রবিবার

কবিতায়, গদ্যের মেধাবী আহ্বান

সুমন গুণ


রঁদ্যা সম্পর্কে রিলকের সেই বিস্ময় ভারাতুর কথা আছে না যে, এই ঐশ্বর্যময় শিল্পী নিজের ভেতরেই সংরক্ষণ করছেন অন্ধকার আর নীলিমা, নিজেই তিনি এক অরণ্য, যার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে মুগ্ধ জলধারা! অলোকদার পাশে বসে আমার কথাটা মনে পড়ে।
বাংলা ভাষায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত যে মেধাবী শৌর্য ও লাবণ্য সঞ্চার করেছেন, সেটা আমরা কম বেশি জানি। এমন শিল্পী তো খুব বেশি পাইনি আমরা বাংলা গদ্যে, যাঁর ভাষা তাঁর বক্তব্যের প্রচ্ছদ হয়ে উঠতে পারে। পাণ্ডিত্য অনেকেরই থাকে, তার ভার অনেককে নুইয়ে দেয়, কেউ কেউ অক্লেশে সেই ভার উহ্য রাখতে পারেন, আবার কেউ বিদ্যাচর্চাকেএমন ভাবে স্বগত করে রাখেন লেখায় যে তা নিঃশব্দে আমাদের সংক্রামিত করে। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত তাঁর প্রবল আন্তর্জাতিক আহরণ লেখার মধ্যে, সে লেখা গদ্যই হোক বা কবিতা, অবধারিতভাবে উহ্য রেখেও উদ্যত রাখতে পারেন।
এটা তাঁর, একমাত্র তার একটি বিশেষ ঘরানা। কিন্তু শুধু লেখা নয়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের সান্নিধ্যও যে কতটা সৃজনশীল সেটা তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা জানেন। এমন বিপজ্জনকভাবে প্রাণবন্ত থাকেন তিনি সবসময় যে নাগাল পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে প্রায়ই। বিপজ্জনক শব্দটা কেন বললাম জানতে চাইতে পারেন।
এটা বোঝানো মুশকিল। আমি অভিজ্ঞতায় বুঝেছি। উনি আমার পদবীকে বিপরীতার্থ করে উচ্চারণ করেছিলেন একবার আমার বন্ধুদের কাছে। ব্যস, বন্ধুরা বন্ধুকৃত্য করার সুযোগ ছাড়বেন কেন। তাঁরা যথারীতি নিজের কীর্তি বলে তা প্রচার করতে শুরু করলেন। আমি অলোকদার কাছে তারপর আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ জানালে তিনি দ্রুত তা প্রত্যাহার করে নিলেন।
অলোকরঞ্জনদাশগুপ্তর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় নব্বই দশকের গোড়ার দিকে। আমার এক তরুণ কবিবন্ধুর সঙ্গে এক রবিবারের সকালে গিয়েছিলাম তাঁর যাদবপুরের বাড়িতে। ‘প্রমা’ সম্পাদক সুরজিৎ ঘোষের সঙ্গে অলোকদার খুব ভাল সখ্য ছিল। সুরজিৎদা সেই বছর আমার একটি কবিতার বই বের করেছিলেন। ‘সোমবার, আত্মীয়স্বজন’ নাম ছিল বইটির। বাড়িতে গিয়ে দেখলাম সুরজিৎদাও বসে আছেন, ফলে আমার সঙ্গে অলোকদার পরিচয় স্বচ্ছন্দেই হয়েছিল সেদিন।
তারপর থেকে তাঁর সঙ্গে আমার নানা সূত্রে যোগাযোগ রয়েছে। এমন গুণী অথচ প্রসন্ন মানুষ, প্রাজ্ঞ অথচ উদার ব্যক্তিত্বের সঙ্গ যে কতভাবে পেয়ে কৃতার্থ হয়েছি। একটা ব্যাপার,উনি দেশের বাইরে বেশিরভাগ সময় থাকলেও বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর স্বাভাবিক ও নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক কিন্তু টোল খায়নি।
যে কেউ যে কোনও ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ ও সহযোগিতা পেতে পারে। এখনও ইমেইল গ্রহণ না করলেও ফোন আর ফ্যাক্সে যেভাবে সাড়া দেন তিনি, আমাদের বিস্ময় আর কৃতজ্ঞতার সীমা থাকে না। অলোকদাকে আমি একবার গুরুতর ব্যাপারে সক্রিয় পরামর্শদাতা হিসেবে পেয়েছিলাম। ২০০৯ সালে আমি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয় যখন তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ শুরু করি, অলোকদাকে অনুরোধ করেছিলাম বিভাগের পাঠক্রম তৈরি করে দিতে। আমার প্রতি স্নেহ বা তুলনামূলক সাহিত্য বিষয়ের প্রতি মমতা, যে কারণেই হোক সাগ্রহে রাজি হলেন।
