লকডাউনের দিনলিপি

চারিদিকে পৃথিবীর কৃষ্ণপক্ষ

প্রিয়দর্শী চক্রবর্তী 


ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণ-রেখা’-য় এক দৃশ্যে সন্ধের পানশালায় চরম মদ্যপানে সম্বিৎ খুইয়ে শহর কলকাতার রাজপথে ট্যাক্সির ঝাঁকুনিতে আধো আধো চেতনায় জর্জরিত হরপ্রসাদ (চরিত্রায়নে বিজন ভট্টাচার্য) বন্ধু ঈশ্বরের (অভি ভট্টাচার্য) উদ্দেশ্যে নবপ্রজন্মের প্রতি অনুকম্পায় প্রায় বাণীর মতো আওড়ে যাচ্ছেন কিছু সংলাপ-কিছু প্রলাপ—‘এরা... যুদ্ধ দ্যাখে নাই, মন্বন্তর দ্যাখে নাই, দাঙ্গা দ্যাখে নাই, দেশভাগ দ্যাখে নাই...!’ মগজের পরিণত বৃদ্ধি হয়ে ওঠা ইস্তক এই শ্লেষাত্মক উক্তি তীব্রতায় বিঁধেছে অন্তরাত্মা, যতবার ঘুরেফিরে দেখেছি সিনেমাটা। বরং রাখঢাক না রেখে স্বীকার করে নেওয়াই শ্রেয়, অগ্রজ প্রজন্মের প্রতি অদ্ভুত এক জাতীয় ঈর্ষায় হাবুডুবু খেয়েছি। বাস্তবিকই বয়সে বাবাকাকাজ্যাঠাদের সঙ্গে বেশ কয়েক দশকের ফারাকে চাক্ষুষ অভিজ্ঞতাতেও থেকে গেছে বিষম আকাশপাতাল পার্থক্য। সাম্রাজ্যবাদ-বিশ্বযুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ-দাঙ্গা-দেশভাগ-খাদ্য আন্দোলন-জরুরি অবস্থা, প্রাতিষ্ঠানিক কায়েমি স্বার্থের বিরোধীতায় অতি বামপন্থার বিসর্জিত যৌবন—দৃশ্যত সেরিব্রায় যাবতীয় এই ইতিহাসের ভার বয়ে বেড়ানো মানুষগুলোর বিপ্রতীপে জন্মাবধি নিজের বেড়ে ওঠার সমসময়ের ময়নাতদন্তে এতাবৎ জীবন-দৈনন্দিনের শুধুই আপাত নিস্তরঙ্গ পটচিত্র! কেবলমাত্র ঈর্ষাই নয়, শূন্যগর্ভ এই অস্তিত্বে যেন নিজেকেই খাটো করে নেওয়া তাঁদের অর্জিত প্রান্তরের মাপে।
তবে এমনতরো হীনমন্যতায় অবশেষে বুঝি বা খানিক প্রলেপ পড়ল। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের প্রথমভাগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে সম্ভাব্য জাপানি আক্রমণের আতঙ্কে, অথবা বাষট্টি-র ভারত-চিন কিম্বা পঁয়ষট্টি-র ভারত-পাকিস্তান সমর-পরিস্থিতিতে শুনেছি ‘ব্ল্যাক-আউট’-এর গল্প। গোটা শহর শুনশান অন্ধকার। কালো ঠুলি পরানো স্ট্রিট লাইটের বাল্বে। জড়সড় মানুষজন বাতি নিভিয়ে ঘরের কোণে প্রকম্পিত। অদেখা অজানা সেই আতঙ্কের রোম্যান্টিসিজমে ডুবেছি এতকাল একান্তই মানস প্রতিস্থাপনে। অথচ কী যে এক সময়ের ফের উড়ে এসে জুড়ে বসল এ-বছরের গত মার্চ মাসের মাঝামাঝি থেকে, হয়তো আকস্মিক নয়, তবে অনভিপ্রেত তো বটেই আমাদের এই গড়পড়তা সচল জীবনযাত্রার তুল্যমূল্যে। এশিয়ার পুবদিক থেকেই উদিত হয়ে জাতেচরিত্রে একেবারেই অভিনব এক ভাইরাস তার সংক্রমণের গ্রাসে গিলে ফেলল প্রায় গোটা বিশ্ব! বোমাবন্দুক-গোলাগুলির