লকডাউনের দিনলিপি

করোনাক্রান্তিকালের ঘর

রাজীব নন্দী (বাংলাদেশ থেকে)


‘ঘরকে ভালোবেসেই দেখো না, স্বর্গ নেমে আসবে’। করোনা হানা দেওয়ার আগে একজন চুপে চুপে বলেছিল আমায়। অনুরোধের নড়বড়ে মুহূর্তের অব্যর্থ উক্তিটির রেশ না ফুরাতেই করোনাক্রান্তির ঘরবন্দি জীবন শুরু হল! ঘর, বড়ই ঘোর লাগা একটি শব্দ। করোনাক্রান্তিতে পৃথিবীর সবাই যার যার ঘরকে আপন ভেবে  আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা চট্টগ্রামের মুরাদপুরের একটি ঘরে বসে লিখছি এই লেখা। করোনাক্রান্ত কোনও কোনও গৃহবন্দি পাঠক হয়তো পড়ছেন এই লেখা। আমার চারিদিকে নিস্তব্ধতা। অদ্ভুত ভয়াল এক নগরী। নগরীই শুধু নয়। পুরো দেশ। দেশ ছাড়িয়ে মহাবিশ্ব। রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ কিরি, যিনি গেয়েছেন, ‘জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে’। সত্যিই আজ জীবন-মরণের সীমান্তের ইমিগ্রেশন অফিসার সিল হাতে নিয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে। আর আমরা প্রত্যেকেই যেন, সীমান্তে লাইন ধরে দাঁড়ানো উদ্বিগ্ন পরীযায়ী। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডার ত্রাতারা দুয়ারে খিল এঁটে ঘুমুচ্ছেন। মেডিকেলের জরুরি বিভাগের ডাক্তারকে গিয়ে বলছি, ‘অবনী জেগে আছো’?
ল্যাটিন আমেরিকার বিখ্যাত উপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ লিখেছেন, ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’। উপন্যাসটি পড়ে কিংবা এই নামে সিনেমাটি দেখে তীব্র টানাপড়েনে ভোগেননি এমন সাহিত্য সমঝদার বিরল। বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র লিখেছেন ‘পথের দাবি’। ভারতীর সঙ্গে অপূর্বের প্রেম হয়, টানাপড়েন হয় যখন বার্মায় ছড়িয়ে পড়ছে ভয়াবহ প্লেগ। এই করোনার সময়েও কোথাও প্রেম ভাঙছে, অনলাইনে কারও প্রেম গড়ায়, কেউ টানাপড়েনে কাটায় সঙ্গনিরোধ সময়। সবাই কম বেশি নিঃসঙ্গ। নিকট ঘনিষ্টরা দেয়ালবন্দি থেকেও নিঃসঙ্গ যেন। পাশের রুমের বাবার সঙ্গে কথা নেই কন্যার। বিছানায় দুপাশে মুখ করে অনলাইনে ভিন্ন দুটি জগতে বাস কারও কারও। কেউ আড্ডাকে খুঁজে নিয়েছে ভার্চুয়াল গ্রুপ-চ্যাটে। সবাই যখন ঘরকেই আপন ঠিকানা ভেবেছে, সেসময় কেউ হয়তো দীর্ঘদিনের শরীর-রক্ত-আবেগ মাখানো ঘর, পরিচিত পাড়া বদল করছে। কেউ কেউ রসিকথা করে ফেসবুকে লিখছে, ‘বাইরে আর্মি, ঘরে বউ; কোথাও শান্তি নাই’। হ্যাঁ, ‘ঘর’! করোনা আমাদেরকে চিনিয়ে দিল নতুন করে ঘর কী?
‘ঘরে অনেক সুখ আছে, বাইরে আছে শান্তি’। এক বন্ধুকে বলেছিলাম। শুনে অবাক হয়েছিল সে। বলল, তুমিও দেখি আমার মতো ডানাওয়ালা পাখি। করোনাক্রান্তির গৃহবন্দীত্ব জীবনে ফেসবুকে তাকে শেয়ার করি কবি ময়ুখ চৌধুরীর কবিতা, ‘বোতামেরও ঘর থাকে/আমার তো হলো না কিছুই’। আসলেই তো! ঘর কী? ঘর হলো খাঁচা, যা ‘ভালবাসা’ নামক অদৃশ্য সুতায় বোনা। যেখানে আমরা স্বেচ্ছায় বন্দি হতে চাই। আবার কারও কারও জন্য ঘর হল কেবল জিনিসপত্র রাখার জন্য, যারা গৃহত্যাগী, যারা ব্যক্তিগত সম্পত্তিজাত মানসিকতার ঊর্ধ্বে বসবাস করেন। তারা ভাবেন বেড়ানোর জন্য পুরো দুনিয়া। বাকিরা আমরা ঘর বানাই, ঘর ভাঙিও আমরা, কারও কারও ঘর বদল হয়। আমরা অনেক সময় ভুলে যাই, আমাদের মনের ‘ঘরে বসত করে কয়জনা’?
ঘরের ঘোর বড় অদ্ভুত! একসময় চিরতরে ঘর ছাড়বে বলে কেউ ঘরে বসেই স্বপ্নজাল বোনে। আজ এই করোনাক্রান্তিতে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করে আমরা বলছি, ‘আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে, ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে।’ কারণ, ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছে অদৃশ্য ভাইরাস। তবে বঙ্গদেশে দেরিতে করোনা এলেও, এটা সাপে বর। আমাদের সামনে ইটালি, স্পেন, ফ্রান্স, আমেরিকা ও সর্বোপরি চিনের অভিজ্ঞতা আছে। উন্নত দেশগুলো সে সুযোগ পায়নি। এখনও সময় আছে, আর কটা দিন স্বেচ্ছানির্বাসনে কাটালেই করোনা আগুনের ফুলকি থেকে মহামারীর এই দাবানল রোধ করতে পারি আমরা। এ এক আজব রোগ, যাকে চোখে দেখা যায় না। অদৃশ্য শত্রু নিজের অজান্তে জড়িয়ে ধরবে আপনাকে। আবার এর সমাধান আরো অদ্ভুত! কেবল হাত ধুয়ে ঘরে বসে থাকো। অবাক হলেও সত্যি সভ্যতার ইতিহাসে এটাই প্রথম কোন যুদ্ধ, প্রত্যেকটা দেশ যার যার মিত্রপক্ষ! কিন্তু প্রত্যেক মানুষ প্রত্যেকের প্রতিদ্বনন্দ্বী। রোগতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, যোগাযোগবিদ্যা আর চিকিৎসাশাস্ত্রের সকল সমীকরণ উল্টে দিয়ে নয়া রোগের বিশ্বায়ন জারি হয়েছে পৃথিবীতে। এই অভিনব যুদ্ধের আঁচ পড়েছে সমাজের সবকিছুতেই। এ এমন এক রোগ, যেখানে অজানা শত্রুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ না দিয়ে বরং একটু পিছু হটে যাওয়াই কৌশল। আমার কাছে এই ‘লকডাউন’ মহাভারতের অর্জুনের অজ্ঞাতবাস। অরণ্যে লুকিয়ে প্রাণশক্তি সঞ্চয় করাটাই যখন একমাত্র কৌশল।

Post a Comment

0 Comments