লকডাউনের দিনলিপি

আমরা অসহায়

আকাশ সরকার


আমার বাবা এই বিরাট সিস্টেমের একজন সাধারণ দিনমজদুর। কেরালা রাজ্যের কোঝিকোড জেলায় বর্তমানে তিনি কোয়ারেন্টাইন বন্দিদশা কাটাচ্ছেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘কাজ’ বন্ধ। তাই আমাদের এই সামান্য পরিবারটির আগামী দিনগুলি অনির্দিষ্ট ও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা শিখি। মানুষেরা যে ভাষায় কথা বলে।
অথচ কতদিন হয়ে গেল বাবার সঙ্গে কথা হয় নাই। ফ‌োনগুলি অসহায়। চিঠি, ই-মেইল, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটস্‌অ্যাপ সবই ভীষণ শূন্য ও অসহায় নির্বাক দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার ও বাবার মাঝখানে।
টিভিতে পর্দায় দেখতে পাওয়া যাচ্ছে ইটালির আকাশ কী ভীষণ বিষন্ন। মৃত প্রিয়জনের কফিনবন্দি দেহ শেষবার দেখবার সুযোগও পাচ্ছে না অসহায় মানুষ। মানুষের থেকে মানুষে গুজবের চেয়েও দ্রুত রটে গেল এই মৃত্যুকাণ্ড। লক্ষ লক্ষ অসহায় মজদুর হাঁটতে শুরু করল পৃথিবীর পথ দিয়ে। জাপানের পথে ছুটে বেরালো সুন্দর দেহের হরিণ। ফ্রান্সের ফুটপাতে কী যে অসম্ভব রঙিন লাল ফুল ফুটে উঠেছে অজস্র। তাই দেখে আমার মনে রোমাঞ্চ জাগার কথা, অথচ টেলিফোন নীরব নির্বিকার। কতদিন হয়ে গেল বাবার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই।
মায়ের বিষন্ন অসহায় মুখ দেখি। উঠোনে পাখিদের জন্য খুদচাল ছড়িয়ে দেন মা। রান্নাঘরের উনোনের থেকে ধোঁয়া উঠে ছড়িয়ে যায় আকাশে। পাখিরা ভ্রুক্ষেপহীন মাটির উঠোন থেকে খুঁটে খুঁটে খায় খুদ। মা সারাদিন চুপ। সারাজীবন অন্ধকারে। সংসারের গোপন ছায়াময়তায় মুখ লুকিয়ে রয়েছেন। ছোট বোন চকলেটের বায়না করে না। কার্টুন দেখে না। বাংলা বইয়ের সামনে ফাঁকা স্লেট নিয়ে বসে থাকে। বন্ধুরা স্বপ্নে পুতুল খেলার ডাক দেয়। ও খেলনা ফোন হাতে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
আমরা তিনজন। এই অসহায়তা সরিয়ে একটি সামান্য ফোনের অপেক্ষায় রয়েছি। অপেক্ষায় রয়েছি একটি আশ্চর্য সংবাদের। জানি না, সে সংবাদ— দুসংবাদ অথবা সুসংবাদ! 

Post a Comment

0 Comments