মুখর সন্ত্রাস নয়, নীরব অনুপ্রবেশে ফালাফালা ছিঁড়ে ফেলা বিজ্ঞাননির্ভর সভ্যতার আত্মবিশ্বাসের আচ্ছাদন! আতঙ্কে নাগরিক সমাজের স্বেচ্ছা গৃহবন্দিদশারও নিশ্চিতই অভিনব রূপ—অলিগলি রাজপথে আলো নেভানোর দায় নেই, নেই শত্রুর চোখে ধুলো দিতে কপাটবন্ধ অন্ধকার ঘরে গুটিয়ে থাকার বাধ্যতা। আসলে যে শত্রু দৃষ্টিভাগেরও অতীত, তাকে ঠকিয়ে খোলসে লুকিয়ে থাকার প্রয়াসও ততোধিক অর্থহীন। অতএব জৈবশত্রুকে জব্দ করতে ‘ব্ল্যাক-আউট’-এর সেই অনাস্বাদিত অভিজ্ঞতা আজ পর্যবসিত ‘লক-আউট’-এর একঘেয়েমির বিস্বাদে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের এবং রাষ্ট্রের নিদানে অন্যতম শর্ত একটাই—‘সামাজিক বিচ্ছিন্নতা’ বজায় রাখতে হবে। যদিও এই শব্দের ব্যবহারেও সামান্য বিভ্রান্তির সম্ভাবনা থেকেই যায়, ‘শারীরিক’ আর ‘সামাজিক’ সমার্থক কি না, সেই প্রতর্কে। সে যাই হোক, করোনার বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে আমরা আজ তাই কাজকর্মভ্রমণবিচরণআড্ডাবিলাস শিকেয় তুলে নিজের নিজের চিলতে ঘেরাটোপে জগৎসংসার থেকে স্বেচ্ছা-নির্বাসিত! এমনতরো মেঘাচ্ছন্ন অবেলা নিশ্চিতই অভূতপূর্ব, অন্তত পূর্বজদের যাবতীয় চাক্ষুষ সংকটকালের নিরিখেও। সুতরাং চেতনায় জিইয়ে থাকা সেই ঈর্ষার উপশমে আপাতত এক জায়গায় হিসেব বরাবর। একেবারে অঙ্গাঙ্গী উপলব্ধিতে চিনেবুঝে নেওয়া সভ্যতার সংকটের অপরিচিত রূপ। বলার মতো কিছু অর্জন করে নেওয়া উত্তরকালের প্রেক্ষিতে, যদি এই বিপদগ্রস্ত সময় টপকে বেঁচেবর্তে থেকে যেতে পারি। বরাভয়ের দৃষ্টান্তও ইতিহাসেই পেয়ে যাই। প্রাচীন এথেন্সের প্লেগ মড়ক অতিক্রমে উত্তরজীবী হয়ে নিজ অভিজ্ঞতায় শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্বে ব্রতী মহান থুকিডিডিসের মধ্যে। জানি, মহান-রা অগণিত জন্মান না। কিন্তু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে মানুষের ঢেউ অব্যাহত থাকে। থেকে যায় গ্রন্থিবদ্ধ সময়ের সন্ধিস্থানের অজেয় কিছু বার্তা। সেটুকুই নিধিরাম সর্দারের সম্বল ঢালতরোয়ালহীন এই আপাত দিশাহীন কুরুক্ষেত্রে। অন্তত এতাবৎ কাল্পনিক উপলব্ধিতে মুখস্থ আওড়ে যাওয়া কবিতাটা একবারের জন্য প্রত্যক্ষ বোধসঞ্জাত উচ্চারণে স্পষ্ট করে তুলতেই পারি নিজের চেতনায়— 
... মহা আশঙ্কা জপিছে মৌন মন্তরে,
দিক্‌-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা —
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।।...
