করোনা

অর্থনীতি নিয়ে ট্রাম্পও অধৈর্য হয়েছিলেন                        

মৌমন মিত্র (নিউজার্সি থেকে)


চাপ চাপ মেঘ আজ আকাশে। শান্ত বাতাস। আমার নিটোল বাগানে, বেশ ক'টা ফুল ফুটেছে! অন্যান্য বছর, এইসব মন দিয়ে দেখার সময়ই হয় না। আমেরিকায় এখন বসন্ত। স্কুল, কলেজ, আগামী এক সপ্তাহ ছুটি। সকলেই বাড়িতে। ক্লাইমেটও বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে দিনের আলোর সময়সীমা। পথের দু’ধারে, ম্যাগনলিয়া, ডগওড ফুলের যেন সিজানল এক্সপ্লোসান। চেরি ব্লসাম ফুলের, সাদা, গোলাপি রঙের ওরনামেনটেশানে, আমাদের পাড়া যেন ঠিক কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়ার বন! এই ফুলের পাপড়ি ও পাতা— দুটোই এডিবিল। জাপানি চা এবং মিষ্টিতে, ব্যাবহৃত হয়। চেরি ব্লসাম, প্রকৃতির রিনিউয়ালের এক আলংকারিক। এরই মাঝে, চারপাশে ব্লসাম অফ ফ্যামিলিজ। যেন রিনিউয়াল চলছে সম্পর্কেরও। এত বছরে, কোনওদিন, এঁদের এইভাবে পরস্পরের সঙ্গে সময় কাটাতে দেখিনি। কেউ কোনও গাছের বাকলে গাঁ এলিয়ে, আবার দূরে শোনা যায় পাড়াপড়শির কণ্ঠস্বর! সোশ্যাল ডিসটেনসিং ; আমেরিকার পাড়া, গাঁ, শহর, শহরতলির মানুষকে, মানুষের মনের কাছে নিয়ে এল?
এক যুগ ধরে, আমি নিউজার্সির একটি সাবার্বে থাকি। মানুষ, এখানে সর্বদা দৌড়েছে। মনে হত, ভীষণ স্ট্রিক্ট স্কেডিউল রুলড। অফিস, খেলা, টিউটার, ক্লাস— এখানের অ্যাফ্লুয়েন্ট ফামিলির লোকজন, সর্বদা নিয়মমাফিক ছুটছে। এখন, এঁরা মাইন্ড— ফুলি একত্রিত হচ্ছে বিভিন্ন কর্নারে, লম্বা ড্রাইভ-ওয়ের এন্ডে। নিজেদের পেট-ওয়াক করছে, আবার ইয়ার্ডে বল-কিক। রাস্তায়, গাড়ির চলাচলও অনেক সংখ্যক কম। বাতাসে কী নির্মল সুগন্ধ! নিজেদের মধ্যে, সঠিক শারীরিক-দুরত্ব, বজায় রাখছে প্রায় সকলেই। এঁদের মধ্যে, এমন মানুষও আছে, যাদের আমি কখনও দেখিইনি। আনটিল নাউ!
আরেকদিকে, আমেরিকার নানা অংশে বিপজ্জনক ভাবে বাড়ছে আক্রান্তের ও মৃতের পরিসংখ্যান। রোজ। নাগাড়ে।
পাশাপাশি, দেশের বিপুল ইকনমিক হ্যামারেজের পর, ৬.৬ লক্ষ মানুষ ইউ.এস জবলেস রোলে যুক্ত হয়। ১৬ লক্ষ, মার্কিন বেনিফিটসের জন্য ফাইলও করেছেন। ফেডারাল রিসার্ভ, একটি নতুন $২.৩ ট্রিলিয়ন ঋণও ঘোষণা করে। এর মধ্যে স্মল-বিজনেস, ভোক্তা এবং এই প্রথম, স্টেটস, মিউনিসিপালটিজ ও শহরও অন্তর্ভুক্ত।
ফেডারাল প্রজেকশন; আজ ওয়ার্নিং পাঠায়, যদি আমেরিকায় শেল্টার-ইন-প্লেস তিরিশ দিন পর তুলে দেওয়া হয়, তাহলে, আরও বাড়তে পারে এই মহামারি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, প্রায়ই অধৈর্য হয়ে পড়ছিলেন, মূলত দেশের ইকনমি পুনরায় শুরু করার জন্য। কিন্তু এখন, এই পরিস্থিতি সামাল দিতে, তিনি জানান, যে মেডিকাল এক্সপার্টস-দের কথা অনুসারেই তিনি সমস্ত ভবিষ্যত-সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রয়োজনে বিজনেস লিডারদের সঙ্গে, নতুন টাস্ক- ফোরস তৈরি করে, সমস্ত ব্যবসায়িক ভাবনা-চিন্তা করবেন।
প্রত্যেক স্টেটে, বিভিন্ন কল-কারখানা আইডেল পড়ে রয়েছে। ওয়ার্কাররা লকডাউনে। পোর্টে, মালপত্র দিনের পর দিন পাইল-আপ হয়ে চলেছে। আবার কোথাও, এম্পটি কনটেনার জাহাজ। ডেয়ারি ফার্মাররা দুধ ডাম্প করছে, অন্যদিকে গ্রসারিতে, টয়লেট পেপারের আকাল। করোনায় বিঘ্নিত হয়েছে বিভিন্ন গ্লোবাল চেন। দেখা দিতে শুরু করছে, যাবতীয় দৈনিক জিনিষপত্রের অভাব ও মূল্যবৃদ্ধি।
