রবিবার

বইওয়ালার রবিবার/ ২

জয়ের উপন্যাসে কোথাও ছুটতান, জমজমা 

আবীর মুখোপাধ্যায়


মার্গ সঙ্গীতে পৃথক পৃথক স্বরের ক্রমিক ব্যবহারের এক প্রকার চলন রয়েছে, যা অলঙ্কার বা পাল্টা নামে পরিচিত। রাগ বিস্তারের সময় ওস্তাদরা রাগের বিশেষ কোনও স্বরকে কেন্দ্র করে অন্য স্বরগুলিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে এই চলনের মাধ্যমে রাগের অন্তরমহলের প্রকৃত রূপটি প্রকাশ করেন। এমন চলনের বিচিত্র লয়-কারিতেই তৈরি করেন তান-তোড়, আন্দোলন!
সদ্য সদ্য, এক কবির উপন্যাস, শেষ করে কেবল এই কথাগুলোই মনে হচ্ছিল আমার। মনে হচ্ছিল, কেন না ছোট এই উপন্যাসিকার গল্পের ভিতর ‘মানব-মানবীর সম্পর্কের গোপন ও তীব্র টানাপোড়েন’-এ আশ্চর্য সাংগীতিক বিস্ময়, এর কাহিনি কথনে। পরদায় পরদায় তার সপ্তকে উঠে আবার মন্দ্র ষড়জের সমে ফেরার রেওয়াজ যেন রাগ সংগীতের মতোই তার আরোহ-অবরোহণ। লেখক কাহিনির ধরতাই নিয়ে পাল্টার চালে ওস্তাদি চলনে এগিয়েছেন! তখনই মনে হয়, এ উপন্যাস কোনও কবির। কবির নাম, জয় গোস্বামী। আর উপন্যাসের নাম ‘খাদ’।
অসাড় দাম্পত্য নিয়ে জয়ের লেখা নতুন নয়। এর আগে অন্য উপন্যাসে নিরুপায় ও অনুচ্চারিত ভালবাসার কথা পাই জয়ের সেই সব দাম্পত্য-সম্পর্ক বিশ্লেষণে! চোদ্দটি অধ্যায়ে ভাঙা জয়ের এই উপন্যাসিকার কাহিনিও তেমনই নিরুপায় এক প্রেমিকের। সে প্রেমিক রুণুকাকা। জয়ের আগের কয়েকটি উপন্যাসের মতোই এই উপন্যাসিকার নায়ক রুণুকাকাও অক্ষম, যৌন শীতল এক পুরুষ। কিন্তু ‘কনফার্মড বাঁজা’ স্ত্রীর জন্য তার প্রেম দুর্জয় হয়ে দেখা দিয়েছে কাহিনির পরতে পরতে। কাঠ দুপুরে তাই ‘অক্ষম’ রুণুকাকা হন্যি হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায় তার ভালবাসার সঙ্গিনীর সুখ- সঙ্গের জন্য, একটি পুরুষের সন্ধানে। আর তারপর সেই পুরুষকে কাকুতি-মিনতি করে বাড়ি ডেকে নিয়ে এসে স্ত্রীর মশারির মধ্যে রেখে ‘একটু কাজ আছে’ বলে কার্যত পালিয়ে যায়! আর তখনই গ্রন্থের ব্লার্বের কথা মনে পড়ে। বিস্ময় জাগে, ‘সম্পর্ক যে কত বিচিত্রই হয় জীবনে’! ভালবাসার কতো রূপ!