যাই হোক, ব্যক্তিগত অনুভবের দার্শনিকসুলভ কপচানি ছেড়ে আপাতত নিজের দৈনন্দিন স্থবিরতায় দু-চার কথা গুঁজে ইতি টানি। জীবন-জীবিকার বাধ্যতায় প্রায় সারা বছরই তিন প্রান্তে আমার নাড়া বাঁধা। রুজিরোজগারের সূত্রে আসানসোল, আর ঘরসংসারের নির্বন্ধে কলকাতা-শান্তিনিকেতনে। আপাতত আইসোলেশনের ঘাঁটি কলকাতার শহরতলীতে তিন কামরার সীমাবদ্ধ ফ্ল্যাট, যেখানে ব্যালকনি নামক বস্তুটির আরামও হাত পাঁচেক দূরত্বে ইট-কংক্রিটের দুর্ভেদ্য পাঁচিলে ধাক্কা খায়। অতএব গত এক মাসের ওপর ঘরের চারদেওয়ালের চৌহদ্দিতেই বৈচিত্র্যবর্জিত অন্বেষণ—মানসিকভাবে সুস্থ রাখার দায়ে কাজকর্ম খুঁজে খুঁজে নিজেকে ডুবিয়ে রাখা। গ্রন্থপাঠ, গান শোনা, আন্তর্জালে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার উপকরণ জোগানোর অনভ্যস্ত উদ্যোগ, পাশাপাশি নিরন্তর যুঝে চলা খবরের ঘাড়ে গুজব আর গুজবের মাথায় জমিয়ে থিতু হওয়া আতঙ্কের সঙ্গে। যেহেতু আজন্ম এমন পরিস্থিতির মোকাবিলায় কোনোদিনই তেমন প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়েনি, বছরভর বাঁধাধরা নিয়মগুলোও যখন এই পর্যায়ে এসে থমকে যাচ্ছে, মানসিক জাড্যে হয়তো জড়িয়ে যাচ্ছে মুহূর্তগুলো আরও। নববর্ষ ১৪২৭ নীরবে সরে গেল। কলেজস্ট্রিটে দু-তিনজন প্রকাশকের দপ্তরে হাজিরার প্রায় চল্লিশ বছরের অভ্যাসে ব্যতিক্রমটুকুও ঘটেই গেল তবে! সামনেই বৈশাখী কবিপক্ষ। জোড়সাঁকো বা রবীন্দ্রসদনে প্রভাতী জমায়েতে উপস্থিতির আগ্রহ এহেন পরিস্থিতিতে নেহাতই বাতুলতা। আবারও অভ্যাসে ব্যত্যয়। আগামী শারদোৎসবের আকাশেও যেন মেঘের ভ্রুকুটির আগাম শঙ্কা। টুকটাক এভাবেই অভিনব পরিপার্শ্বের স্বাদ, চাখতে তা যতই তিতকুটে লাগুক না কেন!
বাধ্যত বরণ করে নেওয়া এই বিশ্রামেও জমছে অনন্ত ক্লান্তি। সময়ের রকমফেরে ঘুম ভুলতে বসেছে রাত। মোবাইলের স্ক্রিনে ঘুরে বেড়ানোতেও ক্লান্ত আঙুল। মগজ নিস্তার চায় অপ্রাপ্তির দুনিয়ায়, একদিন যা ছিল নিতান্তই মুঠোর নাগালে। জানলায় দৃষ্টিগোচর জনমানবহীন রাস্তার নির্জন একাকীত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে চোখ খুঁজে বেড়ায় শহরের মাথায় ভুবনডাঙার ব্যাপ্ত আকাশ। হিমালয়সম সৃষ্টির পাদদেশে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র তৃণসম অস্তিত্বের নতজানু স্বগতোক্তিতে বিড়বিড়িয়ে ওঠায় বুঝি বা মননেরই সঞ্জীবন—
তারা-ফুটফুটে অন্ধকার
চারিদিকে পৃথিবীর কৃষ্ণপক্ষ
অতীত ও বর্তমান, স্মৃতি ও আকাঙ্ক্ষা এক বোঁটায়...
......
আদিম তরঙ্গের ভবিতব্য সামনে দোলে...
বালি চিকচিক করে শতাব্দীর সমুদ্র-কিনারে, ভ্রান্তির কাল...                                                                         (সিদ্ধেশ্বর সেন) 

Post a Comment

0 Comments