পেজ থ্রি

তার দু’খানি নয়নতারা

আবীর মুখোপাধ্যায়


কলকাতায় পা রাখার পরের কথা।
এ শহরে আর পাঁচজন লক্ষ্মীছাড়ার মতো আমারও দিনমান ঠিকানাবিহীন ঠিকানা হয়ে ছিল যাদবপুর ক্যাম্পাসের ঝিলপাড়।
পটের নেশার আড় ভাঙতে ভাঙতে অন্য আরও বড়, সুস্বাদ নেশায় তখন দিব্যি হাত ও গলা পাকাচ্ছি আমরা ক’জন।
আমি ছাড়া, সকলেই দারুণ গিটারিস্ট। গায়ক।
কে যেন, আনোয়ার শা’ থেকে জট পাকানো শিকড় তুলত।
তবে হুল্লাট নেশাটা জমত, অন্য জিনিষে।
ওদের গাওয়া, গানে গানে। ওরা সুমনের গান গাইত।
তার আগে বোলপুরে শুনে ফেলেছি বিক্ষিপ্তভাবে লোকটার গান—
ক্যাসেটে ‘ইচ্ছে হল’, ‘নবাব নবাবি করে, মুটে মুটে গিরি’, ‘জাগে জাগে রাত’, ‘মগজে কারফিউ’, ‘ডানপিটে’, ‘মাঝ রাত্তিরে চাঁদের কাস্তে’! তবু সেই ঝিলপাড়েই শুরু হল নাগাড়ে সুমন শোনা, কবির সুমন!
এখন আর যাদবপুর ক্যাম্পাসে যাওয়া হয় না!
প্রায় এক দশক বয়সে ছোট, ওখানকার বন্ধুনিরা আমাকে সুমন নিয়ে ওঁদের বিস্ময়ের কথা শোনায়। বলে, গানওয়ালা ওই লোকটাই নাকি এখনও ওদের ভালোলাগা, ‘আইকন’! প্রেসিডেন্সির-যাদবপুরের দোস্তরা বলে, ওই লোকটার গানই ওদের ‘ধর্ম’!
দশকের পর দশক, এতটুকও চিড় ধরেনি ওদের ধর্ম বিশ্বাসে।
‘তোমাকে চাই’-য়ের ‘বিশ বছরের বিশ্বাস ও বিস্ময়ে’ যেমন ঘটেনি। সে বার কলামন্দিরে সুমন শুনতে ঢোকার মুখে বন্ধু সুমিত হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল সেই ‘তোমাকে চাই’-এরই ‘একটি ভাবনা সংকলন’। অনির্বাণ সাধু ও ওর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘আলতামিরা’-র প্রথম সংখ্যা ‘কবীর সুমন: তোমাকে চাই’।
হাতে নিতে নিতে ভিড়ের কল্লোলে সুমিতকে শুধু বলতে শুনলাম, ‘আমরা পেরেছি, পড়ে মতামত দিও’। তিনশো পাতার চিন্তা ঋদ্ধ সংকলন শেষ ক’রে একটু আগেই মনে হল, সুমিতরা সত্যিই ‘পেরেছে’। ফোন করেছিলাম সুমিতকে।
মনে পড়ছে সেই সংকলনের সম্পাদকীয়তে সুমিত ও অনির্বাণ সাধু লিখেওছে সে কথা গভীর প্রত্যয়ে, ‘সুমনের গান আমাদের ডিকশানকে বদলে দিয়েছে এবং যোগ করেছে প্রেরণা-সাহস-হিম্মত এবং কেজো মানুষের সাম্মানিক বেঁচে থাকাটা। “ভাবো, ভাবা প্রাকটিস করো”, মরা সময়ে এই কমেন্ট, অভ্যাসে পরিণত করলেন- সুমন। আমরা ভর দিলাম তাঁর গানে’।
এ প্রত্যয় নিছক শব্দে নয়।
শুনি প্রজন্মের অঙ্গিকারে, এখনও ঝিলের হাওয়ায়।
সুমন নিয়ে ‘তোমাকে চাই’ সংকলনে চল্লিশ জনের লেখকের লেখা ও শিল্পী হিরণ মিত্রের আঁকা সুমনের কয়েকটি রেখাচিত্র দিয়ে সংকলন সাজিয়েছেন দুই সম্পাদক। লেখক তালিকায় সুধীর চক্রবর্তী, শক্তিনাথ ঝা, অনিল আচার্য, কৌশিক সেন, দেবেশ ঠাকুর, পিনাকী গুহ, সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়... কে নেই!
 শোভন প্রচ্ছদের ব্লার্বে তার জবাবদিহি।