মনে আছে পরপর কয়েকদিন প্রায় ভোরবেলায় আমরা বসতাম। আমি শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও উত্তেজনা নিয়ে অলোকদারসামনে নতজানু হয়ে থাকতাম।
অলোকদার কবিতা নিয়ে এত কথা হয়, কিন্তু তাঁর যে একটি গল্পের বইও আছে, সে বইয়ে যে আছে অনতিক্রম্য কিছু গল্প, সে কথা অনেকেই জানেন না। বইটির নাম ‘ছয়ঋতু ছয়লাপ’ ।
প্রতিটি গল্পই রহস্য আর বিপ্রতীপতায় ভরা। একটা বয়ানের ভেতরে ঢুকে ছিন্নভিন্ন আরেকটা বয়ান।
বাংলা কথাসাহিত্যের দুটি মৌলিক গদ্য ঘরানা এতদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পরে বিভূতিভূষণ, মানিক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি ঘরানা, অন্য ঘরানাটি তুলনায় কম জনসেবক, যার ধারক জীবনানন্দ, কমলকুমার মজুমদার থেকে দেবেশ রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সহ আরও কয়েকজন।
অলোকরঞ্জনের তির্যক অথচ সংবেদী কবিতাভঙ্গির অনুরাগী পাঠকেরা তাঁর গল্পেও এক মরমী আহ্লাদ টের পাবেন। এমন নয় যে আখ্যানের বিন্যাস একেবারেই নেই তাঁর গল্পে, কিন্তু তা কখনওই সরাসরি আর একবগগা নয়।
কবিতার মতোই তিনি গল্পেরও অনেকগুলি স্তর রচনা করতে পারেন। এই স্তরান্তর শুধু বিষয়ের নয়, বর্ণনারও। খুব নিরীহ সূত্রপাত থেকে এগোতে এগোতে নির্বিকার পাঠক হঠাৎই বুঝে ফেলেন দিকভ্রান্ত হয়ে কি বিপথেই না তিনি ঢুকে পড়েছেন!
লেখকের সচেতন প্ররোচনার এই সূত্র ধরে ‘ছয়ঋতু ছয়লাপ’ -এর গল্পগুলিকে দুই ভাগে আলাদা করা যায়।
একদিকে আছে ‘শেখভ এবং সেই ভারতীয় মেয়েটি’ , ‘মহিষবাথান’ - এর মতো নির্দয় ভাবে নৈসর্গিক দুটি গল্প, অন্যদিকে ‘একটি গাছ এবং তিনটি চরিত্র’ ‘অরিন্দমের লেখার টেবিল’ ‘রুনকির সংসার’ আর ‘দ্বিতীয় প্রাতরাশ’, যে গল্পগুলোতে বিন্যাস আর বক্তব্যে পুরো ধরা না দিলেও একটু আধটু, এখানে ওখানে পা রাখার মতো সূত্র অনুগ্রহ করে রাখা হয়েছে।
প্রথম পর্বের একটি গল্প থেকে আমি শুধু তাৎক্ষণিক উদ্ধৃতি দিচ্ছি, গল্পগুলোকে ধরে দিতে অন্য কোন নিশ্চিন্ত পদ্ধতি না থাকায় : ‘‘মেয়েটি তার শরীরভরা ভারতবর্ষ মেলে দিল শেখভের পায়ের কাছে, মাথা নীচু করে বলল : ‘বলো, আর কী চাও’। দোভাষীটি সেই ভারতবর্ষে কনুই ছুঁইয়ে শেখভকে বলল, ‘ইনি জিজ্ঞেস করছেন আজ রাতে কখন কোথায় ওঁর সঙ্গে আপনার দেখা হতে পারে’ ।
শেখভ উত্তর করলেন, ‘আজ রাতে আর সময় নেই। আমাকে ফিরতেই হবে। ফেরার অন্য নাম মৃত্যু’। অন্য চারটি গল্পের কাহিনির আদল রেখে অলোকরঞ্জন পাঠককে বারবার বিধ্বস্ত করেছেন। ‘একটি গাছ এবং তিনটি চরিত্র’ গল্পে ‘মালঞ্চ প্রান্তিক’ একটি গাছের নিছক পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রী সেঁজুতির সঙ্গে দূরদর্শী শিক্ষকের উচাটনময় সম্পর্কের বিস্তার আছে। ‘টেবিল’ এবং ‘রুনকির সংসার’ গল্পদুটিতে ঘটনা আর তার অব্যবহিত ব্যাখ্যার সাচ্ছল্য সবচেয়ে বেশি আছে।
অরিন্দমের অকৃতার্থ লেখার টেবিলটির সঙ্গে গল্পের ঘটনা বা চরিত্রের সম্পর্ক বর্ণনার সহজ তাগিদ গল্পটিকে সুলভ  করেছে।  রুনকি আর দিদা এবং দিদা আর রুনকির প্রগলভ  রূপকথা গল্পটিকে ঝলমলে  করে তুলেছে।  ‘দ্বিতীয় প্রাতরাশ’ গল্পটি তুলনায় বেশি বিস্তৃত এবং সেজন্যই হয়তো ভাষার মন্দ্র স্বচ্ছতা এখানে কিছু শিথিল।
অলোকরঞ্জনের নির্মম গদ্যভাষার সাফল্যও উল্টোদিক থেকে ধরিয়ে দেয় গল্পটি।  এই গল্পের একটি অংশে, শেষের আগের পংক্তির শেষে কোন বিরতি না থাকায় অর্থের বিপর্যয় রচিত হয়েছে।  এই গল্পের জনৈক চিকিৎসকের ‘ভাষার গুরু ও চন্ডাল জড়িয়ে  যায় বলে’  মার্জনামেদুর শ্রবণা,  গল্পের শ্রীময়ী নায়িকা, বিপন্ন বোধ করেন।
শ্রবণার মতোই, এই গল্প সংকলন বাংলা ভাষার পাঠকদের কাছেও একটি মেধাবী অর্জন।

Post a Comment

0 Comments