লকডাউনের দিনলিপি

দিনের পরে যায় দিন

দেবকুমার দত্ত


আমরা বড্ড ভয়-কাতুরে।
কে বলে এ কথা! কে করে এবম্বিধ আকাশকুসুম চয়ন! কে এই বদনাম বাঙালি ও ভারতীয়র গায়ে শুঁয়োপোকার মতো ছুড়ে দেওয়ার সাহস রাখে!
তা হলে এ সব তো বেশ ভাবনার কথা। মানছি, সমহারে এ দুর্ভাবনারও বিষয়। এ সবের জবাবে এক এবং অদ্বিতীয় সাহসিক উচ্চারণ—
‘‘আমি ভয় করব না ভয় করব না।
দু বেলা মরার আগে মরব না, ভাই, মরব না।।’’
রসিক পাঠক এটুকু বুঝতে পেরেছেন, আমরা ভীরু নই। আমরা এখন করোনা-আবহে ‘করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পঞ্জা।’ কেন এমন দাবি, সেটাও নিবেদন করি। সবিনয়ে। লুচির এক পিঠ তো শুধু তেল-ঘিয়ের স্নেহাশিস পেলে চলবে না। ও-পিঠটাও তো মিনিমাম আরশোলার পিঠের চেয়ে একটু হালকা রঙ করে ভাজতেই হয়। তাই তো। এ বার যুদ্ধ মুখোমুখি।
গঞ্জ-শহরের বাজার এলাকায় আমরা কি দিনমজুরের চায়ে ডোবা নেড়ুয়ার মতো নিস্তেজ হয়ে পড়েছি? না, কক্ষনো না। গদাইলস্করি চালে অনেকটা অপ্রয়োজনীয়ভাবে ভিড় করছি। পিঠ চুলকানোর বাহানায় যেন গা ঘেঁষে হাঁটছি, দাঁড়াচ্ছি, কথা বলছি, ফুঁকছি, ফুঁকতে অন্যকে সাহায্যের আগুন বাড়িয়ে দিচ্ছি। সুধী পাঠক, মাফ করবেন যদি ভুল বলি। আমার আশঙ্কা, ওই বাজারি বাচালতার অনেকটাই খেজুরে আলাপ। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, লকডাউনকে আমরা 👍🏽দেখাচ্ছি। যাবনিক বুলিতে ভাবখানা আমাদের এমন, We look down upon lockdown, ...হা হা হা...
এ ধরনের আচরণের ফল আত্মঘাতী, যদিও কিঞ্চিৎ বিলম্বে উপলব্ধ। তথা দুর্ভোগ্য (যদি বাংলাভাষায় 'গেরায্য' হয়)। কম বলা হল। পরিবার, তা থেকে গোষ্ঠী, জনপদ,... আক্রান্ত হতেই থাকবে। টেনিসন-এর ছোটনদীটার মতো Novel COVID-19 যেন বলবে— ‘but I go on for ever’, বা একটু ইতর বিশেষ। আমাদের অস্তিত্বকে আমরাই বিপন্ন করছি। হ্যাঁ, খাল কেটে কুমির আনছি আমরাই! প্রশাসনিক স্তরে ব্যাপক, বহুবিধ ও বর্ণময় গণসচেতনতা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নাগাড়ে গণমাধ্যমে মৃত্যু-আক্রান্ত- নিরাময় বিষয়ক খতিয়ান ও পরিসংখ্যান প্রচারিত হয়ে চলেছে। তবু আমরা করোনাকে ভয় করি না।
সার কথা, স্বাধীনতা লাভের সাত দশক পরও আমরা শৃঙ্খলা মেনে চলতে শিখিনি। ভারতকে মাতৃভূমি হিসেবে ভাবতে শিখিনি। সুনাগরিকের দায়িত্ব পালন করি না। সবাই নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। রাজনীতির কথা এখানে না আনাই ভাল।
করোনা আমাদের অনেক কিছুই ভাবতে প্ররোচিত করছে-করবে। আমার অনুভূতির কথাই বলি। গোটা বিশ্বের বিশ্বাসের চালচিত্র বদলে যাচ্ছে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার পরিসরে চিড় ধরছে। আড়চোখে পরস্পরকে দেখার অভ্যাস নিন্দিত নয়, নন্দিত হচ্ছে এবং হবে। যুদ্ধাস্ত্রে বোধহয় মরচে পড়বে। জীবাণু যুদ্ধ মানব সভ্যতার ক্রীড়াঙ্গনে  শেষ বাঁশি বাজাবে। এখন স্পষ্ট, বিপুল জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিলাস বৈভব প্রভাব প্রতিপত্তি ইত্যাদি সত্ত্বেও মানুষ বড় অসহায়। এই ব্রহ্মাণ্ডে বেচারা একমাত্র বুদ্ধিজীবী জীব মানুষ আজ নতজানু। একদম দিশেহারা, বিহ্বল। হতচকিত।
বুঝতে পারছি, স্মৃতিশক্তি কেমন দিন দিন দীন হীন ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। সামাজিক মূলস্রোত থেকে দূরে বিচ্ছিন্ন থাকলে বুঝি এমনটা হওয়া স্বাভাবিক। মানুষের উদ্যম কমে আসছে। কোনও কিছুতেই আগ্রহ নেই। মনঃসংযোগ দারুণভাবে বিপন্ন। কিছুই ভাল লাগছে না।
দিনমজুরের দুরবস্থা অবর্ণনীয় এখন, তীব্রতা আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা। পরিযায়ী শ্রমিকরা হতভাগা। তাঁদের উপর জীবাণুনাশক স্প্রে করা হল, ভাবা যায়! কেন দাবি উঠছে না, পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজেদের রাজ্যে কাজ পান। স্বাস্থ্য পরিষেবা খাতে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় স্তরে বাজেট বরাদ্দ আরও বাড়ানো হোক। আমরা সবাই সুস্থ, সবল, নীরোগ শরীরে বাঁচতে চাই। এ চাওয়ায় কোনও নাটকীয়তা নেই। এ তো জৈবিক চাহিদা। ‘পৃথিবীর গভীর গভীরতর অসুখ এখন।’ তবু ভাবি, ‘পৃথিবী আবার শান্ত হবে।’ পল্লিকবি কুমুদরঞ্জনের কথা দিয়ে শেষ করি— ‘সব শুঁয়াপোকা প্রজাপতি হবে/ আমি থাকি সেই আশাতে।’

Post a Comment

0 Comments