রম্য রচ‌না

উড়ো শালপাতা স্মৃতি ডাকে 

অনির্বাণ দাশগুপ্ত

গ্রামের নাম ভ্রমরকোল। নামের মধ্যেই যেন ভালবাসা কোল পেতে থাকে।
পাশেই শাল নদী। বর্ষা ছাড়া বছরের অন্য সময়ে জল থাকে সামান্যই, পারাপারে নৌকা লাগে না, ইচ্ছা লাগে। আজ ভ্রমরকোলের বাতাসে উল্লাস শেষ হেমন্তের সন্ধ্যার মতোই এলোমেলো কিন্তু সজীব। গ্রামের ঠিক মাঝে মঞ্চ, তার চারপাশের জমি থেকে ধান উঠে গেছে কদিন আগেই। ফেলে গেছে ধানের গোড়া। তার ওপরেই শতরঞ্জি পেতে বসার ব্যবস্থা শ্রোতাদের, মঞ্চে আজ শচীপ্রভা, কীর্তন সম্রাজ্ঞী। কারও হয়তো মনে নেই, শচীপ্রভার স্মৃতিতে আজ বড় বেশি উজ্জ্বল এই গ্রামের কথা। কারণ এখানেই কেটেছে শৈশব।
চেনা লাল ধুলো, কামনাগন্ধী খেজুরের রস আর পঁচিশ বছর আগের স্মৃতিভরে চোখে আসা জল ঠেলে শচীপ্রভা গেয়ে চলে ‘কলঙ্কিনী রাধে...।’ মঞ্চের আলোয় ধাঁধিয়ে যায় চোখ। চারিদিকে অন্ধকার, শুধুমাত্র সামনের কটা সারিতে কিছু মুখে আলো পড়ে। দ্বিতীয় সারির একদম ডান দিকে... কার মুখ ওটা? ঠিক যেন বাবা বসে, চমকে ওঠে শচীপ্রভা। শিরদাঁড়া বেয়ে যেন হিম নামে। গলা কাঁপে, কাটে সুর। কাটা সুর পাখোয়াজে মেক-আপ দেয় বাজনদার। শুকনো গলা ভিজিয়ে শচী আবার শুরু করে ‘কলঙ্কিনী রাধে।’
শচীপ্রভার বাবা ছিলেন হারুন শেখ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া হারুন শেখ, ধর্মপ্রাণ মাদ্রাসা শিক্ষক। তাঁর’ই মেয়ে সামিনা— আজ শচীপ্রভা। বয়স আর ছদ্মবেশ লুকিয়ে রেখেছে সামিনাকে শচীপ্রভার মোড়কে। পঁচিশ বসন্ত আগে কোনও এক অমা রাতে শচী পালিয়েছিল হরবিলাসের সঙ্গে। তখন হরবিলাস তার স্বপ্নের প্রেমিক, সুরের জাদুকর। জাত, ধর্ম ভুলিয়েছিল সুরের টান আর হরবিলাসের নেশাময় চোখ। 
বীরভূমি বাতাসে ঘূর্ণি ওঠে, ওড়ে পাতা, এঁটো শালপাতা... কীর্ণাহারের মণ্ডার প্রাক্তন মোড়ক। বাচ্চাগুলো খেয়েছে, খাবি খা... কিন্তু ফেলবি কি মঞ্চের-ই সামনে! আহা ওদের কি দোষ! ওরা তো জানে না এই উড়ো শালপাতা স্মৃতি বয়ে আনে। দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি হারুন যে তাঁর একমাত্র মেয়ে পালাবে এক বিধর্মীর সঙ্গে। তাই ভর সন্ধ্যায় মেয়ের আনা শালপাতা মোড়া মণ্ডা খেয়েছিলেন তৃপ্তি করেই। ‘ক্ষমা কোরো বাবা, ভেবেছিলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়বে। কিন্তু ঘুম থেকে চিরঘুমে যেতে গেলে কটা বড়ি লাগে, জানতুম না গো... সেটা জানতেই এই ছদ্মবেশে কলঙ্ক মাথায় নিয়ে ফিরে আসা!’
শেষ রাতে ঝড় ওঠে... চোখে জল চেপে শচীপ্রভা গেয়ে চলে ‘কলঙ্কিনী রাধা।’

ছবি : কৌশিক আকি

Post a Comment

0 Comments