য দেশগুলি বলছে বলে, আমাদের সরকার বাহাদুরকেও বলতে হচ্ছে, করোনাভাইরাস এসে গেছে। সাবধান। সংক্রমণ ঘটার আগেই ঘরে বন্দি থাকুন। বাইরে যাবেন না। মহামান্য সরকারের নিষেধের পর কত দিন কেটে গেল। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেও সংক্রমণ ঘটে যাচ্ছে! প্রতিমুহূর্তে তৈরি হচ্ছে ভয়।
একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে যাই— এই এক মাসে আমার অনেক বন্ধু আমার কোনও খোঁজখবর করেনি।
খোঁজখবর করতে হলে, সামাজিক দূরত্বের দরকার হয় না। শুধু একটা ফোন: কেমন আছি না আছি এই জিজ্ঞাসা আমার কাছে পৌঁছোয়নি অনেকের কাছ থেকেই। আমি যে বন্ধুজীবি, বন্ধুরাই প্রতিমাসে মাসোহারা দিয়ে আমার দিন চালিয়ে দেয়। এই তথ্যটি প্রায় সবাই জানে। কিন্তু লকডাউন শুরু হতেই, আমি যার কাছ থেকে মূল টাকাটা পাই, সে ফোনে আমাকে জানালো— সে আপাতত টাকা পাঠাতে  পারছে না। শুরু হল আমার সঙ্কট।
বাকি যাদের কাছ থেকে পাই, তারা অবশ্যই পাঠিয়েছে। যেমন এক শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু, আমার সঙ্কট আসছে বুঝতে পেরেই, আগাম টাকা পাঠিয়েছে। আরেক বন্ধু প্রতি মাসে যা দেয় তার চেয়ে বেশি পাঠিয়েছে। এ সব কথা বলার কারণ হল, আমরা সামাজিক দূরত্বেই ছিলাম। যদি দূরত্ব না থাকত, একজন আরেকজনের কুশল জানতে চাইতাম। এখানে সামাজিক দূরত্ব শুধু নেই আছে মানসিক  দূরত্ব। যা ভেতরে ভেতরে ঘটেই গেছে। অনেক আগে থেকেই। কেউ কারোর খবর রাখি না। আমার বৃত্তে যে তরুণ বন্ধুরা আছে তারা কেউই জানতে চায়নি— আমার দিন কেমন চলছে। এই সেদিন এক বান্ধবী জানতে চাইলেন আমার অবস্হা কি। তাকে সবকিছু বলতে, আমাকে কিছু টাকা পাঠালেন। এক অবাঙালি বন্ধুও দিয়েছেন। এসবই হয়। হয়ে থাকে।
তাই আমার কাছে সরকার বাহাদুরের নির্দেশিত সামাজিক দূরত্ব গুরুত্ব পায়নি। আমি জানি আমরা দূরত্ব মেনেই চলছি। আমি জানি কেউ ভাল নেই আমরা। আমি সাতদিন কারোর খবর না নিলেও
কেউ ভাববে না, যে মানুষটা রোজ খোঁজ খবর নিয়ে থাকে, তার হঠাৎ কি হল। কেন না, কারোর সময় নেই কারোর জন্য।
লকডাউন উঠে যাওয়ার পরেও দূরত্ব দীর্ঘ হতে থাকবে। সামাজিক দূরত্বের ভাইরাস অনেক আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং ঘুরতেই থাকবে।

পুনশ্চ
কোনও অভিমান করছি না। যদি করিও, সেও কী আমার দোষ? অভিযোগ অবশ্যই করছি না।
অনুযোগও নেই। আশা করি, সবাই মানুষ শব্দের অর্থ বুঝবেন। মর্যাদা দিতে শিখবেন। আমি যাদের ঘিরে থাকি তারা জানে, আমি একা থাকি। এই লকডাউনে অবস্থাটা আরও সাঙ্ঘাতিক। করুণ। আমার ভাইপো না থাকলে দু বেলা খেতেও পেতাম না। যদি খাবার না জুটতো, কি করতাম, কে জানে।
আমার বন্ধুরা সব জেনেও কী করতো? আমাকে ডাকতো কী তাদের বাড়িতে? গ্রামে গ্রামে পৌঁছে যাচ্ছে চাল ডাল আটা নুন তেল। দান সামগ্ৰী। এই সহযোগিতা এই সঙ্কটে খুব জরুরি। আমার কাছেও জরুরি আমার বাঁচার রসদ। কে নিয়ে আসবে আমার ত্রাণ? আমার মনের ভার,
আমার বুকের ভার, আমার নিজের কাছেই থাকুক। মাটিতে নামাবো না!
কেউ যেন ছুঁয়ে না দেখে!

Post a Comment

0 Comments