প্রযুক্তির জগতে, অ্যাপেল এবং গুগল, তাদের IOS এবং অ্যানড্রএডে, তৈরি করতে চলেছে, করোনা ভাইরাস ট্র্যাকিং-সিস্টেম।এই বছরের মিড-মে থেকেই, ইউজাররা, তাদের ব্লু-টুথ এনার্জি ট্রানসমিশানের মাধ্যমে, ডাটা এবং হেলথ অরগানাইজেশান থেকে অ্যাপ্রুভড অ্যাপস শেয়ার করতে পারবেন।
দিনের পর দিন এখানে বাড়ছে ভয়াবহ করোনার স্প্রেড। লকডাউনের শুরুতে, মানুষ যেই হতাশার টের পায়নি, আজ যেন তাই জাঁকিয়ে বসছে তাঁদের মাথায়। মানুষ অনুভব করছে, যে তাঁরা আর বিপদের মুখোমুখি নয়, দাঁড়িয়ে আছেন, একদম বিপদের মধ্যিখানে। সিলভার লাইনিং, জীবনের দুটি সবচাইতে নিষ্পাপ, সরল ও নির্মল সত্য। বাড়ির খুদেরা এবং আমাদের প্রকৃতি। জানলার পুরু কাঁচের এপারে দাঁড়ালে, ফিরে পাওয়া যায় সেই প্রকৃতিকে। যাকে আলিঙ্গন করতে শিখিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। আমরা পারিনি, তাঁর মূলমন্ত্রকে জীবনের অঙ্গীকার করতে। করলে, আজ সারা বিশ্বকে এই ভয়ংকর দুর্দিনের সম্মুখীন হতে হত না। পুনরায়, সেই নেচার, আমাদের অন্য রূপে ধরা দিয়েছে। বলে যেতে— ‘আমায় আগলে রাখো’।
বাতাসে পলিউটেন্ট পার্টিকেল PM 2.5, বাড়াতে পারে এই প্যানডেমিকের মৃত্যুর সংখ্যা। জানাচ্ছে, নিউ ইংলেন্ড জার্নাল ফর মেডিসিনের একটি স্টাডি। আমেরিকা, মুলত নিউইয়র্ক শহরের আকাশে, বিগত কয়েক সপ্তাহে আকস্মিক ভাবে কমেছে NO2- র পরিমান। ফিনল্যান্ডের সেন্টার ফর রিসার্চ ও এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন অ্যায়ারের লিড অ্যানালিষ্ট Lauri Myllyvirta জানাচ্ছেন, দূষণের পরিমান কমাতে, পরিবেশে ফসিল, ফুয়েলের ব্যবহারের হার অনেক অংশে কম করতে হবে। এই বোধ, আমাদের নিজেদের আন্তরিক যাপনে গ্রহণ করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে। উদাহরণ স্বরূপ ; প্লাষ্টিক বর্জন, গ্যাসলিনের পরিমান কমানো, প্ল্যানটিং, পেপারের ব্যবহার কমানো, রিসাইকেলিং।
অন্য আরেক সত্য, বাড়ির ছোটরা। ঘরে ঘরে, তারা নিজেদের হোম স্কুলিং, আর্ট অ্যান্ড ক্রাফটস, ফ্যামিলি গেমস, নৃত্য, সঙ্গীত, রিডিং, কুকিং সহ নানা বিষয়ে, প্রডাকটিভ ভাবে নিজেদের ব্যাস্ত রাখছে। যা সত্যিই প্রশংসনীয়ও! এই টেক - স্যাভি প্রজন্ম, নতুন ভাবে শিখছে প্রকৃতির রঙ। মন খারাপ হলে, আছে বন্ধুদের সঙ্গে জুম ভিডিও চ্যাট। সময় মেপে, রুটিন ধরে চলছে, এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার জীবন। গড়ে উঠছে সহমর্মিতা। যা তাদের আগামী জীবনের সাফল্যের সব চাইতে বড় সোপান। আমরা শিখছি, ওদের অ্যাড্যাপটেবিলিটি। ‘তেতুল পাতায় ন’জন’— এই কনসেপ্ট, দুর্ভাগ্যবশত, ওদের বঝাতে হল, এক ভয়াবহ প্যানডেমিকের দ্বারা। এখন হাওয়া দিলে ওরা পাতার মর্মর শোনে। এপ্রিল-রেনস ছোঁয় নিজের করতলে।গাছের বাঁকলে আদর জমিয়ে রাখে। লাল, সাদা, গোলাপি ফুলে, ‘রূপ সাগরের পারের পানে’ ও যেন তাদের উদাসী মন ধায়! ওদের স্বপ্ন রয়েছে 'আকাশ চাওয়া মুগ্ধ চোখে’! বিশ্বময় করোনা মুক্ত হোক, ওদের নির্মল শুদ্ধিকরণে।

Post a Comment

0 Comments