মোবাইল খুলে ক্লাস করছি
শ্রীলা বসু
ক্লাস থেকে বেরিয়ে আপন মনে গজর গজর করতে করতে এসে ঠক করে অ্যাটেনডেন্স রেজিস্টারটা টেবিলে রাখলাম। ছেলে মেয়েগুলো ক্রমশ যেন নিরেট হয়ে যাচ্ছে। কোনও প্রশ্ন নেই, কোনও কথা নেই মুখে। সকলে একরকম ভাবলেশহীন মুখ করে এমন চেয়ে থাকে— ইত্যাদি। সহকর্মীরাও চা খেতে খেতে সম্মত হন। ‘এর চেয়ে মনে হয় ফাঁকা ঘরে ক্লাস নিই, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে’— গরম চায়ে জিভ পুড়িয়ে ফেলে বলতে থাকি।
এসব কথা যখন হচ্ছিল তখন বোধহয় বিধাতা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে বিভাগের মাঠে পায়চারি করছিলেন। শুনে টুনে বললেন, ‘বেশ। তাই কর ব্যাটা। তথাস্তু।’
ফলত লকডাউন।
এক মাসের বেশি হয়ে গেল বেশির ভাগ দিন গেটের তালা খোলা হয় না। সকালে চোখ খোলার আগেই ভাবি কি রান্না হবে। আজ দোতলা না মুছলেই নয়। এঁটো বাসনের স্তুপ। আবার অজিতকুমার চক্রবর্তীর রবীন্দ্রসমালোচনা আজ শেষ করবার কথা। এম এ রবীন্দ্রনাথ স্পেশাল পেপারের সিলেবাস বড়ো কম নয়। বইপত্তর বিভাগের ঘরে আটক। পি ডি এফ ডাউনলোড করে কার্যোদ্ধার হচ্ছে। একটু বেলা হলে চা প্রাতরাশ কুটনো কোটা সারা হলে মানবীবিদ্যার ক্লাস রেকর্ড করতে বসি। অনেক ছেলেমেয়ের গ্রামে নেটওয়ার্ক নেই ভাল। তাই জুমে ক্লাস নিলে সে বেচারারা বঞ্চিত হবে। অতএব হোয়াটসঅ্যাপে ক্লাস। খাটের উপর বইপত্র ছড়িয়ে বসি। সামনে মোবাইল। খাটের অন্যদিকে গুটিসুটি মেরে বেলা অবধি ঘুমিয়ে চলেছেন পরিবারে কনিষ্ঠটি। ঘুম থেকে উঠলে তিনি অ্যাকোয়াগার্ড থেকে জল ভরবেন, একটু ঝাঁট পাট দেবেন। আপাতত স্কুল নেই, অনলাইন ক্লাস দুপুরে বিকেলে। তাই তিনি প্যাঁচা হয়ে গেছেন। নিচের ঘরে বাড়ির কর্তা বাথরুম সাফ করতে করতে গান গাইছেন— ‘আমার এ ঘর বহু যতন করে, ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।’ গাইতে গাইতে আপন মনে বলে চলেছেন ‘এখন কেউ বনে যায়নি। সবাই গৃহবন্দি।’
ক্লাসে বসেছি। সামনে দুষ্টু ছেলেমেয়েগুলোর হাসিমুখ নেই। অকারণ হি হি, অকারণ ছাতারে পাখির মতো ক্যাচর ম্যাচর নেই। কারও চশমা বিজড়িত সিরিয়াস চোখ, কারও চোখে ফাঁকিবাজির স্পষ্ট চিহ্ন নেই। মোবাইল খুলে ক্লাসে বকে চলেছি। স্বর্ণকুমারীর বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ পড়াতে পড়াতে ভাবি আজ মাছটা সর্ষে বাটা দিয়ে হবে নাকি হলুদ কালো-জিরে। ক্লাসে যেসব মুখগুলোকে দেখলেই বকুনি দিই তারা সব জলছবির মতো আসা যাওয়া করে। মন কেমন করে ওদের জন্য। স্বর্ণকুমারী এদিকে বুঝিয়ে চলেছেন শারীরিক গঠনের কারণে কোনওমতেই না, পরিবেশ আর সুযোগের অভাবেই মেয়েদের আজ এই অবস্থা। এ নিয়ে ছোট ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর কতো বিবাদ। কিছু লেখা পাঠিয়ে দেব ছেলে মেয়েদের। এ বছর কেউ আমার বই নিয়ে যত্ন করে মলাট দিয়ে ফেরত দেবে না। কেউ বলবে না ‘দিদি সিলেবাস শেষ হল, আজ খাওয়ান আমাদের।’ ওদের উৎপাতহীন একটি মাস কেটে গেল!
সকালে উঠেই মেসেজ পেয়েছি— ‘দিদি। আর কতোদিন।’ কে দেবে উত্তর।
বিকেলে বারান্দায় বসি। ছেলে চা করে দেয়। চাঁপা নিম আর শিরীষ তিনদিক থেকে তিনজনে ত্র্যহস্পর্শর মতো ধেয়ে আসে তাদের গন্ধ নিয়ে। হায় রে। একটি বই নাক মোর নাই রে। প্রকৃতির দিকে তাকাবার একটু সময় হয়েছে এবছর। অ্যাডানিয়াম ফুলে ফুলে ভরা। ছেলে বলে, ‘মা দেখো, বাগানে পাতাবাদাম উড়ে এসেছে। এবার তাহলে স্কুল খুলবে কি বলো।’
8 Comments
বাহ্, চমৎকার লাগলো।
ReplyDeleteThank you
Deleteসুন্দর লাগলো।
ReplyDeleteThank you
Deleteখুব ভালো লাগলো দিদি আপনার লেখা পড়ে।অনেক দিন পর।
ReplyDeleteভালো লাগল দিদি...
ReplyDeleteদিদি,কি সুন্দর ঝরঝর মনের কথা ।আমার তো ক্লাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
ReplyDeleteBisakha Roy
ReplyDeleteবাহ্।বেশ লাগল।