‘কবীর সুমন এবং ঘঠনাপ্রবাহ ঋণস্বীকার, মূল্যায়ন আর আইকন-বাই ভাবনা ছুঁড়তেই ৪০টি লেখা পোটেনশিয়্যাল- ডিফারেন্স নিয়ে তোমাকে চাই একটি সংকলন’।
চোখ থামে, ‘প্রসঙ্গ; বাংলা গান ও সুমন’ শীর্ষক লেখায়।
সুধীরবাবু লিখছেন, ‘...ক্লিন্ন বেদনা, শূন্যতা ও নির্বোধ পরিব্যাপ্তির মধ্যে হঠাৎ শোনা গেল সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান। এক স্পষ্ট ও সংবেদী মেধা যেন ঝলসে উঠল বাংলা গানের অপ্রত্যাশিত প্রান্তরে’।
অপ্রত্যাশিতই বটে!
এবং একই সঙ্গে, ‘সুমনের গান বহুদিন পর বাংলা গানে গীতিকার-সুরকার-শিল্পীর অবিভাজিত সত্তার সম্পূর্ণ আত্মপ্রকাশ’।
স্মৃতির স্মরণীতে সুমনের গান থেকে গানে সময়ের হাত ধরে হেঁটেছেন অলক চট্টপাধ্যায়, অনিল আচার্য, সব্যসাচী দেব, মানস ঘোষ, ঊর্মিমালা বসু, দেবাশিষ রায়চৌধুরী, পিনাকী গুহ, দেবেশ ঠাকুর। 
শুধু স্মৃতিচারিতায় সুমনের গান নয়, সংকলনে অনেকের লেখায় ব্যক্তি সুমনের ‘কানোরিয়া থেকে সিঙ্গুর, সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম, নন্দীগ্রাম থেকে লালগড়’- এ প্রতিবাদী মুখের মিছিলও রাজনৈতিক ভাষ্য এড়িয়ে এসেছে।
স্মৃতির গদ্যে ভিড় করেছে নানা মুখ।
‘সুমন-সম্প্রদায়’-এর মতো নানা নতুন শব্দ!
অনির্বাণ সাধুর ‘তোমাকে চাই’ শীর্ষক লেখায় এ গানের নানান ধুয়ো, বিচিত্র ধরতাই ভালো লাগে।
সুমিতের লেখা ‘চেনা আলো চেনা অন্ধকার’-এ স্মৃতিকাতরতা থাকলেও ঘুরে ফিরে এসেছে এই শহরের তথাকথিত দালাল শিল্পী সমাজ ও অন্যপিঠে এই গানওয়ালার ভিন্ন স্বর।
জর্জ বিশ্বাসের প্রসঙ্গ টেনে সুমিতের সংগত উক্তি, ‘হয়ত, এভাবেই সমকাল গড়ে তোলে বিস্মৃতির পরম্পরা’।
হিরণ মিত্রের সুশোভন প্রচ্ছদের সংকলনে পাঠকের কাছে উপরি পাওনা স্বপ্নময় চক্রবর্তী ‘মুখবন্ধ’ ও একেবারে শেষ লেখা নবারুণ ভট্টাচার্যের সাক্ষাৎকারটি। সুমনকে ছুঁয়ে শেষ লাইনে নবারুণ জানাচ্ছেন, ‘আর্টিস্ট কখন কি করবে কেউ জানে না!’
জানতে পারেন?
না মনে হয়!
যেমন জানতেন না ঋত্বিক।
গানের গভীরে জানতেন না জর্জ বিশ্বাস!

১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছিল ‘তোমাকে চাই’ অ্যালবাম। ঠিক আজকের মতোই ২৩ এপ্রিল! একইদিনে মারা যান সত্যজিৎ রায়। এমন দিনে লিখতে গিয়ে ফিরে পড়া শেষ করতে করতে মনে পড়ছিল, কলামন্দিরের অনুষ্ঠানের মধ্যাহ্ন বিরতির পর অক্লান্ত মেঘ রাগালাপের মাঝে সুমনের কথা আর উপকথন।
বাংলা খেয়ালের মাঝে পিয়ানোয় হঠাৎ রবিঠাকুর গেয়ে ওঠা।
‘যেতে দাও, যেতে দাও গেল যারা’।
কখনও সমে থেমে মঞ্চের সামনে এগিয়ে এসে বলে ফেলা,
‘পিনাকী প্রেক্ষাগৃহের আলোগুলো জ্বালিয়ে দাও, আমি ওদের মুখ দেখব। ওরা আমার সন্তান, আমি ওদের ধর্ম’! 

Post a Comment

0 Comments