সুদীপ্ত দত্তের শোভন প্রচ্ছদ ও পাতা জোড়া অলঙ্কিত উপন্যাসিকার পঞ্চম অধ্যায়টির জন্য জয় একটি পাতায় মাত্র দশটি বাক্য খরচ করেছেন। রুণুকাকার ধরে আনা পুরুষ পরিতোষ এক অনিবার্য টানে ‘কাকিমা’-র মশারির ভিতর ঢুকে পড়ে। লেখক অনেক কথাই বলতে পারতেন, কিন্তু বললেন না। বললেন, একটি অধ্যায় পরে, ফ্লাশব্যাকে। পরিতোষের নিজের বাড়িতে, নিজের বিছানায়। যেখানে দুঃস্বপ্নের অতলান্ত খাদের ধারে দাঁড়িয়ে মিলনান্তিক ঘোরে পরিতোষ ভয়ানক সে অভিজ্ঞতার কথা ভাবে। ‘দিত্বীয়বার যখন হয়, পরিতোষকে খাটতে হয়ই না বলা যায়। পরিতোষের মাথা এসময় পুরোটাই বিকল হয়ে যায়। আজও গিয়েছিল। জেগে ওঠে, জেগে থাকে শুধু শরীর। একত্রিশ বছরের খেলোয়াড় শরীর। আগুন আগুন মাথাটা থেকে স্রোত নীচের দিকে বয়ে যায়। নাকি উলটোটা। নীচের আগুন মাথায় ওঠে কিনা পরিতোষ বুঝতে পারে না। দ্বিতীয়বার পরিতোষ যখন তার সর্বস্ব নিয়েই নিক্ষিপ্ত হল খাদের অতলে তখনও পরিতোষ হেরে যাওয়া কুস্তিগীরের মতো চিত’।
পড়তে পড়তে একরকম ভয়ও লাগে রুণুকাকা চরিত্রটিকেও। নিজের অজান্তে আতঙ্ক তৈরি হয়। দিন দিন পুনরাবৃত্তির ফলে, কাহিনির বাঁকে একসময় পরিতোষের যেমন লেগেছিল। আর তাই সে, যখন সব বুঝতে পারে, মুক্তির জন্য মায়ের পরামর্শে বেপরোয়া হয়ে রুণুকাকাকে খুনের ভয়ও দেখায়। উপন্যাসের এই পর্বেই ভালবাসায় ভাস্বর রুণুকাকাকে আমরা চিনে ফেলি। মায়া হয় লোকটার জন্য। নিরুপায় প্রেমিক রুণুকাকা বলে, ‘আমাকে মেরো না পরি। আমি ছাড়া ওকে দেখার কেউ নেই। তুমি বিশ্বাস করো আমি ওকে ভালবাসি পরি। ...কিন্তু সেই ভালোবাসার কোনো প্রমাণ দিতে পারি না। আমি অক্ষম। তাই ওকে যে আমি ভালোবাসি তার এটাই একমাত্র প্রমাণ, যা ও বিশ্বাস করবে। যা ওকে খুশি রাখবে’।
কাহিনির শুরুতে যে পাল্টার চলন, গল্প যত ফুরিয়েছে মীড় নয়, সেই পাল্টারই ব্যবহার। একটানা পড়লে, রুণুকাকার নতুন ‘শিকার’ আর পরিতোষের নব দাম্পত্যের সমান্তরাল বিন্যাসে গমক তানের ছন্দ পাই। কোথাও আবার ছুটতান, জমজমায় যুগলবন্দি। এখানেই গদ্য নয়, পদ্যকারের জয়ের জিত!
আসলে এ কাহিনি কোনও রুণুকাকা বা পরিতোষের একার নয়। জটিল এ সময়ে নিয়ত এমনতো কত খাদই আসে। তেমন আমাদের সবার পথের বাঁকে এসে পড়া ভয়াল খাদ। আমরা পরিতোষের মতো করেই খাদের অতলে হারিয়ে কখনও মৃত্যুর গহন অন্ধকার থেকে ফিরে আসি। কখনও বা আসি না। আমরাও আসলে, পরিতোষের মতোই! পা ফেলে যেমন গুটিয়ে নিতে জানি, খাড়া খাদের মধ্যে নিরুদ্বেগে পড়তেও জানি। পরি যেমন, ‘খাদ এগিয়ে এল পরিতোষের সামনে। আর পা বাড়িয়ে দিল পরিতোষ। তারপর পড়তে শুরু করল। এখনও পড়ছে...পড়ছে...’। শূন্যে পড়ছি আমরাও!

খাদ
জয় গোস্বামী, প্রকাশক – প্রতিভাস, দাম – ১০০ টাকা

Post a Comment

0 Comments