লকডাউনের দিনলিপি

এক নতুন পৃথিবী

লাবণী রায় চক্রবর্তী


লকডাউন?
খুব হাসির কথা হবে হয়তো... এর মানেই জানতাম না কয়েকটা দিন আগে! প্রথম যেদিন ঘোষণা হল জনতা কারফিউ, একদিনের ওই ‘চলো নিয়ম মতে’— বিষয়টাকে ঠিক ঠাহর করতে দেয়নি।
তার সঙ্গে সঙ্গত দিয়েছিল বিকেল পাঁচটার সেই অভিনন্দন-বাজনা-বাদন। বেশ মজাই পেয়েছিলাম। ২০ মার্চ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে ফেলেছি বলে খুব স্বাভাবিকভাবেই এর পরের সময়টা আমার নিজের মতো করেই আরাম করে কাটত, অর্থাৎ সোজা ভাষায় নিজের জগতে বই, গান, লেখালেখি, পাহাড় প্রমাণ ভাবনা আর... অবশ্যই মুঠোফোন নিয়ে আমি বাড়িতেই কাটাতাম। দাদা আর আমি দুজনেই বাইরে হস্টেলে থাকার সুবাদে বহুদিন বাবা মায়ের সঙ্গে সবাই মিলে সময় কাটানো হয়নি তাও করার পরিকল্পনা করেছিলাম। সবই চলছিল প্ল্যান মতো। গত তেইশে মার্চ তারিখের যে ঘোষণায় একুশ দিন মানুষকে ঘরে থাকার কথা বলা হয়েছিল তাতে পারতপক্ষে আমার একটা ক্ষতিই প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছিল যে আমার জন্মদিন যেটায় বন্ধুদের নিয়ে ন্যুনতম হই হুল্লোড় করে কাটাতাম সেই পাকা ধানটায় ব্যাটারা এসে মই দিয়ে দিল। হা হা হা— ছোট মাথার ছোট বুদ্ধি।
আমি দেওঘর সৎসঙ্গ আশ্রমের নিবাসী। জন্ম থেকে এমন দিনের কথা মনে পড়ে না যেদিন আশ্রম চত্বর খালি দেখেছি। গত ২৪শে মার্চ সন্ধেবেলায় দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই হঠাৎ এক সজীব প্রাণহীনতা আমায় চেপে ধরল। যতদূর চোখ যায়— দেখলাম শূন্য শুধুই শূন্য। এর আগে কোনওদিন এমনটা হয়নি। খুব মন খারাপ হল। ফেলে আসা কয়েকদিনের ‘করোনা -কড়চা’, তার সমীক্ষা, তার তাণ্ডব কোনওটাই আমায় খুব ছুঁতে পারেনি। কিন্তু আমার আশ্রমের এই রূপ আমায় আরও ২১ দিন টানা সহ্য করতে হবে এই কথা ভাবতেই কেমন ভাবনাশূন্য হয়ে পড়লাম। এরপরের যে কথাগুলো বলব সে গুলো হয়তো সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমরা সকলেই হয়তো রোজকার একঘেয়ে জীবন ও তার যাপন থেকে গোচরে-অগোচরে কখনও একটা বিশ্রাম চেয়েছিলাম। হ্যাঁ এটা ঠিক যে এভাবে বন্দি হয়ে নয়। ছকে ফেলা যাত্রাটাকে ছকের বাইরে দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এ তো পুনরায় ছক বন্দি হয়ে গেলাম। অনেকেরই এই কথাটা মনে হচ্ছে। কিন্তু এভাবেও তো ভাবা যায়--
আমরা সকলেই কয়েকটা দিন আগে অবধি কিছুটা তাসের দেশের সাহেব, টেক্কা, গোলাম, দুরি-তিরির মতো ছিলাম। ‘চমৎকার শৃঙ্খলা’, ‘নিয়মে চলাফেরা, যাওয়া- আসা, ওঠা পড়া’ এই সব সমেত একজন যা করছে আর এক জনকেও যেন সেটা করাচ্ছে বা করাতে বাধ্য করছে। দেশজুড়ে তোলপাড় করা ইঁদুরদৌড়, শান দেওয়া ছুরির ফলার মতো নৃশংসতা আর বলা-ই বাহুল্য গরিব দেশের হতবুদ্ধিতা এই কয়েক হপ্তা আগে অবধিও খবরের কাগজের শিরোনাম হবার জন্য লাইন দিত। কিন্তু আজ? যে মানুষ নিজের পাশের মানুষটাকেই বাহ্যিক রূপ দেখে তাকে আর মানুষ তকমাটাও দিতে পিছু পা হয় সেই-ই আজ ভয়ে সবকিছু থেকে এক নিমেষে অবসর নিল! এ এক নতুন পৃথিবী! মানুষের পৃথিবী— মান ও হুঁস আছে যার!

Post a Comment

0 Comments